আমি মরতে প্রস্তুত
মৃত্যু আরও আগেই নির্ধারিত ছিল তার জন্য, যা তুমুল সাহসে বরণ করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েই বরং দীর্ঘায়িত করেছেন। কাঠগড়ায় সেই সাহসী উচ্চারণ : আমি মরতে প্রস্তুত (আই অ্যাম প্রিপেয়ার্ড টু ডাই) আজ বিপ্লবের ম্যানিফেস্টো হয়ে গেছে; ঠাঁই নিয়েছে দেশমুক্তির সংগ্রামে নামা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার মননে। ১৯৬৪ সালের জুন মাস। ‘রিভোনিয়া ট্রায়াল’ নামে সেই কুখ্যাত বিচার প্রহসনের দ্বিতীয় বছর চলছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার ম্যান্ডেলাসহ ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর ১৯ নেতাকর্মীকে অন্তর্ঘাতসহ নানা দেশদ্রোহী অপরাধে অভিযুক্ত করে বিচার চালাচ্ছে। চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এ বিচার যখন শুরু হয় তার আগেই ম্যান্ডেলা অন্য একটি অপরাধে পাঁচ বছরের কারাবাসে, সেটি সেই মেয়াদে তৃতীয় বছর! রায় যে মৃত্যুদণ্ড- এটা তখন আফ্রিকার দুধের শিশুটিরও জানা হয়ে গেছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে যখন ম্যান্ডেলার পালা এলো তখন তিনি কোনো আইনজীবীর শরণ নিলেন না; বরং আÍপক্ষ সমর্থনে পড়লেন হাতে লেখা এক বিবৃতি। কিংবা এটাকে বক্তৃতা বলাই ভালো। ১৭৬ মিনিট ধরে সে ভাষণ স্তম্ভিত হয়ে শুনে গেছে আদালত।
সেই অসামান্য ভাষণের শেষ অনুচ্ছেদটুকু রাজনৈতিক বক্তৃতার সারিতে ধ্রুপদী মর্যাদায় আসীন। যার ভাবানুবাদ এরকম- গোটা জীবনটা আমি উৎসর্গ করেছি আফ্রিকার মানুষের মুক্তি-সংগ্রামে। আমি শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছি এবং লড়েছি কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও। আমি লালন করি সেই গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের স্বপ্ন, যেখানে সবাই শান্তি ও সৌহার্দ্যে থাকবে এবং কোনো বৈষম্য থাকবে না। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯- এ পাঁচটি বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়ে ম্যান্ডেলা চেষ্টা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে গড়ে তুলতে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ক্ষমতায় আসীন এএনসি। ঘুণা, বিদ্বেষ, প্রতিশোধস্পৃহা নয়- গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অটুট বিশ্বাস ও প্রখর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সমাজে বিভাজন অনেকটাই দূর করেন ম্যান্ডেলা। আর ইতিহাসের এমনই দিক পরিবর্তন, এক সময় নাশকতার মিথ্যা অভিযোগে যাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল, সেই নেলসন ম্যান্ডেলাকেই ভূষিত করা হয় নোবেল শান্তি পুরস্কারে।
No comments