রামধনুর দেশে রামধুনু নেই

রামধুনুর দেশে রামধুনু নেই। দ. আফ্রিকার দিগন্ত রেখা থেকে চিরতরে উবে গেল শতাধিক কিংবদন্তি রামধুনু ‘মাদিবা’। স্বপ্ন-সংগ্রাম-সৌহার্দ্য-ত্যাগ-বিরহ-দুর্ভোগ জরার মাখামাখিতে অত্যুজ্জ্বল সেই রামধুনু আর দেখা যাবে না। নিপীড়ন নিষ্পেষণে ওষ্ঠাগত দ. আফ্রিকার আকাশে জীবন বাজি রেখে আর কেউ বলবে না, ভয় নেই আমি আছি। সে চলে গেছে। বিশ্ব মানবতাকে কাঁদিয়ে দূরাকাশের যোজনা পেরিয়ে অনন্তলোকে চলে গেছেন ক্ষণজন্মা সেই মানুষটি। তিনি আর ফিরবেন না হয়তো কুনু গ্রামের সেই ঘরটার জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আর কাউকেই ডাকবেন না কোনোদিন- কিন্তু তার অস্তিত্বের সেই স্মৃতিটুকু অমনই থেকে যাবে চিরদিন। ইতিহাসের বলি হতে তিনি আসেননি- ইতিহাস সৃষ্টি করতে এসেছিলেন। করেছেনও তাই। নেলসন ম্যান্ডেলা মানব সভ্যতার এক কিংবদন্তি ইতিহাস। সে চলে গেছে। বিশ্ব মানবতাকে কাঁদিয়ে দূর আকাশের নক্ষত্র হয়েছেন- ৫ ডিসেম্বর, জোহানেসবার্গে নিজ বাসভবনে রাত সাড়ে আটটায় তার মৃত্যু হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা গভীর রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন- এমন ঘোষণার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল দুঃসংবাদের আশংকা। স্থির কণ্ঠে তিনি গোটা বিশ্বের সামনে ম্যান্ডেলার মৃত্যুর খবর জানালেন।
দীর্ঘদিনের অসুস্থতার ফলে এ দুঃসংবাদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাসহ গোটা বিশ্ব প্রস্তুত থাকলেও এ মুহূর্ত কারও কাছেই কাম্য ছিল না। সভ্যতার দোহাই দিয়ে শ্বেতাঙ্গরা একসময় যখন বর্ণবাদের ঘূর্ণাবর্তে বিলীন করে চলেছিল মানবতাবাদকে, ঠিক তখনই সব শক্তি নিয়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষুদ্রাকায় এ মানুষটি। প্রতিবাদের ভাষা তার জানা ছিল। বুঝেছিলেন, শক্ত হাতেই ধরতে হবে হাল, উঁচুতে তুলতে হবে ঝাণ্ডা। তাই শেষ পর্যন্ত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামের সশস্ত্র দলটির নেতৃত্ব উঠে আসে তারই হাতে। অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেইন শহরে গঠিত হওয়ার সময় এ দলের নাম ছিল ‘সাউথ আফ্রিকান নেটিভ ন্যাশনাল কংগ্রেস’। পরে ১৯২৩ সালে নতুন নামে আবির্ভূত হয় দলটি। ম্যান্ডেলা দলের সর্বশক্তি ব্যবহার করেন বর্ণবৈষম্য, বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে। না, পথ মসৃণ ছিল না, ছিল বন্ধুর। এমনকি ১৯৬২ সালে নাশকতার অভিযোগ তুলে তাকে পুরে দেয়া হয় কারাগারে, দীর্ঘায়িত হতে হতে শেষ পর্যন্ত একটানা ২৭ বছরের কারাবাস। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্র“য়ারি মুক্তি পান মানবাধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত এই নেতা। ততদিনে বিশ্বসভায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় আসন করে নিয়েছেন নিজের দেশে ‘মাদিবা’ নামে পরিচিত ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার তখনকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন, জয় হয়েছিল তার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনেরই। সুবাদে দক্ষিণ আফ্রিকা পেয়েছে রাজনীতির এক নতুন ধারা, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুবর্ণের গণতন্ত্র। গোটা বিশ্ব প্রস্তুত থাকলেও এ দুঃসংবাদ কারও কাছেই কাম্য ছিল না।

No comments

Powered by Blogger.