সরকার একতরফা নির্বাচনে কেন গেল? by আবদুল লতিফ মণ্ডল

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ও রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ৬ ডিসেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফর শেষে রাজধানীর এক হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপে বসাতে পারাকে তিনি কিছুটা সাফল্য বলে মনে করেন। তাদের মধ্যে দু’দফা বৈঠক হয়েছে এবং তারা আরও বৈঠকে বসার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। সংলাপের মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানোর ব্যাপারেও তারা একমত হয়েছেন। সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্যের অবসান হবে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বেরিয়ে আসবে বলে তিনি আশা করেন। তারানকোর মধ্যস্থতায় ১০ ও ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের গুলশানের বাসায় প্রথম ও দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও তারানকোর ঢাকা ত্যাগের পর দুই দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে তৃতীয় বৈঠকটি একই স্থানে নিল ওয়াকারের মধ্যস্থতায় ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে ছিলেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, গণপূর্তমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. মঈন খান ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বিএনপির পক্ষ থেকে চারটি প্রস্তাব দেয়া হয়। এগুলো হল- ‘নির্বাচনের বর্তমান তফসিল স্থগিত, দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তি, নয়াপল্টনের কার্যালয় অবমুক্ত এবং সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।’ এসব শর্ত মানা হলে পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, প্রশাসন নিরপেক্ষকরণ এবং অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হবে। আর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিএনপিকে হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে বলে। এ ছাড়া সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর নাশকতার বিরুদ্ধে বিএনপিকে দলীয় অবস্থান নেয়ারও প্রস্তাব দেয়া হয়। এসব প্রস্তাব নিয়ে নিজ নিজ দলীয় ফোরামে আলোচনা করে তারা আবার বসবেন বলে জানান।
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ঢাকায় আগমনের আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিলে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ২ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা যাচাই-বাছাইয়ের তারিখ ৫ ও ৬ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৩ ডিসেম্বর এবং নির্বাচনের তারিখ ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্ধারণ করা হয়। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের তারিখ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। পত্রপত্রিকার খবর মোতাবেক বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে মোট ১ হাজার ১০৭ জন মনোনয়নপত্র জমাদানকারীর মধ্যে ৩৪০ জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখের মধ্যে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় পার্টির (জাপার) মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার নিয়ে। জাপার দেড়শ’ প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন গ্রহণ করা হলেও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন সত্ত্বেও টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে দলটির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদেরসহ কয়েকজনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন গ্রহণ করেননি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা। তাই দলটির মুখপাত্র ১৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘উনাকে (এইচএম এরশাদকে) জোর করে এমপি বানিয়ে দেয়া হচ্ছে।’ রিটার্নিং অফিসারদের জারিকৃত গণবিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর পত্রপত্রিকার প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দাঁড়িয়েছে ১৫১ জনে এবং তারা হলেন আওয়ামী লীগ ১২৭, জাতীয় পার্টি-জাপা ১৮, জাসদ ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ২ এবং জাতীয় পার্টি-জেপি ১ জন। যেহেতু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দলটির মনোনয়নপত্র জমাদানকারীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বলেন, সেহেতু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওই পার্টির নির্বাচিতদের বাদ দেয়া হলে বাকিরা মূলত মহাজোট সরকারের শরিক দলের।
সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমন বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনরা উদ্বেগ এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। দশম সংসদ নির্বাচনকে ‘তামাশা’ বলে মন্তব্য করেছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। তারা এই ‘একতরফা’ ও ‘পাতানো’ নির্বাচন অবিলম্বে স্থগিত করার দাবি জানিয়েছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেছেন, ‘নির্বাচনের নামে দেশে এটা তামাশা হচ্ছে।’ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এ নির্বাচনকে ‘সমঝোতার ভিত্তিতে একাধিক ঠিকাদারের মধ্যে টেন্ডার ভাগাভাগির’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন একটি হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ নির্বাচনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।
৫ জানুয়ারি ২০১৪-এ যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার ফল জনগণ এখনই জানেন। ইতিমধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের ফল প্রকাশিত হয়েছে এবং বাদবাকি আসনগুলোর ফলাফল সহজেই অনুমেয়। ধরে নেয়া যায়, আওয়ামী লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনেই শুধু বিজয়ী হবে না, দুই-তৃতীয়াংশ আসনও পাবে। সংসদ হবে আওয়ামী লীগের শরিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সর্বদলীয় সরকারে যারা যোগ দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি।’ তবে প্রশ্ন উঠেছে, ‘সমঝোতার ভিত্তিতে যে সংসদ তৈরি হচ্ছে, সেখানে যাকে খুশি ভোট দেয়ার অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে? নির্বাচনী মেকানিজমের মাধ্যমে একসময় যা হরণ করা হতো বলে প্রধানমন্ত্রী যথাযথভাবেই বর্ণনা করেছিলেন, এখনকার অবস্থা তা থেকে কী অর্থে ভিন্ন?’
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, দেড়শ’র বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর আলোচনা অব্যাহত থাকার কোনো সম্ভাবনা আছে কি? সংলাপে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার বরাত দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর যুগান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই নেতা নিশ্চিত করেছেন, নির্বাচনের আগে আর সংলাপ হচ্ছে না। তারা নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন। তারা বিএনপিকে জানিয়ে দিয়েছেন, তফসিল বাতিল করা সম্ভব নয়। তবে নির্বাচনের পর কী করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। বিএনপি একই সঙ্গে সংলাপ ও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কৌশল গ্রহণ করলেও সরকার নির্বাচনের তফসিল স্থগিত না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকার কারণে এখন তারাও মনে করেন, সংলাপ ভেঙে গেছে। আর কোনো আলোচনা নয়। আন্দোলনের পথে যাওয়া ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর নেই। বিএনপি ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬টা থেকে ২০ ডিসেম্বর ভোর ৬টা পর্যন্ত টানা ৭২ ঘণ্টা নতুন করে অবরোধ ডেকেছে। এর আগে তিন সপ্তাহে তিন দফা অবরোধ করেছিল বিরোধী দল।
সমঝোতায় না গিয়ে সরকার একতরফা নির্বাচনের পথে এগুলো কেন?
এক. আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার কোনো সংকট সমঝোতার মাধ্যমে নিরসনের নজির খুব একটা নেই। ১৯৯৪ সালে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুললে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিরোধী দল সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন তা নিয়ে মতৈক্য না হওয়ার কারণে সংকট সমাধানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি বিএনপি একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের নিজ দায়িত্বসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ এবং প্রশাসন দলীয়করণের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নবম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। আইন-শৃংখলার চরম অবনতি ঘটে। ফলে বহুল আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।
দুই. বিভিন্ন জরিপে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রতি জনগণের বিপুল সমর্থন এবং নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের সমূহ সম্ভাবনা ফুটে ওঠায় আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কূট কৌশলের আশ্রয় নেয়। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য বিরোধী দলের দাবি পূরণে ক্ষমতাসীনরা নেয়নি কোনো পদক্ষেপ। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির প্রধান শর্ত নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি, যদিও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হবে বলে সংসদকে জানিয়েছিলেন এবং মহ

No comments

Powered by Blogger.