এক দেশে একদিন... by মুহাম্মদ রিয়াজুল আমীন

সকাল ১০টা। দেশের সরকারপ্রধান চিন্তিত মুখে তাঁর অফিসে বসে আছেন। তাঁর কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ। সকালেই তিনি খবর পেয়েছেন, সরকারের সবচেয়ে গোপন ভল্টে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর একটি চুরি গিয়েছে।
প্রথম সারির নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে এ রকম একটি ঘটনা কীভাবে ঘটে, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না। তার চেয়ে বড় কথা, ঘটনা ঘটেছে কাল রাতে আর তিনি খবর পেয়েছেন আজ সকালে। এ ব্যাপারে তার সেক্রেটারিকে বক্তব্য, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে বলে তাকে রাতে জানানো হয়নি। সেক্রেটারির এমন উত্তরে তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গিয়েছিল। যে ঘটনা দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে কলাগাছ দেখিয়ে দিয়েছে, সেই ঘটনার সঙ্গে সে কিনা সামান্য ঘুমের তুলনা করে। মনে হচ্ছিল গাধাটাকে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করেছেন। তিনি চিন্তিত মুখে কমিউনিকেশন মডিউলে তাঁর সেক্রেটারির কোড নম্বর প্রবেশ করালেন। ওপাশ থেকে সেক্রেটারির গলা শোনা গেল।
‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, স্যার। ন্যাশনাল ডিফেন্স প্রধান নিজ হাতে এই কেসটা হ্যান্ডেল করছেন। তার ওপর ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান নিজের তত্ত্বাবধানে একটি দল গঠন করেছেন, যারা সকাল থেকেই কাজে লেগে পড়েছে। আশা করা যাচ্ছে, সন্ধ্যার ভেতরেই চোর ধরা পড়বে।’
শুনে সরকারপ্রধানের কোনো ভাবান্তর হলো না। তিনি আগেও দেখেছেন, কোনো সমস্যা হলেই এরা কমিটি-টমিটি করে একাকার অবস্থা করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। দু-একটা মিটিং, ব্যাস, তারা মনে করে সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
তিনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সেক্রেটারিকে বললেন, ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স-প্রধান, ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স-প্রধান ও পুলিশ-প্রধানকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো। তাদের বলো, এটি একটি সাত মাত্রার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। সব মিডিয়ায় খবর পাঠিয়ে দাও, এই মুহূর্ত থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত “ডিপ রেড” অবস্থা জারি করা করা হলো।’

সাত মাত্রা এবং ডিপ রেড অবস্থার কথা শুনে সেক্রেটারির মুখ শুকিয়ে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘কিন্তু স্যার, সাত মাত্রার মিটিং এবং ডিপ রেড অবস্থা তো শুধু যুদ্ধের সময় ডাকার নিয়ম, এখন কি ডাকা ঠিক হবে?’

সরকারপ্রধান ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘তোমাকে যা করতে বলা হয়েছে করো। এত কিছু না বুঝলেও চলবে।’



দুই.

বেলা ১১টা। ব্রেকিং নিউজ দেখিয়ে একটা খবর প্রচার করা হলো। সেখানে বলা হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান থেকে চুরি গেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এখন পর্যন্ত কেউ বা কোনো সংস্থা এ ঘটনার দায় স্বীকার করেনি। কী চুরি গেছে, তার ব্যাপারে এই মুহূর্তে কেউই মুখ খুলতে রাজি নয়। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ডিপ রেড অবস্থা জারি করা হয়েছে।

এ খবর জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড আতঙ্কের সৃষ্টি করল। তারা দ্রুত যে যার কর্মস্থল থেকে বাড়ির পথ ধরল। দোকানগুলো থেকে যে যা পারল, কিনে মজুত করে রাখল। কেউ কেউ মনে করল ‘বিরবাকাট বোমা’, যা কিনা পুরো সূর্যকে ১০ মিনিটের ভেতর ঠান্ডা করে দিতে পারে, সেটা চুরি গেছে। কেউ মনে করল ‘সিকিউরিটি কোড’, যা দিয়ে পুরো দেশ দুই মিনিটের ভেতর ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব, সেটা চুরি গেছে। কারও অনুমানই ঠিক হলো না। কিন্তু দুপুর ১২টার ভেতর দেশে অস্বাভাবিক এক থমথমে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।



তিন.

