আক্রান্ত হলে জবাব দেবে সিরিয়া - সিরিয়া পরিস্থিতি: সর্বশেষ

সিরিয়ায় আগ্রাসী হামলা চালানো হলে তার যথোপযুক্ত জবাব দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডন থেকে পাওয়া সব তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সিরিয়ায় সামরিক হামলা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
হামলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। কোথায় কোথায় হামলা চালানো হবে তা-ও ঠিক করা হয়েছে। উপযুক্ত স্থানে বসানো হয়েছে পশ্চিমাদের সমরাস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী তাদের কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ আগের অবস্থান থেকে সরিয়ে স্থাপন করেছে অন্য স্থানে। এর মধ্যে রয়েছে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ। এগুলো স্থাপন করা হয়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সক্ষম বৃটিশ ট্রাফালগার সাবমেরিন স্থাপন করা হয়েছে। এতেও যদি সিরিয়াকে কাবু করা সহজ না হয় তাহলে আকাশপথে হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ গিয়ে যোগ দেবে অভিযানে। ব্যবহার করা হবে তুরস্ক ও সাইপ্রাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্থল ঘাঁটি। এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে ফরাসি বিমান বাহিনী। কিন্তু কি ধরনের সামরিক হামলা করা হবে? তাতে ঝুঁকি কতটুকু? এমন হামলার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতটুকু? এসব নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। ওদিকে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রথম দিককার একটি উদ্যোগ থামিয়ে দিয়েছে বৃটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী এমপিরা। গতকাল ফের সিরিয়ায় হামলা চালানো নিয়ে বৃটিশ এমপিদের মধ্যে বিতর্ক হওয়ার কথা। এ নিয়ে দৃশ্যত বৃটিশ রাজনীতিকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে জড়িয়েছেন। কিন্তু তার যে ফল তা থেকে সরকার বা রাজনীতিকরা কোন শিক্ষা নেননি। একই দিনে হোয়াইট হাউস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র কংগ্রেস সদস্যদের সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফিং করার কথা রয়েছে। যে গৌটা শহরে সিরিয়া সরকার রাসায়নিক অস্ত্র হামলা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ পরিদর্শকদের সে স্থানটি পরিদর্শন করে তাদের তদন্ত সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন মহাসচিব বান কি মুন। এ তদন্তে তাদের আজকের দিন লাগতে পারে। ফলে তারা আগামীকাল সিরিয়া ত্যাগ করতে পারবেন। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা নিশ্চিত সিরিয়ার ওই জনসাধারণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ছাড়া হয়েছিল। এর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সিরিয়ার বিরুদ্ধে কোন অভিযান চালানোর নির্দেশ দেননি। হামলা চালানো হলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছে সিরিয়া। তারা বলেছে, পশ্চিমারা সিরিয়ায় হামলা করার জন্য একটি অজুহাত খুঁজছে এবং এমন হামলা করা হলে তাদেরকে কড়া জবাব দেয়া হবে। এ বিষয়ে বৃটিশ হাউজ অব কমন্সকে একটি চিঠি দিয়েছেন সিরিয়ার পার্লামেন্টের স্পিকার। এতে তিনি বলেছেন, আগ্রাসন চালানো হলে এবং যুদ্ধে প্ররোচনা দেয়া হলে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। এতে তিনি আরও লিখেছেন, যুক্তরাজ্য যে আল কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই করছে সিরিয়াও সেই অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে। সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলা চালানো হলে তাতে স্বাভাবিকভাবেই শক্তিশালী হবে আল কায়েদা। ওদিকে লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে পিটার ওবোর্ন লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও