সাক্ষাৎকার- ‘সাহিত্যে প্রতিযোগিতার কোনো স্থান নেই’ —এলিনোর ক্যাটোন

২০১৩ সালের ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছেন নিউজিল্যান্ডের তরুণ লেখক এলিনোর ক্যাটোন। পুরস্কার ঘোষণার কিছুদিন আগে দ্য নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড পত্রিকার জন্য তাঁর এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সারাহ স্টুয়ার্ট সারাহ।

অনুবাদ: দিলওয়ার হাসান
প্রশ্ন: ম্যান বুকার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকার বিষয়টি আপনি কী করে জেনেছিলেন? তখন আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
এলিনোর ক্যাটোন: আমার প্রকাশক ম্যাক্স পোর্টার লন্ডন থেকে টেলিফোনে আমাকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। তিনি ছয়বার আমাকে রিং করেন। তার পরও আমাকে না পেয়ে ই-মেইল বার্তা পাঠান—‘আমার ফোন ধরুন’। কিন্তু রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকায় ওই বার্তা আমি পড়তে পারিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার বাড়ির ল্যান্ডফোনে কল করলে আমি ধরি। আমি আসলে তখন ফিশ কেক বানাচ্ছিলাম।
প্রশ্ন: আপনি তো জানেন, দুই বছর আগে জুলিয়ান বারনেস এই পুরস্কার পেয়েছেন, আর এক বছর আগে পেয়েছেন হিলারি ম্যানটেল। এবার কাহলুম তোয়িবিন আছেন আপনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীর তালিকায়। এটা কি আপনার ভেতরে শঙ্কার সৃষ্টি করে?
এলিনোর ক্যাটোন: পুরস্কারের তালিকায় তাঁদের সঙ্গে অবস্থান বা একে ঘিরে সৃষ্ট অকারণ ব্যস্ততা বা উত্তেজনা আমাকে ভীত করে না। ওই সব লেখকের গ্রন্থ পাঠ ও তাঁদের বইপত্র পছন্দ করার সুবাদে আমার কাছে তাঁরা পূর্বপরিচিত। তাঁদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেও ভালো লাগে আমার, ভালো লাগে গল্প-উপন্যাস বা লেখা বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে বিরামহীন আলাপ। তাহলে ভয়টয় লাগার প্রশ্ন উঠবে কেন? বিচারকদের প্যানেলের ব্যাপারেও আমার একই মত। যদিও তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা ভাবলে আমি বেশ শঙ্কিত বোধ করি।

প্রশ্ন: আপনি কি খুব সহজে ভয় পেয়ে যাওয়ার মতো মানুষ?

ক্যাটোন: না। আমার অভিজ্ঞতায় মূলত ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা প্রতিযোগিতার সঙ্গে সম্পর্কিত। যেসব লোক ভয় পায় আর যারা সচেতনভাবে ভয় দেখায়, তারা আসলে অন্যদের সঙ্গে আচরণের বেলায় প্রতিযোগিতামুখী। সাহিত্যে প্রতিযোগিতার কোনো স্থান নেই। একজন লেখক হিসেবে এবং একজন মানুষ হিসেবে আমি খুবই সংবেদনশীল ও নমনীয়।

প্রশ্ন: আপনার প্রথম উপন্যাস দ্য রিহারসাল-এর প্রেক্ষাপট ছিল শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রীর প্রেমের পরবর্তী অবস্থা। আপনার স্কুল বার্নসাইড হাইস্কুলে কি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছিল? আপনি কী ধরনের ছাত্রী ছিলেন?

ক্যাটোন: এ রকম কোনো ঘটনা ঘটে থাকলেও তা আমার জানা ছিল না! তবে শুনেছি, বার্নসাইডের লাইব্রেরিতে দ্য রিহারসাল বইটা রাখা হয়নি। এটা হয়তো একটা খারাপ লক্ষণ। আমার ধারণা, আমি খুব সুখী একটা বাচ্চা ছিলাম। স্কুলের গায়ক-গায়িকা দলের সদস্য ছিলাম আমি। বেশ কয়েক বছর বইঠা দিয়ে নৌকাও চালিয়েছি। কাজেই স্কুলে আমি শিল্পকলা আর ক্রীড়া উভয় ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছয় বছরের স্কুলজীবন শেষ করে এক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হই। কারণ, স্কুলে একজনের সঙ্গে ডেটিং করতাম আমি, যাতে স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছিল না। তারা আমার ওই ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলিয়েছিল। ব্যক্তিগত ব্যাপারে তাদের ওই অনধিকার হস্তক্ষেপের বিষয়টি আমার পছন্দ হয়নি।

প্রশ্ন: দ্য লুমিনারিস-এ রাশিচক্রের বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে; অথচ রাশিচক্রে আপনার বিশ্বাসই নেই, কেন?