সন্ধ্যা সাতটা। শীতের সময় বলে আলো অনেক আগেই নিভে গেছে। সাকিব ও শরীফ দাঁড়িয়ে আছে শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে, জনমানবহীন একটা প্রান্তরে। দুজনই প্রচণ্ড বিরক্ত। একে তো শীতকাল, তার ওপর সন্ধ্যা। শীতে দুজনেই রীতিমতো কাঁপছে।

শরীফ আরেকটু গরমের আশায় জ্যাকেটটা ভালোমতন জড়িয়ে নিয়ে সাকিবকে প্রশ্ন করে, ‘ওস্তাদ, শীতটা কেমন পড়ছে, দেখছেন? হাড় পর্যন্ত কাইপা ওঠে।’

তার কথা শেষ হলো না। এর মধ্যেই আকাশে একটা উড়ুক্কারের আলো দেখা গেল। শরীফ ও সাকিবকে ধুলোর সাগরে ভাসিয়ে ঠিক তাদের পাশেই নামল উড়ুক্কার। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন দেশের স্বনামধন্য বিজ্ঞানী প্রফেসর ঝমলু। ছোটখাটো একজন মানুষ, চোখে গোল গোল চশমা, মুখে খোঁচ খোঁচা দাড়ি। উড়ুক্কার থেকে নেমেই তিনি সাকিবের দিকে হাত বাড়ালেন, ‘কই, দাও।’

শুনে সাকিবের কোনো ভাবান্তর হলো না। নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘জিনিস তো আছে। আগে পেমেন্টে।’

প্রফেসর ঝমলুর হাতের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিলেন, ‘এখানে পুরোটা আছে।’

ব্যাগ নেওয়ার জন্য সাকিব হাত বাড়ানোর আগেই শরীফ ছুটে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে নেয়। একগাল হেসে বলে, ‘ওস্তাদ, আমি দ্যাখতাসি। আপনের কষ্ট করন লাগব না।’

সাকিব কিছু বলে না। শুধু বিরক্ত চোখে একবার শরীফের দিকে তাকায়। তারপর নিজের পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাকটা খুলতে খুলতে প্রফেসর ঝমলুকে প্রশ্ন করে, ‘এইটা কী এমন জিনিস, যার জন্য আপনি এককথায় এত টাকা খরচ করলেন?’

প্রফেসর ঝমলু সাকিবের হাত থেকে ব্যাগটা নিলেন। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দেখলেন, ভেতরে সবকিছু ঠিক আছে কি না। তারপর বললেন, ‘সেটা তুমি জেনে কী করবে? তোমার লক্ষ্য তো পূর্ণ হয়েছে। বিশাল অঙ্কের টাকা পেয়েছ। চুরি ছেড়ে দেবে। নতুন জীবন শুরু করবে।’

শুনে সাকিব হাসে। বলে, ‘আপনি যেমন জানেন আমি কেন কাজটা করেছি, আমারও জানা উচিত আপনি কেন কাজটি করিয়েছেন। তাই না?’

প্রফেসর ঝমলু কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করলেন। চশমাটা খুলে পকেটে রাখতে রাখতে একটা লম্বা দম নিলেন, ‘বেশ। শোনো। অনেক কাল আগে, পৃথিবীর মানুষ কাজের পাশাপাশি এমন অনেক কিছু করত, যেগুলো এখন বাহুল্য হিসেবে ধরা হয়। এর ভেতর একটা হচ্ছে গান করা। তাদের মন খারাপ হলে তারা গান শুনত, মন ভালো থাকলে তারা গান গাইত। নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে কিংবা নিজের ভেতর জমে থাকা রাগ কমানোর জন্য তারা গানের সাহায্য নিত। তোমরা যে জিনিসটি চুরি করেছ, সেটাকে বলে ক্যাসেট। বহু আগের পৃথিবীতে যে মানুষগুলো গান করত, তারা গানের সুর ক্যাসেটের মধ্যে বন্দী করে পাঠিয়ে দিত সবার কাছে। কখনো সে সুর হতো ভালোবাসার, কখনো কষ্টের, কখনো বিদ্রোহের আবার কখনো শান্তির। তোমাদের চুরি করা ক্যাসেটে অসাধারণ কিছু গান বন্দী করা আছে। এই গানগুলোর ভেতর রয়েছে বিদ্রোহের কথা, শান্তির কথা, মুক্তির কথা, ভালোবাসার কথা, বিরহের কথা। আমি চাই, মানুষের এই অসাধারণ সৃষ্টি মিউজিয়ামে পড়ে না থেকে ছড়িয়ে যাক।’ কথা শেষ করে ঝমলু হাসেন।

যেমন হুট করে এসেছিলেন, তেমনি হুট করেই উড়ুক্কারে চড়ে বিদায় নিলেন প্রফেসর ঝমলু।

শরীফ মুখ খোলে, ‘আস্তা একটা পাগল। নাইলে এদ্দুরা জিনিসের লাইগ্যা কেউ এত ট্যাকা দেয়?’

উত্তর দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই অনুভব করল না সাকিব। প্রফেসর এর যাওয়ার পথের দিকে উদাস তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে শুধু ভাবল, ‘ঠিক বলেছিস। আসলেই মানুষটা পাগল।’

No comments

Powered by Blogger.