বর্তমান ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে সৃষ্টি হল? by বদরুদ্দীন উমর

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা যতই জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতা করুন, তারাই মূলত বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর পুনর্বাসন ও উত্থানের জন্য দায়ী। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলেও শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এবং তাদের দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার আহ্বানের মধ্য দিয়েই জামায়াতে ইসলামীর পুনর্বাসন হয়েছিল। কারণ এই সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্তদের অধিকাংশই ছিল জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী। এভাবে পুনর্বাসিত হওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপই ছিল ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। এ কাজটি করে জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবের কাজের কোনো উল্টো কাজ করেননি। যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে তাদের প্রতি দেশ গড়ার আহ্বানের অর্থই ছিল তাদের আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানানো। এভাবে সক্রিয় হওয়া ধর্মীয় রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ছাড়া সম্ভব ছিল না। শেখ মুজিবের নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই শেখ মুজিবের উত্তরসূরি হিসেবে জিয়াউর রহমান ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে অন্যান্য পার্টির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীকেও পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।
এরপর এলো এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন। ১৫ দল ও ৭ দলে বিভক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক দক্ষিণ ও বামদল এই আন্দোলন করে। সে সময় জামায়াতে ইসলামীও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নামে। যেহেতু তারা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, এ কারণে ১৫ দল ও ৭ দল উভয়েই জামায়াতে ইসলামীকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের সঙ্গে এক অঘোষিত লিয়াজোঁ গঠন করে। এর ফলে দেখা যায়, ১৯৮০-এর দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে সব থেকে বেশি লাভবান হয় জামায়াতে ইসলামী। তারা যে এ সময় শুধু সাংবিধানিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করে তাই নয়, রাজনৈতিকভাবে তারা মধ্যশ্রেণীর কাছে একটা স্বীকৃত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর ফলে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী জাতীয় সংসদে ১৩-১৪টির মতো আসনে জয়লাভ করেছিল, যা পরবর্তী কোনো নির্বাচনেই তাদের দ্বারা আর সম্ভব হয়নি। এর অর্থ জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে এসেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এ কারণে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতা করে তারা তাদের তিনজনের মতো সদস্যকে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করেছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যে মতিউর রহমান নিজামীর এখন বিচার করা হচ্ছে জামায়াতের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে, তার সঙ্গে বৈঠক করেই শেখ হাসিনা এই সমঝোতা করেছিলেন!! এজন্য জামায়াতকে তারা সংসদে মহিলা আসনও দিয়েছিলেন!!! এই সমঝোতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল এবং সেই সঙ্গে জামায়াতেরও শক্তি বৃদ্ধি হয়েছিল। তাছাড়া সরকার গঠনে জামায়াতের সঙ্গে এই সমঝোতাই ছিল অন্যতম প্রধান কারণ, যে জন্য ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের কোনো বিচার করেনি! নিজেরা খুব জামায়াতবিরোধী, ধর্মীয় রাজনীতিবিরোধী ইত্যাদি বলে অনেক শোরগোল ও প্রচার-প্রচারণা চালালেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের এসব দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ও সুসম্পর্কের কথা বেশ কৌশলের সঙ্গেই ধামাচাপা দেয়া হয়ে থাকে। আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা এক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকাই পালন করে থাকেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে চুরি, দুর্নীতি, নির্যাতনসহ নানা ধরনের গণবিরোধী কাজ করায় তাদের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পায়। সেই সুযোগে জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগ বিরোধিতা শুরু করে শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে হাত মেলায়।
কাজেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই নিজেদের স্বার্থে সুযোগ-সুবিধামতো জামায়াতে ইসলামীকে ব্যবহার করছে। এদিক দিয়ে তাদের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য আছে এ কথা যারা বলে, তাদের নির্বোধ অথবা মতলববাজ ছাড়া আর কী বলা যায়?
