কাদের মোল্লার ফাঁসি আর আমাদের হাসি by বদিউর রহমান

অবশেষে কাদের মোল্লার ফাঁসি হল। এ ফাঁসি কার্যকরের ঘটনায় আমরা এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম। রাখে আল্লাহ মারে কে- এ বিশ্বাস অনেকের জন্য আরেকবার মজবুত হল বলা বোধ হয় দোষের হবে না। ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’র গান গেয়ে ফিরোজ সাঁই প্রমাণ করেছিলেন নিজের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে শেখ হাসিনাও বলতে পারেন ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’। তার বিপরীতে ‘মারে আল্লাহ রাখে কে’ কথাটি যদি এখন দেশ-বিদেশের উদাহরণ দিয়ে বলি তাহলে অনেকেই বড় অসন্তুষ্ট হবেন। তখন বলা হবে দুষ্কৃতকারী, পথভ্রষ্ট, ষড়যন্ত্রকারীদের কাণ্ড এটি, এমন মৃত্যু অপমৃত্যু। উপমহাদেশের এক সময়ের বড় তিন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুকে কি আমরা ‘মারে আল্লাহ রাখে কে’ বলব? জিয়াউর রহমান, জিয়াউল হক, রাজীব গান্ধী কিংবা ‘কোথায় সিরাজ সিকদার’- মৃত্যুগুলোকে কি মারে আল্লাহ রাখে কে বলতে পারব? আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না- সর্বশক্তিমানের ওপর অটুট বিশ্বাস থাকলে অদৃষ্টবাদ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার আর অবকাশ থাকে না; তখন যা-ই কিছু ঘটে, সবকিছুকেই ওপরওয়ালা অর্থাৎ সর্বশক্তিমানের হুকুমে বলে চালিয়ে দেয়া যায়। তাই যদি অবিচল বিশ্বাস হয়, তবে তো রাখে আল্লাহ মারে কে অথবা মারে আল্লাহ রাখে কে- এ দুয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না, তখন দুটোই একার্থক, সমার্থক এবং একই কথার দুটো প্রকাশভঙ্গি মাত্র। অনেক সময়ে বিকল্প দৃশ্যত বিকল্প মনে হলেও আসলে অর্থ বা মেসেজ একটিই। সহজ একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও সহজ হতে পারে। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি, বেরোনো বড় কষ্ট, কিন্তু বাইরে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন হয়েছে। আবার একজনকে ঘরেও থাকতে হবে, এটাও বড় প্রয়োজন। বড় ভাই ছোট ভাইকে বললেন, একজনকে তো বাইরে যেতে হবে, একজনকে ঘরে থাকতে হবে। এখন আমি বিকল্প প্রস্তাব দিচ্ছি, তোর যেটা খুশি বেছে নে। আমি ঘরে থাকি, তুই বাইরে যা; অথবা তুই বাইরে যা, আমি ঘরে থাকি- কোনটা তোর পছন্দ? বুঝতেই পারছেন, যেই লাউ সেই কদু, নয় কি?
আমি বলি অদৃষ্টবাদ অনেক সময়ে শেষ ভরসা হয়। যখন নিজ যোগ্যতায় আমরা কোনো কিছু করতে সক্ষম হই না, যখন রাষ্ট্র আমাদের কোনো সুরক্ষা দিতে পারে না, যখন সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা বেঘোরে প্রাণ হারাই, যখন সহিংসতার আন্দোলনে ককটেলে কিংবা পেট্রল বোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে নিরীহ ব্যাংকার, টেম্পো বা বাসচালক/হেলপার মারা যায়, তখনও হয়তো আমরা বলব, মারে আল্লাহ রাখে কে। আইনের শাসন না থাকলে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যক্তিস্বার্থে-ক্ষমতার লোভে দু’জনের হাতে বন্দি হয়ে পড়লে আমাদের আমজনতার ভাষ্য হবে- হয় রাখে আল্লাহ মারে কে, না হয় মারে আল্লাহ রাখে কে। কাদের মোল্লার বেলায় এবার ৪৬ ঘণ্টার আয়ু বৃদ্ধি আমাদের তা-ই