নিঃসঙ্গ গণতন্ত্র ও জ্বলন্ত স্বদেশ by ড. মাহফুজ পারভেজ

একাকী ও নিঃসঙ্গ হাঁটছে বাংলাদেশ; বাংলাদেশের গণতন্ত্র। হাঁটছে নিঃসঙ্গ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন। সরকার। সবাই একাকী ও নিঃসঙ্গ। অন্যদিকে জ্বলছে দেশ।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বলা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ একটি জেলখানা’। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪২তম বার্ষিকী উদযাপনের সময় এই হচ্ছে দৃশ্যপট। ১৫৪ জন যে নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন, সেই নির্বাচনের চরিত্র লুকানোর বিষয় নয়। বাকি ১৪৬ আসনের  বিপরীতে সাকুল্যে ৩৮৭ জন প্রার্থীর উপস্থিতিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্র আশ্চর্যের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্ব। দেখছে অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বিশ্ব রেকর্ড। বৈধতা নামক শব্দটি এখন কিভাবে নিজের ইজ্জত ও অস্তিত্ব রক্ষা করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। যে নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই সরকার গঠনের ফয়সালা হয়ে যায়, সে নির্বাচন সত্যিই এক অতি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক আবিষ্কার। গণতন্ত্রের আদিভূমি গ্রিস বা গণতন্ত্রের সূতিকাগার বৃটেন বা বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ভারত যে ফর্মুলা উপস্থাপন করতে পারে নি, বাংলাদেশ সেটাই করলো। বিশ্ব গণতন্ত্রের ইতিহাসে বাংলাদেশ এখন নানা কারণে বহুল আলোচিত নাম। এই একাকী ও নিঃসঙ্গ গণতন্ত্র চর্চার অপর পিঠে দেশ জ্বলছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণহীন। জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক সার্কাসের কবলে নিপতিত।  জামায়াত-শিবির মারমুখো ও আক্রমণাত্মক। বি. চৌধুরী-কাদের সিদ্দিকী-ড. কামালরা বিক্ষুব্ধ। নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞরা হতবাক। মিডিয়া হতচকিত। ব্যবসায়ীরা সাদা পতাকা হাতে রাজপথে। জনগণ প্রায় জিম্মি ও গৃহবন্দি। রাজধানী দৃশ্যত বিচ্ছিন্ন। রাজপথ-রেলপথ-নৌপথ অরক্ষিত। বন্দর স্থবির। পণ্য ও জন পরিবহন বিপর্যস্ত। শিক্ষাঙ্গন ও পরীক্ষা অঘোষিত ছুটির ফাঁদে আক্রান্ত। একাকী ও নিঃসঙ্গ গণতন্ত্রের অর্জনের যাত্রাপথের সামনে দণ্ডায়মান বহু বিসর্জন। কি পেলাম আর কি হারালাম, এই অঙ্ক আসলেই মিলাতে পারছে না মানুষ। দেশ প্রকৃত অর্থে কোথায় যাচ্ছে? এই চিন্তায় সকলেই অস্থির। মুখে হাসি নেই কারও। ব্যক্তিগত জীবনে ও সামষ্টিক সমাজে জমেছে শঙ্কার কালো মেঘ। পত্রিকার ভাষ্য মতে, ২৬শে নভেম্বর-১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ দিনে নিহত হয়েছেন ১৪৫ জন। তফসিল ঘোষণার পর থেকে সহিংসতায় মারা গেছে কমপক্ষে ১০০ জন। আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। কয়েকটি জেলায় চলছে যুদ্ধাবস্থা।  সম্পদ ভস্মীভূত হয়েছে হাজার কোটি টাকার। আগুন আর রক্তে অঙ্কিত প্রতিদিনের সংবাদপত্র। অনেকেই বলেছেন, এমন ডিসেম্বর বাংলাদেশে আগে কখনও আসে নি। সরকার বলপ্রয়োগে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বটে। কিন্তু ফলাফল হচ্ছে ভয়াবহ। শক্তি প্রয়োগে জন্ম নিচ্ছে সহিংসতা। শিগগিরই এই পরিস্থিতির উন্নয়ন হওয়ার সম্ভাবনা কেউই দেখছে না। সামনের দিনগুলোর অবস্থা কেমন হবে, সেটা ভেবে সবাই প্রবলভাবে অসহায় বোধ করছে। শাসন-প্রশাসনে এক ধরনের দলীয়করণের অভিযোগের সঙ্গে গণতন্ত্রকেও দলীয় ইচ্ছার অধীন করার কারণে গভর্নেন্স নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এই প্রশ্ন সহজেই সমাধান হবে না। সকল দলের অংশগ্রহণ ও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির আগে একাকী ও নিঃসঙ্গ গণতন্ত্র সামগ্রিক সমস্যার যুতসই দাওয়াই হিসেবে বেশি দিন কার্যকরী হতে পারবে না। রক্তাক্ত স্বদেশকেও শান্তিপূর্ণ করতে পারবে না। ক্রনিক রোগের মতো সমস্যা থেকেই যাবে। আসলে গণতন্ত্র ও নির্বাচন সুশাসনের ও শান্তির বিস্তার ঘটায়। নিঃসঙ্গ পথে গণতন্ত্রের একাকী পথচলা সেই কাজটিই যদি করতে না পারে, তাহলে গৃহীত উদ্যোগকে সফল বলা যাবে না। সেই উদ্যোগই শ্রেষ্ঠ, যা সফলতা আনে। সরকারের উদ্যোগ যেমন সফল হচ্ছে না; বিরোধী দলের আন্দোলনও সফল হচ্ছে না। মাঝখান থেকে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সমাজ ও মানুষ। অতএব কাউকে দুর্ভোগ ও বিপদে না ফেলে সফলতার পথ ও পন্থা খুঁজে বের করাই সংশ্লিষ্টদের আশু কর্তব্য হওয়া উচিত।

mahfuzparvez@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.