টুটুলের অ্যাংরি বার্ডস by মাহফুজ রহমান

টুটুলের বড় আপুর নাম শিলা। টুটুল ডাকে চিলা! ‘চিল’-এর সঙ্গে ‘আ’-কার যোগ করে চিলা। শিলা যখন সামনে থাকে না, টুটুল তখন ওকে ডাকে চিলাপু বলে।
এই নামকরণের পেছনে বিশাল ইতিহাস আছে। টুটুল কোনো জিনিস হাতে নিলেই শিলা ঠিক চিলের মতো কোত্থেকে যেন উড়ে আসে; তারপর মুরগির বাচ্চাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ছোঁ মেরে জিনিসটা নিয়ে যায়। তাই টুটুল একদিন ভেবে দেখল, এমন একটা মেয়ের নাম কোনোভাবেই শিলা হতে পারে না। এই মেয়ের নাম হওয়া উচিত চিলা। শেষমেশ হলোও তা-ই। তবে বিষয়টা শিলা জানতে পারলে শক্ত মার খাওয়ার আশঙ্কা আছে। টুটুল তাই নামটা উচ্চারণ করার আগে চারপাশ ভালো করে দেখে নেয়!আজ দুপুরেও টুটুলের হাত থেকে মুঠোফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে শিলা। ছিনিয়ে নিয়ে যা, ভালো কথা, সেটা আবার ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানানোর কী হলো!শুক্রবার। কোনো কাজ নেই। টুটুল তাই একটু শখ করে অ্যাংরি বার্ডস গেমটা খেলতে বসেছিল। মাত্র একটা স্টেজ পার করতেই শিলাপু প্রায় উড়ে এল! এসেই সে কী চিৎকার-চেঁচামেচি, ‘এই বয়সে মোবাইল দিয়ে তুই কী করিস! যা, পড়তে বস! মা, মা...’কম্পিউটারে বসে যে অ্যাংরি বার্ডস খেলবে, টুটুল সেটাও পারে না! শিলা এসেই শুরু করবে বকবক, ‘হ্যাঁ, এই বয়সে কোথায় বাইরে গিয়ে একটু খেলবে-টেলবে, তা না, বাসায় বসে কম্পিউটার! মা, মা, এই দেখো তোমার ছেলে কী করছে!’মাও শুধু শিলার কথায় নাচেন। টুটুলের হাতে ব্যাটটা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘যা, মাঠে যা! বাসায় বসে থেকে থেকে অকর্মার ঢেঁকি হচ্ছে।’ টুটুল আর কী করে, মুখ ভার করে ব্যাট হাতে মাঠে যায়। মাঠে সবাই খেলা শুরু করে দিয়েছে। টুটুল ব্যাটটা একপাশে ফেলে মাঠে বসে বসে পটাং পটাং করে ঘাস ছেঁড়ে। ম্যাচের মাঝে তো চাইলেই আর খেলতে নামা যায় না। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর টুটুল একটা ঘাস ছিঁড়ে চিবোতে থাকে। মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায় ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ তুলে। পাখিগুলোকে দেখে আবার অ্যাংরি বার্ডসের কথা মনে পড়ে টুটুলের!

২.

বাবাই কেবল টুটুলের কথা একটু শোনেন-টোনেন। টুটুল তাই রাতের বেলা বাবার কাছে গেল। বাবা তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভিতে টক শো দেখছেন। টুটুল একবার বাবার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, বাবা ওর দিকে নজর না দিয়ে মাথাটা কাত করে টিভিই দেখতে লাগলেন। টুটুল ভেবে পেল না, কী এমন মজার জিনিস হয় এই টক শোতে! চার-পাঁচজন লোক ঝগড়া করছে, আর বাবা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন! বড়রা যে কী—মনে মনে ভেবে আফসোস হয় টুটুলের। অনেকক্ষণ পর একটা বিজ্ঞাপন-বিরতিতে সুযোগ পেল ও। বাবার কাঁধে ঝুলে বলল, ‘বাবা, একটা কথা বলি?’

: শুধু একটা কথা বলবি কিন্তু! বেশি বললে গাট্টা খাবি।

: হি হি হি হি! বাবা, তুমি পচা ছেলেদের মতো কথা বলো!

: তোর কি মনে হয়, আমি ভালো ছেলে?

: যাও বাবা, খালি দুষ্টামি করো!

: তোর কথাটা বল, বিয়ে করতে চাস?

: বাবা, তুমি কিন্তু বেশি পচা!

: হা হা হা! আচ্ছা বল, বল, তোর একটা কথা বলে ফেল।

: বাবা, আমাকে অ্যাংরি বার্ডস কিনে দেবে?

: কেন, বাসায় যে এতগুলো অ্যাংরি বার্ডস, সেগুলো কী হলো?

: ওই অ্যাংরি বার্ডস না, বাবা।

: তো কোন অ্যাংরি বার্ডস?

: সত্যিকারের অ্যাংরি বার্ডস। দেবে বাবা, কিনে?

