নেত্রীরা, মানুষ পোড়ানো বন্ধ করুন
মানুষকে লাকড়ির মতো পুড়িয়ে নিজেদের পেট ভরানোর জন্য ভাত রান্না করার এই উৎকট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞে নেমেছেন যে নেত্রী-নেতারা এবং যাঁরা এটা বন্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছেন না, তাঁরা কেউই বোধ হয় মানুষ নন। এই মুহূর্তে কোনো চিকিৎসক তাঁদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করার সুযোগ পেলে দেখতে পেতেন, সেসব শরীরে হূদয় নেই আর মস্তিষ্ক বহুকাল ধরে মৃত। তাঁদের চালাচ্ছে স্বার্থ, ক্ষমতার লোভ আর নির্বোধ ব্যক্তিগত জেদ ও আক্রোশ। ভূতের গল্পে সমজাতীয় জীবের দেখা মেলে। তাদের তিন অক্ষরের নামটা বড় খারাপ। গত ২৮ নভেম্বর অবরোধে শাহবাগে বাসের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল সদ্য কৈশোর পার হওয়া ছেলেটি। কয়েক দিন পর ছেলেটি মারা গেলে তার মায়ের যে আহাজারি, সেটার রেকর্ড করা অংশ শুনেছি। কথাগুলো মাথার মধ্যে বেজে চলেছে। সান্ত্বনার অতীত দুঃখে তিনি নেতাদের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখেছিলেন, মায়েদের বুক কেন তাঁরা খালি করছেন? আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, দুই নেত্রীর কাছে এটুকুই তাঁর প্রার্থনা ছিল। তাঁর অসহনীয় বিলাপে বারবার এ কথাও এসেছিল যে, এমন নেতাদের হত্যা না করলে দেশে শান্তি আসবে না। কী অসহনীয় শোক তাঁর মুখ দিয়ে এ কথা বের করিয়েছিল, তা কল্পনা করতেও ভয় করে। এটা ঠিক যে গণতন্ত্রে মানুষই সবচেয়ে বড় ও পবিত্র পুঁজি। তবে সে পুঁজি মানুষের ভোট ও সমর্থন, মানুষের প্রাণ নয়। কিন্তু আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীরা ভোট অর্জন নয়, দখল করার লক্ষ্যে মানুষের জীবনকে পুঁজি বানিয়ে নির্মমভাবে অকাতরে খরচ করছেন।
দেউলিয়া হওয়ার ভয় করবেন, সেটুকু বুদ্ধিও তাঁদের আর নেই। মানুষকে ধনে-প্রাণে মেরে নিজেদের ফায়দা হাসিলের বিকৃত পথটাই শুধু তাঁরা দেখতে পান। এ হত্যাযজ্ঞ সুতরাং তাঁদের সুপরিকল্পিত খেলার দৌড়। ক্ষমতা ধরে রাখা বা ক্ষমতায় যাওয়া চাই? মানুষকে বলি দাও, বিশেষ করে গরিব মানুষকে। সরকারকে পথে আসতে বাধ্য করতে হবে? মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বাঁচাতে হবে? মানুষকে মেরে-পুড়িয়ে দেশজুড়ে পৈশাচিক অরাজকতার চাপ সৃষ্টি করো; মানুষের জীবন অবরুদ্ধ-অচল করে দাও। অথবা, বিরোধী দলকে সমূলে বিনাশ করতে হবে? তাদের ভোটের ত্রিসীমানার বাইরে ভাগিয়ে দিতে হবে? তাদের হত্যাকারী ও গণশত্রু প্রমাণের স্বার্থে অচলাবস্থা টিকিয়ে রাখো; সবটুকু সুযোগ নিংড়ে-কচলে ব্যবহার করো; চাই কি হত্যাযজ্ঞে গোপনে হাত লাগাও। আবার, কে বলতে পারে যে অন্য কেউ এই সুযোগে মানুষ মেরে নিজেদের পথ সুগম করার উপায় খুঁজছে কি না? তাবৎ মোড়কের হর্তাকর্তারা মানুষেরই কল্যাণের নামে নিশ্চিন্তে মানুষের রক্তে হাত ডোবাতে পারেন। সম্মিলিত স্বার্থে এসব ঘটনার সত্যের পর্দা উঠতে দেওয়া হবে না, পানি ঘোলা করে রাখা হবে। কিন্তু যাঁরা মরছেন, যাঁরা ভুগছেন, তাঁরা যে মানুষ! মানুষ মারার এই রাজনীতিতে যাঁরাই প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে শামিল রয়েছেন, প্রতিটি হত্যা আর ক্ষতির জন্য তাঁরা অন্তত নিজেদের বিবেক আর সর্বসাধারণের কাছে দায়ী থাকবেন। যত দিন বাঁচবেন, তত দিন। বিরোধী জোটের ডাকা গত অবরোধের আগের অবরোধে বাসে লাগানো আগুনে দগ্ধ গীতা সেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায় শুয়ে আগুনে পোড়াদের দেখতে আসা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই।’ বিরোধীদলীয় নেত্রী বোধ হয় এঁদের দেখতে যাওয়ার মতো সাহস পাচ্ছেন না। কিন্তু সামনে পেলে গীতা সেন তাঁকেও নিশ্চয় একই কথা বলতেন। মানুষকে পুড়িয়ে মারা যায়, তার বেঁচে থাকার ন্যূনতম অবলম্বন তছনছ করে দেওয়া যায়। কিন্তু মানুষের মনে গুমরানো জবাবদিহি-চাওয়া প্রশ্নগুলো হত্যা করা যায় না।
