রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- নোবেলজয়ের শতবর্ষ by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলপ্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে এ বছরের ১০ নভেম্বর। গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য তিনি বয়ে এনেছিলেন এই দুর্লভ সম্মান।
ইতিহাসের সেই হিরণ্ময় মুহূর্তের দিকে ফিরে তাকাতেই এ লেখা

এ বছর—২০১৩—গীতাঞ্জলির শতবর্ষপূর্তি উদ্যাপিত হয়েছে। আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে ১৯১৩ সালে, সুইডিশ একাডেমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। পুরস্কার দেওয়া হয় কবির স্বকৃত গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের জন্য। এই ইংরেজি অনুবাদটি প্রসঙ্গে আমরা যা জানি, তার ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, এটি যে আদৌ সম্পন্ন হয়েছিল, সেটাই বিস্ময়কর! কথা ছিল, রবীন্দ্রনাথ বিলেতে যাবেন ১৯১২ সালে, মার্চ মাসে। কিন্তু যাওয়ার আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রয়োজন হলো বিশ্রাম গ্রহণের। বিশ্রামের জন্য তিনি চলে এলেন শিলাইদহ। অসুস্থতা ও বিশ্রাম নেওয়ার সময় একটা হালকা ধরনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই শুরু করলেন নিজের কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ। বেছে নিলেন গীতাঞ্জলি। তবে কেবল এ কাব্যের মধ্যে আবদ্ধ রইলেন না তিনি। গীতাঞ্জলি থেকে গৃহীত ৫৩টি কবিতার পাশাপাশি ১৬টি কবিতা নিলেন গীতিমাল্য থেকে, ১৫টি নৈবেদ্য, ১১টি খেয়া, ৩টি শিশু থেকে, এবং কল্পনা, স্মরণ, চৈতালি, উৎসর্গ ও অচলায়তন (নাটক) থেকে নিলেন একটি করে কবিতা। সুতরাং নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতাঞ্জলির মোট ১০৪টি কবিতার অর্ধেক মাত্র—৫৩টি, গীতাঞ্জলি থেকে নেওয়া। গ্রহণ-বর্জন বিষয়ে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ নিজে কিছু বলেননি। অনুবাদগুলো শেষ পর্যন্ত কারা পড়বে, বা পড়ার পর কীভাবে নেবে, সে বিষয়ে ওই সময়ে কতটুকুই বা জানতেন তিনি!

কয়েক মাস বিশ্রাম নেওয়ার পর যখন তিনি জাহাজে উঠলেন এবং জুন মাসের ২ তারিখ বিলেতে পৌঁছালেন, তাঁর অনুবাদকর্ম তখনো চলছিল। বিলেতে কোথায় উঠবেন, তারও স্থিরতা ছিল না। এর আগের বছর কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রোদেনস্টাইনের। স্যার উইলিয়াম রোদেনস্টাইন ছিলেন বিলেতের শিল্পী-সাহিত্যিক মহলে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে রবিঠাকুরের যোগাযোগ তাঁর নোবেলপ্রাপ্তিতে যে বড় ভূমিকা রেখেছিল, এতে সন্দেহ নেই। লন্ডনে পৌঁছে তাঁকেই খবর দিলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে করে আনা সদ্য রচিত অনুবাদগুলো তুলে দিলেন তাঁর হাতে।

এই অনুবাদকর্মের গুরুত্ব অনুধাবন করতে একটুও ভুল করেননি রোদেনস্টাইন। তিনি তৎকালীন সাহিত্যজগতের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে কবির সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করলেন। ওই বৈঠকে আইরিশ কবি ইয়েটসের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এরপর ইয়েটসের হাতে যখন পড়ল অনুবাদগুলো, তিনি এতটাই অভিভূত হলেন যে ওই বাঙালি কবিকৃত ইংরেজি অনুবাদ সংস্কার বা সংশোধনের কোনো কারণই খুঁজে পেলেন না। অথচ অনুবাদগুলো তাঁকে দেওয়া হয়েছিল সংস্কার-সংশোধনের জন্যই। সামান্য দু-একটি ভাষাঘটিত সংশোধন ছাড়া ইয়েটস কবির অনুবাদে আর কোনো কিছু করার দরকার বোধ করেননি।

কথাটার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই তাঁর অনুবাদ আসলেই কতটা তাঁর এবং এতে অন্যের হাত কতটা—এসব নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য চেয়েছিলেন, এমন একজন তাঁর অনুবাদ দেখে দিন, ইংরেজি যাঁর মাতৃভাষা। নিজের ইংরেজি ভাষাজ্ঞান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের খুব বড় ধারণা ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, ইয়েটসের মতো কবি অকুণ্ঠ স্বরে রায় দিলেন, গত ১০ বছরে তিনি ইংরেজি ভাষায় এমন রচনা দেখেননি। ইয়েটস এর পর যেখানেই গেছেন, তাঁর সঙ্গে থেকেছে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের খাতা। অনুবাদগুলো পড়ে তাঁর মনের উত্তেজনার কথা নিজেই বলেছেন তিনি। এ যেন এক নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের আনন্দ ও উত্তেজনা। পাছে কেউ তাঁকে দেখে মনের উত্তেজনা বুঝে ফেলে, সে জন্য তিনি থেকেছেন সদা সতর্ক; ট্রেনে-বাসে ভ্রমণের সময় তাঁর হাতের খাতাটিকে আড়াল করেছেন অন্যের কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে।