ক্যাটোন: স্বর্গের সত্যিকার চিত্র বহুলাংশে নির্ভর করে রাশিচক্রের গতিশীল অংশের ওপর। প্রথমত, এর অক্ষাংশাভিমুখ অবস্থান, যা থেকে আপনি তারার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করছেন। আর দ্বিতীয়ত, সাতটি গ্রহের অবস্থান—সার্বিক চিত্রের ওপর যার প্রত্যেকটির রয়েছে সুনির্দিষ্ট প্রভাব। আমি প্রায়ই আমার জীবনের ঘটনা নিয়ে অনলাইনে চার্ট তৈরি করি (দ্য লুমিনারিস-এর জন্যও একটা করেছিলাম, যেটা ছিল সিংহ রাশির জাতক, সঙ্গে ছিল কুম্ভ, যা কিনা বিকশিত হচ্ছিল)। তবে সংবাদপত্রের রাশিচক্র আমি খুব বেশি একটা অন্তর্ভুক্ত করিনি।

প্রশ্ন: নিউজিল্যান্ডের অ্যান্টি-ইন্টেলেকচুয়ালিজমের ব্যাপারে অতীতে আপনি খেদ প্রকাশ করেছেন। আমাদের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপারটিকে কি আপনার অপ্রীতিকর পরিণাম বলে মনে হয়?

ক্যাটোন: হ্যাঁ, আমার সে রকমই মনে হয়। আর এটা হচ্ছে আমাদের আকৃতির ফসল। ছোট্ট একটা দেশ কখনো ‘সর্বাধিক’ বা ‘সর্ববৃহৎ’ হতে পারে না। পত্রিকার শিরোনাম হওয়ার জন্য তাকে হতে হবে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ বা ‘প্রথম’। ক্রীড়া কোনো জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে দেয়, আমাদের অনেক জাতীয় বীরই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রথম। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা সে রকমভাবে কাজ করে না। পরিবর্তনটা এখানে আসতে পারে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই পরিবর্তন একদিন সংঘটিত হবে।

প্রশ্ন: বুকার পাওয়ার পর দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও কেরি হালমি এখনো দ্বিতীয় উপন্যাস লিখে উঠতে পারেননি। ওই ধরনের চাপের কথা কি আপনি ভাবতে পারেন?

ক্যাটোন: লেখালেখির বিষয়টা আমার কাছে খুবই শক্তিদায়ী একটা ব্যাপার। বিশ্বকে ক্রমাগ্রসর করতে, নিজের সম্পর্কে একটা সচেতনতা তৈরি আর সুখী হতে এটা আমাকে সহায়তা করে। লেখালিখি পরিত্যাগ করার কথা কল্পনাও করতে পারি না। তবে এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে কখনো কখনো সব ধরনের আমন্ত্রণ ও অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার ভাবনা আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।

প্রশ্ন: আধুনিক জীবনের সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপারগুলো কী?

ক্যাটোন: যোগাযোগে সক্ষম থাকতে পারা। সম্পর্ক ফসকানো, মিথ্যা অনুমান আর ভ্রান্ত পরিচিতি, যা অনেক ভালো গল্পের জন্ম দেয়।



এলিনোর ক্যাটোন

জন্ম ১৯৮৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। স্কুলের পাঠ নেন বার্নসাইড হাইস্কুলে। নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ক্যান্টারবারিতে ইংরেজি সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা শেষ করে ওয়েলিংটনের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব মডার্ন লেটার্স থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিংসে মাস্টার্স করেন ২০০৮ সালে। মাস্টার্সের অভিসন্দর্ভ হিসেবে রচনা করেন দ্য রিহারসাল। এটি তাঁর প্রথম উপন্যাস। পরে এটি ট্রাস্ক পুরস্কারে ভূষিত হয়।

ক্যাটোন ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছেন দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য লুমিনারিস-এর জন্য। বইটির পটভূমি ১৮৬০ সালের গোল্ডরাশের সময়কালে নিউজিল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের প্রত্যন্ত নিষিদ্ধ এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি হত্যারহস্য। ২৮ বছর বয়সী ক্যাটোন বর্তমানে সেন্ট্রাল অকল্যান্ডে বসবাস করছেন। ম্যানুকাউ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াচ্ছেন ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিষয়ে।

No comments

Powered by Blogger.