২৭ নভেম্বর বার্ন ইউনিটের বিছানায় পিঠজোড়া পোড়া ঘা নিয়ে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে থাকা ১৩ বছরের শিমুল গোঙানির স্বরে আমাকে বলেছিল, ‘আমি কী করছি আপা? আমারে পোড়া দিয়া দিছে!’ রিকশাচালক আমানুল্লাহ্ সরদারের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এই ছেলেটি লেগুনায় হেলপারি করার সময় হরতালের আগুনে পুড়ে যায়। হরতাল-অবরোধে জীবিকার একান্ত প্রয়োজনে প্রাণ হাতে করে যাঁরা পথেঘাটে বের হন, তাঁদের বড় অংশটিই খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ। কাজ না করে তাঁদের উপায় নেই। নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নাগরিকদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব অস্বীকার করবেন কোন মুখে? একইভাবে মানুষের ভোটে হওয়া বিরোধীদলীয় নেত্রীও এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। ক্ষতিপূরণের দায়িত্বও উভয়েরই থাকে। প্রধানমন্ত্রীর নিজের শোয়া-বসা, যাওয়া-আসা নিরাপদ করাটা রাষ্ট্রীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর সড়কের যে বাড়িটিতে জননেত্রী শেখ হাসিনা থাকেন না, দেখলাম সেটিরও সুরক্ষার জন্য কোনো এক বাহিনীর সাঁজোয়া যান মোতায়েন রয়েছে। বিরোধী দলের নেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়া আপসহীন আন্দোলনের পরের কিস্তিতে রাস্তায় নামবেন বলে নিজের কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তার খোঁজখবর নিচ্ছেন। সাবেক স্বৈরশাসক লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ব্যক্তিগত সার্কাসমঞ্চ থেকে দর-কষাকষির ডিগবাজির মধ্যেই ভীষণ হুমকি দিয়ে বলেছেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করলে চার-চারটি পিস্তলের গুলি ছুড়ে তিনি আত্মহত্যা করবেন। চমৎকার এসব খবরের প্রায় সবই ৫ ডিসেম্বরের কাগজে পড়া। নিজের নির্বিঘ্নতা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনটা প্রত্যেক নেত্রী-নেতাই বোঝেন; এমনকি নিজের প্রাণ নিজে নেওয়ার মতো ঠাট্টার বিলাসিতাও তাঁদের পোষায়। চমৎকারের ওপর চমৎকারি করা আরও খবর আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘সর্বদলীয়’ সরকারের মন্ত্রীদের এক বৈঠক শেষে ত্রাণমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যারপরনাই উন্নতি হয়েছে! গীতা সেন বলেছিলেন, ‘আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’ ধারণা করি, তিনি নির্দিষ্ট কোনো একটি সরকারকে বোঝাননি। কেননা, তিনিই বলেছিলেন, ‘খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না।’ সরল মানুষের সোজাসাপ্টা কথা—কোনো ইঙ্গিত খোঁজার কিছু নেই। রাজার নীতি রাজনীতি আমিও বুঝি না। তবে এটুকু বুঝি যে, আমরা আম-জাম-কচুঘেঁচু জনতা নিজেরা নিজেদের শাসককে নির্বাচন করেই বাঁচতে চাই। সে নির্বাচন আত্মঘাতী ভুল বলে দেখা গেলে আবার সঠিক নির্বাচনের চেষ্টা করার জন্য খোলা সুযোগ, সবার মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার অবাধ সুযোগ চাই। অরাজনৈতিক ‘তৃতীয় শক্তি’র জুজুর ভয়ে থমকে না থেকে নিজেদের সর্বৈব ভুল শোধরানোর পথ খুঁজতে চাই; পথ তৈরিতে অংশ নিতে চাই।
আর সেটা করার জন্য আমরা বেঁচে থাকতে চাই। আবার অবরোধ শুরু হয়েছে। সরকার একতরফা নির্বাচনে যাবেই বলে ভয় দেখাচ্ছে। আবার, অন্য কিছু হতে পারে বলে জল্পনা-কল্পনাও শোনা যাচ্ছে! বুকটা হিম হয়ে যায়। আরও কত মানুষ কতভাবে মরবে? ২০০৪ সালে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ডাকা এক হরতালের দিনে একটি দোতলা বাসে আগুন দিয়ে ১১ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তখন আমরা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম যে এমনও ঘটতে পারে! কিন্তু খারাপ দৃষ্টান্ত একবার পার পেয়ে গেলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এখন বিরোধী দলের সহিংসতা ও অরাজকতা-নির্ভর আন্দোলনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারাটা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পন্থা হয়ে উঠতে চলেছে। মহোদয়া ও মহোদয়েরা দয়া করে মানুষ মারার এই রাজনীতি, মানুষের লাশের ওপর ভর করা এই অমানবিক রাজনীতি বন্ধ করুন। এভাবে কারও জিৎ হয় না। এমন ‘জিৎ’ অর্থহীন। টেকেও না। এভাবে সবাই মরে, সবাই হারে। নিজেদেরও ধিক্কার দিই। আমরা কেমন মানুষ যে, এই রাজনীতি চলতে দিচ্ছি? কেন ক্রোধে, দুঃখে ফেটে পড়ে গণতন্ত্রকে জীবন বাঁচানোর পথে আসতে বাধ্য করছি না?
কুর্রাতুল-আইন-তাহিমনা: সাংবাদিক।
কুর্রাতুল-আইন-তাহিমনা: সাংবাদিক।
No comments