এরপর অনুবাদগুলোর সীমিতসংখ্যক কবিতা প্রকাশ করে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি। এবং অল্প দিন পর ম্যাকমিলান থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয় অনুবাদগুলো। সেটা ১৯১৩ সালের ঘটনা। বছর শেষে দেখা গেল, এর মধ্যেই ১৩ বার ছাপতে হয়েছে বইটি। আর এ বছরের শেষেই নোবেল পুরস্কারও পেলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর নিজের গদ্যে রচিত গীতাঞ্জলির জন্য।

রবীন্দ্রনাথের সম্মানে রোদেনস্টাইন যে কাজটি করে দিলেন, তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ইয়েটসের নেতৃত্ব ১৯১২ সালের জুলাই মাসে লন্ডনের ট্রোকাডেরো রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠিত নৈশভোজ, যেখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন কমবেশি ৭০ জন সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। এই নৈশভোজে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ইয়েটস। বলা হয়, এই নৈশভোজই রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পথে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। উদ্দেশ্য ছিল, রবীন্দ্রনাথকে বিলেতের সুধীমহলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছিল। এর পরই কথা হয়েছিল, নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব প্রসঙ্গে। সে কাজও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন রোদেনস্টাইন ও ইয়েটস।

ইতিপূর্বে আরও কয়েকটি নৈশভোজ ও রবীন্দ্রনাথের কবিতাপাঠের আয়োজন হয়েছিল। তবে ৭০ জনের উপস্থিতিতে যে নৈশভোজ, এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি রোদেনস্টাইন বা ইয়েটসকে।

কবিকে কেন্দ্র করে লন্ডনে তাঁর গুণগ্রাহীদের যত আয়োজন, এতে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণ ছিল যতটা না নিজের কবি-পরিচয়কে তুলে ধরতে, তার চেয়ে বেশি পশ্চিম জগতের কাছে তাঁর দেশ ও সে দেশের দর্শনভাবনাকে তুলে ধরার জন্য। ভারত সম্পর্কে পশ্চিমের যে অজ্ঞতা ও অবহেলা, এর অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পুরস্কার পাওয়ার পরে তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন এবং যতবার বিদেশে গেছেন, এই একই উদ্দেশ্যকে মনে রেখে বারবার বলেছেন ও লিখেছেন।

প্রাচ্য প্রাচ্যই, প্রতীচ্য প্রতীচ্যই, দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান—এই ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণেই তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে আমন্ত্রণ জানান পশ্চিম জগতের সুধীদের। পশ্চিম যদি আজ ভারতকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে থাকে, তবে এর পেছনে রবীন্দ্রনাথের অবদান কত বেশি, বলে শেষ করা যাবে না। প্রসঙ্গত একজন পশ্চিমা মনীষীর কথা মনে পড়ে। কবিকে বলেছিলেন, ইউ আর দ্য রিজন ইন্ডিয়া শুড বি ফ্রি—তোমার জন্যই ভারতের স্বাধীনতা সবার কাম্য। রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব ও ভারতের দাসত্ব—এই বাস্তবতা গ্রহণযোগ্য নয়।

রাজনৈতিক বাস্তবতা যা-ই হোক, বিলেত দেশটিকে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। মহৎ প্রাণ ও মহোদয় ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছেন। দেশে তিনি অনেক ছোট ইংরেজ দেখেছেন, আর বিলেতে দেখেছেন বড় ইংরেজ—তাঁদের ভক্তি-ভালোবাসার মূল্য দিয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবিকে যে সম্মাননা দেওয়া হয়, তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন বড় লাট। দেশবাসীর সম্মাননায় কবি প্রীত হননি। এর সবটা খাঁটি ছিল না বলে তিনি জানতেন। তবে নোবেলপ্রাপ্তির পর তাঁর আশা ছিল, এরপর বিশ্বভারতী গড়ার কাজে পশ্চিমের সহায়তা আসবে। রবীন্দ্রনাথের এই আশা পুরোপুরি মেটেনি। বিশ্বভারতী নিয়ে আমৃত্যু দুর্ভাবনা ছিল তাঁর। সে দুর্ভাবনার ইতি ঘটালেন তাঁরই অত্যন্ত গুণগ্রাহী জওহরলাল নেহরু। বিশ্বভারতীর দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে এল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। তবে এ জন্য বিশ্বভারতীকে চড়া দামও দিতে হলো—রবীন্দ্রনাথের কল্পনার বিশ্বভারতী ও ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী এক নয়। তবু বিশ্বভারতী আছে—‘রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি’ এই পরিচয় নিয়েই আছে। আজ ভারতের বাইরে থেকে যিনিই এ দেশে আসুন না কেন, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি শান্তিনিকেতনে না এলে তাঁর ভারত আগমন সম্পূর্ণ হয় না। নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি গীতাঞ্জলি প্রকাশের পর ১০০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তাঁর নোবেলজয়ের শতবর্ষও উদ্যাপিত হতে চলেছে। আমরা একে সমগ্র বাঙালি সমাজের জন্য একটি স্মরণীয় ঘটনা মনে করি।

No comments

Powered by Blogger.