প্রেসিডেন্ট ওবামা দু’জনেই অতি সজ্জন। তা সত্ত্বেও ইরাক আগ্রাসন থেকে কিছুই শেখেনি লন্ডন ও ওয়াশিংটন। তারা সেই একই রকম তথ্যপ্রমাণ দেখাচ্ছে সিরিয়ার ক্ষেত্রেও। একই রকম মত দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের গ্রিন এমপি ক্যারোলাইন লুকাস। ওদিকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানো যাবে কিনা তা নিয়ে গতকাল বৃটিশ এমপিদের মধ্যে ভোটাভুটি হওয়ার কথা। জাতিসংঘ তদন্ত দল সিরিয়ায় যে তদন্ত চালাচ্ছে সে বিষয়ে প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার আগে পর্যন্ত হামলা না চালানোর পরামর্শ আগেই দিয়েছেন লেবার পার্টির এমপিরা। গতকালের ভোটাভুটিতেও তারা হামলা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রায় দেবেন বলে আভাস দেয় বৃটিশ মিডিয়া। লেবার দলের সমর্থন না পেলে ডেভিড ক্যামেরন সামরিক হামলা চালাতে পারেন না। শুধু তা-ই নয়। এক্ষেত্রে ক্যামেরনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন তার নিজ দলের কিছু এমপি-ও। এরই মধ্যে সিরিয়াকে ঘিরে সমরাস্ত্র সাজিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের চারটি ডেস্ট্রয়ার। এগুলো হলো- ইউএসএস গ্রেভলি, ইউএসএস রামেজ, ইউএসএস বেরি ও ইউএসএস মেহান। এগুলো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত। সাবমেরিন থেকেও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হতে পারে। এ অভিযানে বৃটেনের একটি ট্রাফালগার সাবমেরিন অংশ নিতে পারে। সপ্তাহান্তে এইচএমএস টায়ারলেস-কে দেখা গেছে জিব্রালটারে। তুরস্কের ইনকিরলিক এবং জর্ডানের ইজমিরের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করা হবে। যুদ্ধবিমানবাহী ইউএসএস নিমিৎজ ও ইউএসএস হ্যারি এস ট্রুম্যান রয়েছে ওই অঞ্চলে। তবে তা একটু দূরে অবস্থান করছে। সাইপ্রাসে রয়েছে যুক্তরাজ্যের আরএএফ আকরোতিরি বিমানঘাঁটি। পশ্চিম ভূমধ্য সাগরে অবস্থান করছে ফ্রান্সের যুদ্ধবিমানবাহী সার্ল দ্য গল। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছে ফ্রান্সের রাফায়েল ও মিরেজ যুদ্ধবিমান। এখন ওবামার সিদ্ধান্ত পাকা হলেও হামলা হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে হামলা কি স্বল্প সময়ের জন্য হবে নাকি দীর্ঘমেয়াদি পুরোপুরি যুদ্ধ হবে তা নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রাজনীতিকরা। কেউ কেউ বলছেন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামাতে স্থল অভিযানও পরিচালনা করা উচিত। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এক্ষেত্রে ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন। ওদিকে সিরিয়ার সরকারকে কাবু করতে পশ্চিমারা সিরিয়ার আকাশকে নো ফ্লাই জোন বা উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণার দাবি জানাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু সে দাবি বার বার নাকচ হয়ে গেছে। এ দাবি মেনে নেয়া হলে সিরিয়া সরকার বিদ্রোহীদের ওপর আকাশপথে কোন হামলা চালাতে পারবে না। এছাড়া, সিরিয়ার ভিতরে বাফার জোন গড়ে তোলার বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। তুরস্ক ও জর্ডানের সীমান্তের কাছে বিদ্রোহীদের জন্য এমন একটি এলাকা গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে, যেখান থেকে তারা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারবে। কিন্তু সে এলাকায় যদি সরকার স্থলপথে হামলা চালায় তাহলে কি হবে তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
