পররাষ্ট্রনীতি ও দেশের ভাবমূর্তি by মুহাম্মদ রুহুল আমীন

অদক্ষ জনবল, ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান, ভ্রান্ত কূটনীতি, অপর্যাপ্ত গবেষণা, লক্ষ্যহীন প্রাধিকার, সর্বোপরি বিপর্যস্ত ভাবমূর্তি ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশে বৈদেশিক সম্পর্কের শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে উঠতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চললেও এখনও আমরা বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও ক্রিয়াশীল উপাদানগুলোকে (ধপঃড়ৎং) যেমন চিহ্নিত করতে পারিনি, তেমনি পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নির্ধারণ করতেও ব্যর্থ হয়েছি। কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি বা বৈদেশিক সম্পর্কের মূল লক্ষ্য হল, দেশটির সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। কোনো দেশ তার রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ অর্জনের জন্য বজ্র পররাষ্ট্রনীতি (হার্ড ফরেন পলিসি) গ্রহণ করে থাকে। আবার অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ অর্জনের জন্য ওই দেশই নম্র পররাষ্ট্রনীতি (সফ্ট ফরেন পলিসি) অনুসরণ করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে নম্র বিষয়গুলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ নম্র পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জিত হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বজ্র পররাষ্ট্রনীতি অর্জিত হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের ওপর সমধিক গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পররাষ্ট্রনীতি প্রণীত হয়। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক দৈন্যের কারণে সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক উৎস থেকে প্রত্যাশিত ও প্রতিশ্র“ত সাহায্য প্রাপ্তিতে চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। এমন এক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী, মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য বৈদেশিক উৎস থেকে সাহায্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
সামরিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটের যুগসন্ধিক্ষণে সরকার ও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে তিনি রক্ষণশীলতার পরিবর্তে পররাষ্ট্রনীতির বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়া প্রণয়ন করেন। সমাজতান্ত্রিক সূত্রসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য দাতা দেশ থেকে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপরও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। ফলে স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমাদের অন্তর্মুখী দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা নিয়ে এসেছিল, তা বিদূরিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ বহির্মুখী উন্নয়নকেন্দ্রিক শিল্পায়নের পথে অগ্রসর হয়। জিয়ার বৈশ্বিক অন্তর্দর্শন পররাষ্ট্রনীতিতে বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তিত বাস্তবতায় জিয়া উপলব্ধি করেন, নিছক স্নায়ুযুদ্ধকালীন সামরিক-রাজনৈতিক শত্র“তার উপলব্ধি থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খণ্ডিত কোনো অংশের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা করলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে শক্তিশালী করা দুরূহ হবে। সেজন্য তিনি উদীয়মান বৈশ্বিকতার (এমার্জিং গ্লোবালিটি) প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্তর্নিহিত কাঠামোতে তা অন্তর্ভুক্তির কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি অর্থনৈতিক কূটনীতির ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রগতিমুখী ধারা প্রবর্তন করেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এরপর আর বৈদেশিক সাহায্যের ওপর স্থবির হয়ে পড়ে না থেকে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। শিল্প-কারখানা ব্যাপকভাবে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে তিনি উন্মুক্ত কূটনীতি শুরু করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে যে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তা জিয়ার বহুমুখীকরণ নীতির কারণে দূর হতে থাকে। ধীরে ধীরে বিদেশে দেশের সুউচ্চ ভাবমূর্তি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করে। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বে আমাদের নব-অর্জিত মর্যাদা সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক কূটনীতির নবদিগন্তের সূচনা করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিরলস পরিশ্রম করে এমনভাবে বৈদেশিক শ্রমবাজারের সম্ভাবনা জাগরিত করে, যা পরে বাংলাদেশের জিডিপির সিংহভাগ দখল করে নেয়।
জিয়া-পরবর্তী শাসনকালে আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির ধারা চালু রাখার নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বিভিন্ন কারণে আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ক জোরদার হয়নি। এক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি বারবার সামনে চলে এসেছে। আশির দশকের সামরিক শাসনের পর নব্বইয়ের দশক থেকে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নবতর যাত্রা শুরু হলেও পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন গতিময়তা পরিলক্ষিত হয়নি। রাজনীতিক, রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক আদর্শের মতভিন্নতা আমাদের জাতীয় ঐক্যকে ঠুনকো ও নড়বড়ে করে দেয়, যে কারণে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ঐক্য ধরে রাখতে আমরা ব্যর্থ হই। পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ঐক্য ও অবিভাজনের ধারণা ও প্রত্যয়ের প্রয়োজন ছিল, তা কখনও বাস্তবায়িত হয়নি। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও নিপুণতার চেয়ে দলীয় বিবেচনার অগ্রাধিকারই লক্ষ্য করা গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত নিয়োগের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোও হীন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। ফলে পররাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলাদলি পররাষ্ট্রনীতিকে গ্রাস করার ফলে বিদেশে এক ধরনের নেতিবাচক ভাবমূর্তির সৃষ্টি হয়। তাছাড়া গণতন্ত্রায়ন, মানবাধিকার, সংখ্যালঘু প্রভৃতি ইস্যুতে আমাদের ক্রমক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ও হঠকারী নীতি বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে মারাত্মকভাবে। আমাদের ভাবমূর্তি বিপর্যয়ে পড়ার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতি-ষড়যন্ত্র, শেয়ারবাজার ও ব্যাংক কেলেংকারি, তাজরিন গার্মেন্ট ও রানা প্লাজার ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জিএসপি বাতিল, রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিচারবহির্ভূত খুন-গুম, সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনৈতিক দলন-পীড়ন প্রভৃতি অভ্যন্তরীণ ইস্যু আন্তর্জাতিক বলয়ে আলোড়িত-আন্দোলিত হয়ে বাংলাদেশের এমন এক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছে, যা আমাদের বৈদেশিক লক্ষ্যগুলো অর্জনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে পুনঃশক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে আমাদের বৈদেশিক ইস্যু এবং পররাষ্ট্র সম্পর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলোর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। এ ব্যাপারে প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হল, আমাদের বিপর্যস্ত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। সব ধরনের দলাদলি ও মতপার্থক্য সত্ত্বেও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতি ও কৌশল গ্রহণ করা সময়ের দাবি। পররাষ্ট্রনীতি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিনিয়ত গবেষণা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক, অধ্যাপক, পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সংঘ (অ্যাডভাইজারি সেল) গঠন করা যেতে পারে। পররাষ্ট্রিক ইস্যুগুলোতে প্রতিনিয়ত সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে আলোচনা-পর্যালোচনা করে যোগ্য, ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ উন্মুক্ত রাখা উচিত। বিশ্বায়নের এ যুগে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার অবারিত সম্ভাবনা জাগরিত রাখতে প্রত্যেক নাগরিক বিশেষ করে বৈদেশিক বলয়ের সবাইকেই শুভেচ্ছাদূতের ভূমিকায় সর্বদা তৈরি থাকতে হবে। আমাদের সঙ্গীতশিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সর্বোপরি সব নাগরিককে নিজ নিজ স্থানে থেকে এমন শুভেচ্ছাদূতের ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে আমরা ভাবমূর্তি বিপর্যয় কাটিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিনিয়ত সাফল্য অর্জন করতে পারি।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.