রাজনীতি- রহস্যাবৃত পালাবদলের পালা! by মলয় ভৌমিক

তবে কি সাধারণ মানুষ রহস্যাবৃতই থেকে যাবে? একদিকে মানুষের জীবন যাচ্ছে, চলছে নজিরবিহীন পরিকল্পিত উগ্র সহিংসতা, অন্যদিকে পালাবদল নিয়ে বিস্তৃত হচ্ছে রহস্যের জাল।
মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেতাদের কাছ থেকে মানুষ জানতে পারছে না কী ঘটতে যাচ্ছে। কখনো মনে হয় নেতা-নেত্রীরাও জানেন না আগামীকাল কী ঘটবে। গণতন্ত্রের জন্য এর থেকে নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে?

সংবিধানে ক্ষমতা হস্তান্তরের দুটি বিকল্প প্রক্রিয়া আছে। একটি হলো, সংসদ বহাল রেখে সংসদের মেয়াদ শেষের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন। অন্যটি, সংসদের মেয়াদ শেষে বা সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন। সরকার প্রকৃতপক্ষে এর কোন বিকল্পটি গ্রহণ করছে, তা অস্পষ্ট। যদিও সরকার বলছে প্রথম বিকল্পের কথা। তাই যদি হয়, তাহলে নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গণনা কবে থেকে শুরু হবে, ২৭ অক্টোবর থেকে, না নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন থেকে—সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা নেই। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের রুটিন কাজ কী হবে এবং এ সময় নির্বাচন কমিশনের হাতে কী ধরনের ক্ষমতা থাকবে, তা-ও বলা হলো না। অর্থাৎ ব্যাপারটা একটা রহস্য হয়েই থাকল। আর যদি বলা হয়, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থার হেরফের হতে পারে ভেবেই এই নীরবতা, তাহলে সে কথা সরাসরি বলে দিতে অসুবিধা কোথায়? মানুষ তো আলোচনাকে স্বাগত জানিয়েছে।
দুই নেত্রীর আলোচনা নিয়েও ইতিমধ্যে রহস্য ঘনীভূত হতে শুরু করেছে। আলোচনার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। টেলিফোনে দুই নেত্রী কথা বলার পরপরই সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা মন্তব্য করেছেন, ‘ফোনালাপ ইতিবাচক, তবে লোক দেখানো (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর)’। শরিক দলের অপর নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘সংলাপ হবে, তবে ফলাফল বলতে পারি না (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর)’। এদিকে ২৮ অক্টোবর বেলা ১১টায় নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আলোচনার নামে সরকার নাটক করছে। সংলাপের ফলাফলের ব্যাপারে সরকারের শরিক দল এবং প্রধান বিরোধী দলের মধ্যেই যখন কোনো আশাবাদ নেই, তখন সাধারণ মানুষ যে এ ব্যাপারে আরও বেশি গোলকধাঁধায় পড়ে গেল। সংলাপ নিয়ে সর্বশেষ খবর হলো, এখন আবার নতুন করে কে কাকে ফোন করবেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে বাহাস।
সংলাপ-পর্বের কদিন আগে থেকে এখন পর্যন্ত (২৮ অক্টোবর) ঘটনাপ্রবাহ খেয়াল করলে মানুষ কেন ধাঁধায় পড়েছে তা স্পষ্ট হবে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হলো, ২৫ অক্টোবর থেকে সরকার অবৈধ। পরে কথা পাল্টে ২৭ অক্টোবর থেকে সরকার অবৈধ বলা হলো। বিরোধী দলের বাঘা বাঘা লোকজনের হিসাবের এই গরমিল সাধারণের কাছে বোধগম্য নয়। আবার প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবের পাল্টা প্রস্তাবে বিরোধীদলীয় নেতা সাবেক ২০ উপদেষ্টার সমন্বয়ে নির্দলীয় সরকারের তত্ত্ব সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরে বললেন, বর্তমান সংবিধানের মধ্যে থেকেই তাঁর (বিরোধীদলীয় নেতার) প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব। অথচ সংবিধান বিশ্লেষকেরা বললেন, বিরোধী দলের নেতার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আগের দুই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার বিষয়ে বলা হলো, বিরোধী দল যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেনি। বিরোধী দল যে দাবিতে দীর্ঘদিন হলো আন্দোলন করছে, সে ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট হোমওয়ার্ক নেই—তা কিন্তু সাধারণের ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। ফলে উল্টোপাল্টা এসব কথা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বর্তমান সরকার অবৈধ হলে সংসদও অবৈধ হয়। তাহলে বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন কীভাবে হওয়া সম্ভব, সে প্রশ্নও উঠছে। ‘সরকার অবৈধ’—এ মন্তব্য রাজনৈতিক হতে পারে। কিন্তু সাংবিধানিক বিষয়কে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা হলে জনগণ বিভ্রান্ত হয় এবং রাষ্ট্র পরিচালনার এই মূল দলিলের ব্যাখ্যার ব্যাপারে অস্পষ্টতা বাড়তে থাকে।