: সত্যিকারের অ্যাংরি বার্ডস আমি কোথায় পাব?

: কেন, পাখি বিক্রি করে যে দোকানগুলোতে, সেখানে পাবে!

: হা হা হা! ভালো বলেছিস তো! ঠিক আছে, কাল বিকেলে আমরা গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব, ঠিক আছে?

: তুমি কত ভালো, বাবা!

: যা, এখন ভাগ। টক শো শুরু হয়ে যাচ্ছে।

  ৩.
পেছন থেকে দৌড়ে এসে মাথায় একটা গাট্টা দিল পিয়াল। সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেদের নোবেল প্রাইজ দেওয়ার নিয়ম থাকলে এই ছেলেটা ১০টা নোবেল পেত। গাট্টা খেয়েও টুটুল কিছু বলল না। সোজা হাঁটতে লাগল। গতকাল বিকেলে বাবার সঙ্গে ও গিয়েছিল পশুপাখির দোকানে। এ-মাথা থেকে ও-মাথা খুঁজে একটা অ্যাংরি বার্ডসও পাওয়া গেল না। উল্টো যে পাখিওয়ালাই শোনে, সে-ই কেমন ফিচেলমার্কা হাসি হাসে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল টুটুলের।

এদিকে পিয়াল আবার ওর ব্যাগের জিপারটা টেনে খুলে দিল। টুটুল এবারও কিছু বলল না। ব্যাগের জিপারটা লাগিয়ে আবার হাঁটতে লাগল। অন্য দিন হলে টুটুল কিছু একটা বলত। কিন্তু আজ যখন বলছে না, তখন পিয়াল খুব অবাক হয়ে গেল, ‘কী হয়েছে রে, টুটু-মুটু? পেটব্যথা?’

: তুই ভাগবি এখান থেকে?

: ও বুঝেছি, তোর পেটে অনেক...

: তোকে ধরে কিন্তু একটা আছাড় দেব!

: দে তো দেখি! আয়, সামনে আয়!

পিয়ালের ভাবভঙ্গি দেখে ভড়কে গেল টুটুল। একে তো মন খারাপ, তার ওপর এমন অহেতুক মারামারির কথা ভেবে ওর কান্না চলে এল প্রায়। কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। পিয়াল দুই পা এগিয়ে এসে ওর বুকে একটা থাবা দিয়ে বলল, ‘এই নেংটি ইঁদুর, দে না দেখি আছাড়! দে!’

টুটুল বুঝে ফেলল, মারামারি করার জন্য পিয়ালের হাত-পা নিশপিশ করছে। আর ও ভালো করেই জানে, মারামারিতে পিয়ালের সঙ্গে মোটেও পেরে ওঠা যাবে না। তাই টুটুল উল্টো দিকে ঘুরেই দিল ভোঁ-দৌড়! পিয়াল কত বদমাশ! পাশেই জড়ো করে রাখা কতগুলো সুরকি হাতে নিয়ে সাঁই সাঁই করে ঢিল ছুড়তে লাগল। ব্যাগটা আড়াল করে কোনোমতে মাথাটা বাঁচাল টুটুল। কিন্তু দু-তিনটা সুরকি ঠিকই এসে লাগল পিঠে আর পায়ে।

এভাবে যে কতক্ষণ দৌড়াল, তা আর মনে নেই টুটুলের। হঠাৎ ও দেখল, মাথার ওপরের ইলেকট্রিক তারে বসে থাকা কাকগুলো ‘কা কা কা’ করে চিৎকার করছে, কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে বোধ হয়। চিৎকার করতে করতে মুহূর্তেই কাকগুলো উড়ে গেল ওর পেছন দিকে। এদিকে ঢিলও বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মাথা থেকে সাবধানে ব্যাগটা সরিয়ে পেছনে তাকাল টুটুল। দেখল সব কটি কাক পিয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে! একটা কাক তো ডাইভ দিয়ে ঠিক ওর মাথায় একটা ঠোকর মেরে বসল! ঠোকর খেয়ে পিয়াল তো ‘ওরে বাবা রে! মরে গেলাম রে!’ বলে দিল ভোঁ-দৌড়। কিছুদূর গিয়ে হোঁচট খেয়ে আবার দৌড়! কাকগুলোও নাছোড়বান্দা, পিয়ালকে ধাওয়া করছে তো করছেই।

রাস্তার পাশের দেয়ালে একটা ছেলে বসে ছিল। পিয়ালের দিকে তাকিয়ে থেকে পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, ‘ঢিলা মাইরা ডিস্টাব করলে কাউয়া কি ছাইড়া দিব? আইজকা হের খবর আছে! হি হি হি!’

টুটুল কাকগুলোর কাণ্ড দেখতে দেখতে আর ছেলেটার কথা শুনতে শুনতে ভাবল, কাকগুলো কেমন অ্যাংরি বার্ডস হয়ে গেছে! ঠিক যেমনটা ও চেয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.