শেখ হাসিনার সরকারের ২০০৯-১৩ সালের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের প্রয়োজন ছিল সসম্মানে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা। তার জন্য গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেটা না করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টায় তারা পঞ্চদশ সংশোধনীর মতো কাজ থেকে নিয়ে এমন অনেক কিছু করেছেন, যার ফলে দেশের পরিস্থিতির মধ্যে এক অদৃষ্টপূর্ব সংকট তৈরি হয়েছে। তাদের দ্বারা এই সংকট সৃষ্টিতে কিছু এসে যেত না, যদি এর দ্বারা জনগণের জীবনে এত দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি না হতো, জনগণের জীবন ও নিরাপত্তা যদি ভয়াবহভাবে বিপন্ন না হতো। এই অবস্থা সৃষ্টি করে শেখ হাসিনা তাদের আওয়ামী লীগ ও তথাকথিত ১৪ দলীয় জোট নিয়ে একতরফা নির্বাচনের জন্য মরিয়া হয়ে যা করছেন, তা যদি না করতেন তাহলে বিএনপি এবং তাদের তথাকথিত ১৮ দলের প্রধান শরিক জামায়াতের মতো দক্ষিণ রাজনৈতিক দল নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ পেত না। কাজেই বর্তমানে দেশজুড়ে যে ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে এটা সরকারিভাবে বিএনপি ও প্রধানত জামায়াত করলেও এর কেন্দ্রে আছে আওয়ামী লীগ। কারণ শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট কায়দায় নিজের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা এবং তার জন্য নির্বাচনে নিজের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার জন্য নানা ধরনের অপকর্ম যদি না করতেন, তাহলে এভাবে ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া জামায়াত-শিবিরের দ্বারা সম্ভব হতো না। এভাবে শেখ হাসিনা জামায়াতের শক্তি যেভাবে বৃদ্ধি করেছেন তার দায়-দায়িত্ব থেকে কি যুক্তিসঙ্গতভাবে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন?
আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা বলছেন, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানে পরিণত হবে! যদি সত্যি এমন সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এই সম্ভাবনা কিভাবে তৈরি হল? যে পাকিস্তানিদের ১৯৭১ সালে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তারা নিজেদের হাজার রকম রাজনৈতিক সংকট সত্ত্বেও যদি এদেশে আবার পাকিস্তান ফেরত আনতে সক্ষম হয়, তাহলে বাঙালিদের উচিত পাকিস্তানকে কুর্নিশ করা। স্বাধীনতা অর্জনের পর গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী দেশকে পরিচালনা করা এবং এদেশ থেকে ধর্মীয় রাজনীতি উচ্ছেদ করা এ দেশের বাঙালি শাসকশ্রেণীর দ্বারা যদি সম্ভব না হয়, যদি তাদের একটানা ৪২ বছরের শাসনের পর আবার পাকিস্তানের শাসন ফেরত আসে তাহলে তার দায়িত্ব কার? এর দায়িত্ব এদেশের শাসকশ্রেণীর পরিবর্তে, এই শাসকশ্রেণীর সব থেকে বৃহৎ ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পরিবর্তে যদি হাজার মাইল দূরে থাকা পরাজিত পাকিস্তানি শত্র“দের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে তার থেকে অনৈতিহাসিক এবং নির্বোধ চিন্তা ও কাজ আর কী হতে পারে? শুধু জামায়াতে ইসলামী যে ধ্বংসযজ্ঞ করছে এটা নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে মাতামাতি করে পাকিস্তানের জুজুুকে সামনে আনার চেষ্টা করে এটা এভাবে কেন ঘটল, এই পরিস্থিতি কিভাবে ও কী কারণে তৈরি হল এ চিন্তাভাবনার ধারে কাছে না যাওয়া হয়, তাহলে এ কাজ যারা করছে তাদের চিন্তাগতভাবে দেউলিয়া এবং ফ্যাসিস্ট ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.