২৫ অক্টোবর ১৮ দলের জনসভা নিয়েও উল্টোপাল্টা কম হলো না। সরকার প্রথমে বলল, কিছুতেই সভা করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভার অনুমতি দেওয়া হলো। ১৮ দলও প্রথমে দৃঢ়তার সঙ্গে জানাল, তারা নয়াপল্টনে সভা করবেই। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সভা করল। সে সভার সামগ্রিক চেহারা নিয়েও মানুষ কম বিভ্রান্ত নয়। সেখানে বক্তাদের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের, অথচ ব্যানার-ফেস্টুনের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি। এই প্রেক্ষাপটে বিরোধীদলীয় নেতা ‘ক্ষমতায় গেলে সব রাজবন্দীকে মুক্ত করে দেওয়া হবে’ বলে বিষয়টি আরও বেশি ধোঁয়াটে করে ফেললেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিরোধীদলীয় নেতার দুই দিনের আলটিমেটাম নিয়ে কম রহস্যের সৃষ্টি হয়নি। কয়েক দিন আগে থেকে বলা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপে বিলম্ব, বিরোধী দলের নেতার লাল ফোন ‘বিকল’ থাকা এবং কে কাকে প্রথমে ফোন করবেন, তা নিয়ে উভয় পক্ষের ভিন্ন ভাষ্যের রহস্যকেও ছাপিয়ে যায় হরতাল প্রত্যাহার না করার রহস্যটি। ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করেছিলেন বিরোধী দলের নেতার বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই। ফোনে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে হরতাল প্রত্যাহার করে ২৮ অক্টোবর গণভবনে এসে আলোচনা শুরু করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রী যদি এই আহ্বান না-ও জানাতেন, তবু বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর নিজের দেওয়া শর্ত অনুযায়ীই হরতাল প্রত্যাহার করে নেবেন, এটাই ছিল প্রত্যাশা। এ ছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানও করেননি, ২৯ অক্টোবরের পর যেকোনো দিন আলোচনায় বসবেন বলেছেন। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কোন বিশেষ কারণে তিনি নিজের দেওয়া শর্ত ভঙ্গ করে হরতাল অব্যাহত রাখলেন? বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বিলম্বে ফোন করায় ১৮ দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে হরতাল প্রত্যাহার করার মতো যথেষ্ট সময় হাতে ছিল না।
বাংলাদেশ হরতালের দেশ। কিন্তু অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সাম্প্রতিক হরতালের চিত্র ভিন্ন। হরতালের আগে এমন পরিকল্পিত বলপ্রয়োগ, বোমা-ককটেলবাজি ও অগ্নিসংযোগ মানুষ কখনো দেখেনি। এসব সহিংসতার সঙ্গে আগুনে ঘি ঢালার মতো যুক্ত হলো জনৈক বহুরূপী বুদ্ধিজীবী কর্তৃক গণমাধ্যমে হামলা চালানোর প্রকাশ্য উসকানি।
যেমন ব্যবস্থাই হোক না কেন, সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন দেশের মানুষ চায়। জনগণের এই মনোভাব ১৮ দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির মূল মর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ছাড়া তারাই তো দাবি করছে বিভিন্ন ‘জরিপ’ অনুযায়ী দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চায়। তাহলে এই দাবিতে হরতাল করতে গিয়ে এমন নজিরবিহীন জবরদস্তি করা কেন? হরতালে তো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনই পাওয়ার কথা। ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় ১৮-দলীয় নেত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব পেশার মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে বলেছেন। কিন্তু তাঁদের কর্মীদের এমন বেপরোয়া বোমা-ককটেলবাজি আর অগ্নিসংযোগের শঙ্কার মধ্যে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে কি?
সবাই জানে, বলপ্রয়োগ হলো দুর্বলের অস্ত্র। যুক্তি ও সত্যের খেই যখন হারিয়ে যায়, তখনই পেশিশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১৮ দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির মধ্যে যুক্তি ও সত্যের অভাব কোথায়? তাহলে এই বলপ্রয়োগের পেছনে ১৮ দলের মধ্যে অন্য কারও ভিন্ন স্বার্থ আছে কি? তা থেকে থাকলে অন্য দলগুলো তার দায় নেবে কি? মানুষ যখন আসল দাবি কোনটি, তা নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে থাকবে, তখন দীর্ঘ মেয়াদে তার মাশুলটা হয়তো অন্য দল, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলকেই দিতে হবে।
দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি মিত্রদের অতি উৎসাহও মানুষকে অস্বস্তিতে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউর পর এবার জাতিসংঘ, চীন, জাপানও নাক গলাচ্ছে। ড্যান মজীনা প্রায় প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে এলেন। বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে মতপার্থক্যের খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।
প্রতিদিন ঘটনার বাঁক পরিবর্তন হচ্ছে। গুজব, বিভ্রান্তি, রহস্যের পাশাপাশি সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে, প্রাণহানি ঘটছে। মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। জাদুকর যেমন তার লক্ষ্য হাসিলের জন্য মানুষকে বিভ্রান্তির জালে জড়িয়ে ফেলে, তেমনই দেশের মানুষও যেন জাদুকরের কারসাজিতে এখন সম্মোহিত। এই অবস্থায় দুই নেত্রীর প্রতি আহ্বান, আপনারা বসুন। নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করুন। অদৃশ্য জাদুকরের কারসাজি কারও কাছেই কাম্য নয়।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।

No comments

Powered by Blogger.