স্মরণ করিয়ে দিল। সাঈদীকে যেমন চাঁদে দেখেছে তার কোনো ভক্ত, তেমনি কেউ হয়তো এখন বলবেন, কাদের মোল্লা আল্লাহর পেয়ারা বান্দা ছিলেন বিধায়ই তো মঙ্গলবার তার স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছিলেন। কেন, আপনারা পরে টের পাননি সেই ভি চিহ্নের কী মাজেজা ঘটেছে? স্বরাষ্ট্র আর আইন প্রতিমন্ত্রীর ঢাকঢোল পেটানো সংবাদ সম্মেলনের সে কী ঘোষণা রাত ১২-০১ মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি হবে! মানুষ ভাবে এক, আল্লাহ করে আরেক, নয় কি? সব প্রস্তুতি নিয়েও কি ফাঁসি হল? হয়নি, কারণ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে আ’লীগ নির্বাচনী ইশতেহার বেশ আগে থেকে প্রণীত থাকলেও ক্ষমতায় বসার পর এ বিচার নিয়ে আওয়ামী পাগলামি ঘটেছে যথেষ্ট। কেউ বলেছেন, এটা একটা প্রতীকী বিচার, দু’একজনের হলেই চলবে; কেউ পাল্টা বলেছেন, এ বিচার চলতেই থাকবে; আবার বিচারকার্য সমাধা নিয়ে কতজনের কত সময়-বাঁধা কথা! তার পরের স্কাইপি-এপিসোড তো আমাদের হাসালো, হায়রে বিচারের গুরুত্ব। ভালো, তারপরও তো বিচারপতি নিজামুল হক অবসরে যান না, পদত্যাগ করেন না, ট্রাইব্যুনাল থেকে চলে গেলেই যেন দায় শেষ আর কী! এবারও আমরা বলতে পারি, সবই আল্লাহর ইচ্ছা, তার হুকুম ছাড়া যে গাছের পাতাও নড়ে না। অতএব বিচারপতি নিজামুল হকেরই বা কী দোষ, সরকারের মন্ত্রীদেরই বা ত্র“টি কোথায়, আর আওয়ামী লীগের হম্বিতম্বির জন্য তাদেরই বা দোষ দেবেন কেন?
কাদের মোল্লার রায়ের কার্যকারিতা মঙ্গলবার (১০.১২.১৩) রাতে হঠাৎ থেমে গেল। চেম্বার বিচারপতি পরদিন অর্থাৎ ১১.১২.১৩ সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফাঁসির রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেছেন। পরের ঘটনা এবার সবাই জানলেন। অবশেষে রিভিউ আবেদন খারিজ হল, রায় কার্যকর হল। সরকার এবং আলী হয়তো নরম গলা উঁচিয়ে বলতে পারবে, তারা বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা অক্ষরে অক্ষরে মানেন। অবশ্যই বিলম্বে হলেও অর্থাৎ ৪৬ ঘণ্টা পরে হলেও সব প্রসেস শেষে ফাঁসি হওয়ার আলাদা একটা সুনাম সরকার এবং আলী পাবে, পেয়েছেও বটে। কিন্তু তা-ই যদি হবে, তবে আগের পাগলামিটা হল কেন? ওটা কি অযোগ্যতা, অদক্ষতা, নাকি অতিরিক্ত ফুটানির অপচেষ্টা ছিল? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তি অবশ্যই কাম্য। যুদ্ধাপরাধীই বলা হোক, আর মানবতাবিরোধী অপরাধই বলা হোক, এটার বিচার নিয়ে বেশ ঢিলেমি হয়েছে। তা না হলে সরকারের পুরো মেয়াদের শেষ পর্যায়ে মাত্র প্রথম ফাঁসি কার্যকর হল কেন? আলী-সরকার কি শুরু থেকে দৃঢ়ভাবে মনোযোগী হলে সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদের মধ্যে দোষীদের বিচারের রায় কার্যকর করে যেতে পারত না? আমরা মনে করি, অবশ্যই পারত। তাহলে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, তবে কেন করা হল না? আমরা মনে করি, এ বিচার নিয়ে আলী তথা আলী-সরকার বেশ খেলেছে, তারা এ বিচারকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য বেছে নিয়েছে। তাদের হয়তো ধারণা হয়েছে, অনেক ভালো কাজের পরও রাজনীতিতে অনেক সময়ে বড় ধরনের মার খেতে হয়, বিশেষত বাংলাদেশে তো এর কোনো তুলনাই হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ের পর চার্চিল আর ক্ষমতায় আসতে পারেনি; দেশ স্বাধীন করেও মুসলিম লীগ পরে ঘরে বসে গেছে; বাংলাদেশ স্বাধীন করেও সাড়ে তিন বছরের মধ্যে আলী একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে গেছে। ’৯০-এর পর থেকে পালাক্রমে বাজাদ এবং আলী ক্ষমতায় এসেছে এবং ক্ষমতা হারিয়েছে। গত মেয়াদে আলী মূলত কয়েকজন গডফাদারের খেসারত দিয়েছে পুরের নির্বাচনে। একইভাবে বাজাদ তাদের দুর্নীতি আর হাওয়া-ভবনের ‘সুনামের’ সুনামিতে পড়েছে। এই-ই যখন অবস্থা, তখন রাজনীতির জন্য হাতের পাঁচ বা তুরুপের তাস ইশকাপনের টেক্কাটা তো হাতে রাখতে হয়, নাকি? আলী তার আগের মেয়াদে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেমন শেষ করেনি, হাতে রেখে দিয়েছিল, এবারও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হাতে রেখে দিতে চেয়েছে। এবার যে বাজাদ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসতে চাইছে না, তার কারণও মূলত এ বিচার। আলী-সরকারের শুরু করে দেয়া এ বিচার বাজাদের গলার-কাঁটা বা ফাঁস হয়ে গেছে। সরকারে গেলে এ বিচার চালিয়ে না গেলে বাজাদের দ্রুত-পতন যেমন নিশ্চিত, আবার বিচার চালিয়ে গেলেও জামায়াত-শিবিরের চাপে বাজাদ চ্যাপটা হয়ে যেতে বাধ্য। অতএব আলীর ঝামেলা আলীই শেষ করুক- এমন কৌশলেই থাকতে চায় বাজাদ। আলীও সে সুযোগটা নিয়ে ধীরে চলো নীতিতে এগিয়েছে। একটি রায় কার্যকর করে আলী জনসমর্থনে যেমন আরও এগিয়ে গেল, তেমনি বিপরীত দিকে বাজাদকে আরও বেকায়দায় ফেলে দিল। এখন অন্য রায়গুলো কার্যকর করতে হলে আবার আলী-সরকারই দরকার।
ভোটের ফায়দা নেয়ার জন্য এ বিচার আলীর হয়তো হাতের পাঁচ, তুরুপের তাস কিংবা আমরা বলব, আলীর এ মেয়াদে এ বিচারের বড় অংশ শেষ করে অধিকাংশ রায় কার্যকর করে দিতে পারলে বরং আলীর জনপ্রিয়তা আরও বাড়ত। ব্যবসায়ে ঝুঁকি নেয়া অনেক সময়ে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে বটে; কিন্তু প্রেম, যুদ্ধ কিংবা রাজনীতিতে বড় ঝুঁকি বড় ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে বেশি। এসব ক্ষেত্রে হাতের একটা পাখি বনের দুটোর চেয়ে অবশ্যই উত্তম ভাবতে হয়। আলী এ বিচারের বিলম্বের কৌশলে বেশি লাভবান হবে ভাবার এখনও কোনো কারণ দেখা যায় না। রাজনীতি করার জন্য এ বিচারকে পুঁজি করা আলীর জন্য অবশ্যই বেমানান এবং জনগণের কাছে তা অগ্রহণযোগ্যও বটে। বিচার-প্রক্রিয়ায় অযথা বিলম্বের জন্য জনগণ আলীর সমালোচনায় মুখর। তারপরও আমরা আলী এবং আলী-সরকারকে সাধুবাদ দেব, একটা ভালো শুরু অধ-সমাপ্তের সমান (A good start is half-finishing)। এ বিচার নিয়ে আমরা যেন আর কোনো আওয়ামী-পাগলামি না দেখি, আমরা যেন বাকি রায়গুলো যথা দ্রুতগতিতে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই কার্যকর দেখতে পাই। মনে রাখা ভালো, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। আর কাদের মোল্লা তো ভাগ্যবান, এখন ফাঁসি হলেই বা ক্ষতি কোথায়, তিনি তো ৪২ বছর আরামে বেঁচেছিলেন! জনগণের হাসি আমরা দেখেছি, যুদ্ধাপরাধীদের আরও ফাঁসিতে আমরা প্রাণখুলে আরও হাসতে চাই, দেশটা আমাদের।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.