সিরিয়ার প্রস্তুতি: পশ্চিমাদের সম্ভাব্য হামলার বিরুদ্ধে সিরিয়া কতখানি দাঁড়াতে সক্ষম? দৃশ্যত সিরিয়ায় হামলা চালানো হবে দূরে অবস্থানরত যুদ্ধজাহাজ অথবা সাবমেরিন থেকে। এক্ষেত্রে সিরিয়া প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দুর্বল হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে আকাশপথে সিরিয়াকে কাবু করা অনেক কঠিন। কারণ, তার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী। সাবেক সোভিয়েত আমলের অস্ত্র রয়েছে এখন সিরিয়ার হাতে। এর মধ্যে আছে এস-২০০/এসএ-৫ গ্যামোন, এসএ-২২, এসএ-১৭। চীনের দেয়া বেশ কিছু অত্যাধুনিক রাডার রয়েছে সিরিয়ার কাছে। এগুলো ব্যবহার করে আকাশপথের হামলাকে প্রতিহত করা যেতে পারে। সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বেছে নিয়েছে নৌপথকে। কিন্তু এপথেও তাদেরকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি পড়তে হতে পারে। কারণ, যুদ্ধজাহাজের ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী ব্যবস্থা সমুদ্র উপকূলে গড়ে তুলেছে সিরিয়া। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়ার দেয়া ইয়াখোন্ত নামের সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী ব্যবস্থা রয়েছে সিরিয়ার কাছে। এটি ন্যাটোর কাছে এসএস-এন-২৬ নামে পরিচিত ছিল। ফলে সিরিয়া এসব ব্যবহার করে নিজেকে অনেকটাই সুরক্ষিত রাখতে পারে।
সিরিয়া পরিস্থিতি: সর্বশেষ
-    বন্দর-নগর তুলুঁ থেকে রওনা হয়েছে ফরাসি ফ্রিগেট ‘শেভালিয়ার পল’। তবে ওই দ্রুতগামী রক্ষী জাহাজের গন্তব্য সিরিয়া কিনা তা জানাতে রাজি হয় নি নৌ কর্তৃপক্ষ।
-   যুক্তরাজ্যের পারলামেন্টে সিরিয়া অভিযানের সমর্থনে সরকার উত্থাপিত প্রস্তাব পরাজিত হয়েছে ১৩ ভোটে। ফলে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে সংক্ষুব্ধ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় বৃটেনের সামরিকভাবে জড়িত হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল।
-   ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদে বলেছেন, সিরিয়ায় আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ‘রাজনৈতিক সমাধান’। এ বক্তব্য তাঁর আগের বক্তব্যের চেয়ে আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে উচ্চারিত। তিনি বলেছেন, ‘সব কিছুই করা হবে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে। সে লক্ষ্য তখনই পূরণ হবে যখন বাশার-বিরোধী জোট প্রয়োজনীয় শক্তি নিয়ে, বিশেষ করে এর সেনাবাহিনীর দিক থেকে,  দাঁড়াতে পারবে বিকল্প হিসেবে।’
-    রাশিয়া দু’টি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে।
-    লেবানন ও জরডান বলেছে, সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য লেবাননের আকাশসীমা ও জরডানের ভূমি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।
-   সিরিয়া’র শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে হেজবুল্লাহ’র একাত্মতার অভিযোগ তুলে ইসরাইল বলেছে, আগামী দিনগুলোতে ইসরাইলে হেজবুল্লাহ বোমা হামলা চালালে দামসকাসকে দায়ী করা হবে।
-   পশ্চিমা দেশগুলোর সিরিয়া আক্রমণকালে ইসরাইলকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে উপসাগরীয় দেশগুলো। একটি কুয়েতি পত্রিকা এ খবর দিয়েছে।
-    সিরিয়া’য় হামলা চালানোর ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে হুঁশিয়ারি দিয়ে ডেমক্রেটিক দলীয় কংগ্রেসম্যান জেরোল্ড ন্যাডলার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘সংবিধানমতে সিরিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিপ্রয়োগে কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে হবে।’
-    বৃটেন ছ’টি ‘টাইফুন’ ফাইটার জেট পাঠিয়েছে সাইপ্রাসে। বিমান হামলার বিরুদ্ধে সিরিয়া পালটা ব্যবস্থা নিলে এগুলো প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেবে।
-    সিরিয়া’র প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বলেছেন, ‘যে কোনও আগ্রাসন মোকাবেলা করা হবে।’
-    বৃটেনের যৌথ গোয়েন্দা কমিটি তাদের রিপোর্টের উপসংহারে মন্তব্য করেছে, গত সপ্তাহে সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের জন্য বাশার আল-আসাদ সরকার যে দায়ী তা ‘প্রায় নিশ্চিত’ করে বলা যায়।

No comments

Powered by Blogger.