দাদির মৃত্যুর শোকগাথা শোনালো নাতি-নাতনি

পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো যে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে তা খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করেছে দেশটি। পাকিস্তানের এক ভুক্তভোগী পরিবারের মুখে ড্রোন হামলার নির্মমতার কথা শুনেছে মার্কিন কংগ্রেস। ড্রোন হামলার বৈধতা নিয়ে যখন কংগ্রেসে বিতর্কের সুর চূড়ায় উঠেছে তখন পাকিস্তানি এ পরিবারটির আত্মীয় বিয়োগের গল্প কংগ্রেসে রীতিমতো ঝড় তুলে দেয়ার মতো অবস্থা। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপজাতি অধ্যুষিত উত্তর-ওয়াজিরিস্তানের এক পরিবারের তিন সদস্যকে কংগ্রেসে হাজির হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন কংগ্রেসম্যান অ্যালান গ্রেসন। দুই মেয়ে নাবিলা ও জুবাইরকে নিয়ে বাবা রফিকুর রেহমান মুখোমুখি কংগ্রেসম্যানদের।
এ সময় জুবাইর ড্রোন হামলায় কীভাবে তার দাদির মৃত্যু হয়। ছবি আঁকিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করে। ওই ছবিতে ফুটে উঠেছে তার মুখের ভাষা। জুবাইর জানায়, রান্নার সবজি তুলতে গিয়ে ড্রোন হামলার শিকার হন তার দাদি। ৬৭ বছরের বৃদ্ধা মানুষটি ঘটনাস্থলেই ছিন্নবচ্ছিন্ন হয়ে যান। বৃদ্ধার ছেলে কংগ্রেসকে বলেন, ভাবতেই পারেনি ড্রোনের ক্ষেপণাস্ত্র কেড়ে নেবে আমার নিরপরাধ মায়ের জীবন। তিনি আরও বলেন, আমার মাকে লক্ষ্য করে কেন সেদিন ড্রোন হামলা চালানো হয়েছিল তার উত্তর কেউ দেয়নি। সব গণমাধ্যম বলেছে, ওই হামলায় তিন, চার বা পাঁচ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেদিন নিহত হয়েছে একজন ... একজন স্নেহময়ী মা, একজন প্রিয় দাদি, মধ্যবয়সী এক নিরপরাধ নারী।” সেদিন সবজি তুলতে বুড়িমা’র (দাদির) সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়েছিল জুবাইরও। মাথার ওপর মার্কিন ড্রোন দেখেও সে ভয় পায়নি। জুবাইর বলেছে, ক্ষেতে দাদির সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমি মাথার ওপর ড্রোন উড়তে দেখেছিলাম। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। কারণ, আমি জঙ্গি নই। আমাদের ওপর হামলা হবে না। কিন্তু হঠাৎ ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে আসে আমাদের দিকে আমার দাদির দেহ মুহূর্তেই খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়।”
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে নালিশ : পাকিস্তানে ড্রোন হামলার শিকার ও ভুক্তভোগীরা জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের গবেষণা দলকে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। এদের মধ্যে হয় কেউ হামলার পরও বেঁচে আছে না হয় নিজ চোখে হামলার দৃশ্য দেখেছে অথবা তাদের পরিবারের কেউ এ ঘটনায় মারা গেছে। তেমন দু’জন ব্যক্তির জবানবন্দি তুলে ধরা হল- সাদা উল্লাহ ওয়াজিব (কিশোর) : সাদা উল্লাহর বাড়ি উত্তর ওয়াজিরিস্থানের মীর আলী এলাকার মাচি খেলে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে সে ড্রোন হামলায় গুরুতর আহত হয়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে লিখিত অভিযোগ করেছে। সাদা উল্লাহ জানায়, ড্রোন হামলার শিকার হওয়ার আগে তার জীবন ছিল হাসি-খুশিতে ভরা। আমি স্কুলে যেতাম কিন্তু এখন যেতে পারি না। আমি পঙ্গু।
ওয়ালিদ সিরাজ (২২) : ওয়ালিদ সিরাজ স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছিল সে। ড্রোন নামক দুঃস্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে তার সব স্বপ্ন। ওয়াহেদের সে দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সেদিন ভোরে আমার বাবা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দেয় অন্য দশটা দিনের মতো। যথারীতি নামাজ শেষে পড়তে বসেছিলাম। আর তখনই একটি ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র এসে আঘাত করে আমাকে সেই থেকে আমি এক প্রতিবন্ধী। তথ্যসূত্র : রয়টার্স, দ্য নেশন।
পাকিস্তানে এমন ওয়ালিদ, সাদা উল্লাহর সংখ্যা অগণিত। হিশম আবরার খালিদ রাহিম, ফিরোজ আলী খান, মারোয়ান আলীম নাজিব সাদিক এরা প্রত্যেকেই আজ জাতিসংঘের শরণাপন্ন। তারা বিচার চায়- বিচার চায় এ বিচার বহির্ভূত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। জাতিসংঘের কাছে তারা জীবনের নিরাপত্তা চায়। নিরাপত্তা চায় সমস্ত বেসামরিক নাগরিকের। যেন আর কেউ তাদের মতো অকাল অথর্ব না হয়- আর কোনো মায়ের কোল যেন অবহেলায় শূন্য না হয়।
উল্লেখ্য, আমেরিকা ড্রোন হামলা চালিয়ে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৩২৫ জন পাকিস্তানিকে হত্যা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ধরনের হামলার নির্দেশ দিলেও আমেরিকার সব নাগরিক যে ড্রোন হামলাকে সমর্থন করছেন তা নয়। এ ধরনেরই একজন হলেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান অ্যালান গ্রেসন। রেহমান পরিবারের দুর্দশা মার্কিন কংগ্রেসে তুলে ধরার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনিই।

No comments

Powered by Blogger.