৪ মাসে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছে ৫০ কোটি ডলারের অর্ডার

ওয়াল-মার্টের মতো আরও বেশ কিছু বড় বড় তৈরী পোশাকের ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে সরে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে টেসকো, ভিএফ করপোরেশন প্রভৃতি। এক্ষেত্রে তারা ইউরোপ, আফ্রিকা, কম্বোডিয়াসহ অনেক দেশের কথা ভাবছে।
শুধু গত ৪ মাসে বাংলাদেশ থেকে ৫০ কোটি ডলারের কাজ প্রত্যাহার করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিদেশীরা যে বাংলাদেশ থেকে সরে যাচ্ছে এমনটা স্পষ্ট করা হয়েছে হংকংয়ে ফরাসি চেম্বার অব কমার্সের এক বৈঠকে। সেখানে পরিষ্কার করে কোন কোন ক্রেতা বলেছেন- আমরা বাংলাদেশ থেকে সরে যাচ্ছি। কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ তুলে নিতে পারে এমন আশঙ্কার কথা অস্বীকার করেন বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোনের সিনিয়র কর্মকর্তা আজিজুর রহমান। এসব কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অনলাইন সংস্করণে। বৃহস্পতিবার এতে ‘বাংলাদেশ রায়টস থ্রেটেন ইটস বুম’ শীর্ষক এক  প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ওয়াল-মার্টের পর বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্রেতা টেসকো করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টোফ রাসেল পরিষ্কার করে বলেছেন- বাংলাদেশ ব্যবসার জন্য একটি ভাল জায়গা ছিল। ভিএফ করপোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেইট গেইসে বলেছেন, তারা এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সরে যাচ্ছেন। গত সপ্তাহে ওয়াল-মার্ট সরে যেতে পারে এমন রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর এখন নতুন করে বড় এ দু’টি ক্রেতা তাদের নেতিবাচক মনোভাব জানালেন। শুধু তারাই নন। বাংলাদেশের অস্থির পরিস্থিতি দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য যে সুনাম ছিল তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ছে। ফলে তারা এখন চীনের চেয়ে কম খরচের দেশ খুঁজছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, গত কয়েক বছরে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় তৈরী পোশাকের রপ্তানিকারক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দেশে পর্যায়ক্রমিক কতগুলো ঘটনায় সেই ধারা ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গত নভেম্বরে ও জানুয়ারিতে দু’টি গার্মেন্টে আগুন। তাতে কমপক্ষে ১১৯ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশের এ খাত সম্পর্কে একটি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। এতে গার্মেন্টে কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকের অধিকার রক্ষার বিষয়টি উঠে আসে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘটনায় সৃষ্ট সহিংসতা। এতে কমপক্ষে ৬০ জন নিহত হয়েছেন। অনেকগুলো হরতাল হয়েছে। এসব ঘটনায় এখন বিদেশী অনেক ক্রেতাই বাংলাদেশ নিয়ে ‘পাস্ট টেনস’-এ (অতীতকাল) কথা বলছে। তাদেরই একজন ওয়াল-মার্ট ও কেয়ারফোর এসএ ক্রেতার পর তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্রেতা টেসকো করপোরেশনের নির্বাহী প্রধান ক্রিস্টোফ রাসেল। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যবসার জন্য ভাল একটি জায়গা ছিল। কিন্তু আপনাকে বিশ্বের রাজনৈতিক প্রবণতার দিকে নজর রাখতে হবে। তার কথার সঙ্গে ভিএফ করপোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট গেইট গেইসে যোগ করেন, আমরা তো এরই মধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে শুরু করেছি। তারা দু’জনেই হংকংয়ে ফরাসি চেম্বার অব কমার্সের আয়োজনে এশিয়ায় বাজার খোঁজা বিষয়ক সাপ্লাই চেইনের নির্বাহীদের এক বৈঠকে এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরকে কেন্দ্র করে এই হতাশার বিষয় এটাই প্রথম নয়। ২০০৫ সালে যখন তৈরী পোশাক খাতে কোটা পদ্ধতি তুলে দেয়া হয় তখন উদ্বেগ দেখা দেয় যে, চীনের মতো বৃহৎ রপ্তানি সক্ষমতার দেশ ছোট ছোট দেশের উৎপাদন ব্যাহত করবে। কিন্তু ওই উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রপ্তানি অব্যাহত ধারায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেয়া তথ্য মতে, গত জুনে সম্পন্ন অর্থবছরের প্রথম আট মাসে গার্মেন্ট রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ১০ ভাগেরও বেশি। তবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মিলে সেই রপ্তানি এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৫ ভাগ। বিশ্লেষকরা বলেন, মন্থর অর্থনীতি ও শিপমেন্টে বিলম্বের কারণে বিশ্বের বড় বড় ক্রেতারা ঘাবড়ে যাচ্ছেন। তারই প্রতিফলন হতে পারে রপ্তানি কমে যাওয়া। ওদিকে গত ৫ই ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এরপর শুরু হয় অশান্ত পরিস্থিতি। এছাড়া, জামায়াতের আরও দু’নেতার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে ফাঁসির রায়। এসব ঘটনার পর বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। স্থানীয় যেসব উৎপাদনকারী আছেন তারা বলছেন, এতে তারা বেশ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। তৈরী পোশাকের রপ্তানিকারক মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেছেন, আমরা এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। পণ্য বোঝাই ট্রাক চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, না হয় সেগুলোর ক্ষতি করা হচ্ছে। এতে যে সময়ক্ষেপণ করতে হচ্ছে তার জন্য বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে হাজার হাজার কর্মক্ষেত্র। যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘ লড়াই করা এ দেশটির জন্য সুখবর বয়ে এনেছে। কিন্তু অনেক কোম্পানি এখন দেখছে, বাংলাদেশের ভিতরেই রয়েছে এদেশের নিজের প্রতিবন্ধকতা। তাই তারা কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া সহ চীনের মতো দেশগুলোকে বিকল্প হিসেবে দেখছে। কারণ, এখানে শ্রমিক মজুরি কম হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল অবকাঠামো, ঘন ঘন হরতাল, শ্রম আইনের জটিলতায় খরচ বেড়ে যাবে। কিন্তু চীনে যে দৃঢ় সাপ্লাই নেটওয়ার্ক আছে তা ছেড়ে মালিকদের অন্যদিকে সরে যাওয়া জটিল। সমপ্রতি নাইকি ইনকরপোরেশন বলেছে, ২০১১ সালে তারা ৮৯৬টি ফ্যাক্টরির সঙ্গে কাজ করেছে। তার মধ্যে মাত্র ৮টি বাংলাদেশী। তারা এভাবে বাংলাদেশী ফ্যাক্টরির সংখ্যা কমিয়ে আনার কারণ এখানকার ঝুঁকি। হংকংয়ের সিল্ক রোড ইকোনমিকস-এর বেন সিম্পফেন্ডরফার বলেন, কোরিয়ার তৈরী পোশাক শিল্প বিনাশ করে দিয়েছে চীন। কিন্তু বাংলাদেশ বা কম্বোডিয়া সেই ভাবে চীনের শিল্পকে বিনাশ করতে পারবে না। ওদিকে চীন থেকে এরই মধ্যে টেসকো তাদের পণ্য তৈরির খাত খুব জোর দিয়ে সরিয়ে এনেছে। কম খরচের ক্রেতারা চীনের ওপর থেকে তাদের নির্ভরতা শতকরা ৮০ ভাগ কমিয়ে এনেছেন। দু’এক বছর আগে এই হার ছিল শতকরা ৬০ ভাগ। ক্রিস্টোফ রাসেল বলেন, এই সরে আসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বড় ভূমিকা পালন করছিল। কিন্তু এই বাংলাদেশে সমপ্রতি যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে টেসকো দ্বিতীয়বার ভাবতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা অত্যধিক চাপ নিয়েছিলাম। এটা এখানকার কারখানার কন্ডিশন নয়, দেশটির কারণে। কিন্তু টেসকো এখন ইউরোপিয়ান বাজারের দিকে চোখ রাখছে। তারা সেখানে কারখানা খুঁজছে। এর মধ্যে রয়েছে তুরস্ক, পূর্ব ইউরোপ ও আফ্রিকা। তবে ক্রিস্টোফ রাসেল বলেন, তবে চীন তাদের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী থাকছেই। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমলে এদেশের বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। এ দেশটি এখনও এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ রয়ে গেছে। এখানে মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ২০০০ ডলারেরও কম। তার ওপর রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস। এ দেশটিতে রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা। ১৫ কোটি মানুষের বেশির ভাগই কর্ম উপযোগী বয়সে। রয়েছে তুলনামূলক কম মজুরি। এ বিষয়টি এখানে গার্মেন্ট খাত বিকশিত হতে সহায়তা করেছে। বছরের পর বছর ধরে এ খাতে দ্রুতগতিতে উন্নতি করার ফলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি প্রায় ২০০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক ইতালির প্রায় সমান এই অঙ্ক। এ তথ্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ তৈরী পোশাকের রপ্তানিকারক চীন ২০১১ সালে ১৫৪০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশে গার্মেন্ট খাতের উন্নতি দেখে প্রতিবেশী দেশ ভারত ক্রেতাদের দিকে তাকানো শুরু করে। ফলে মার্চে শেষ হওয়া এই অর্থবছরে সেখান থেকে ১৩০০ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রপ্তানি করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভারত এখন এ বিষয়ে খোলাখুলি হয়ে গেছে। ভারতের রাষ্ট্র সমর্থিত অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এ. শক্তিবেল হিসাব দিয়ে বলেছেন, গত চার মাসে বাংলাদেশ থেকে ৫০ কোটি ডলারের অর্ডার ক্রেতারা প্রত্যাহার করে ভারতে নিয়ে গেছেন। তিনি আরও বলেন, অনেক ক্রেতাই এখন ফের ভারতে ফিরে আসছেন। তবে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ তুলে নিতে পারে এমন আশঙ্কার কথা অস্বীকার করেন বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোনের সিনিয়র কর্মকর্তা আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে রপ্তানি সংশ্লিষ্ট শিল্পকে রক্ষা করতে সরকার বদ্ধপরিকর। এখনও বাংলাদেশে প্রচুর বিনিয়োগ পাইপলাইনে রয়েছে। আমরা আশা করি আমাদের প্রবৃদ্ধি দ্রুতগতিতে অর্জিত হবে। কিন্তু ঢাকার অনেক প্রস্তুতকারক সংশয়ে। গার্মেন্ট কারখানার নেতারা বলছেন, দেশের অস্থির পরিস্থিতির কারণে বায়াররা শিডিউল বাতিল করেছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান মানসুর বলেছেন, এখনও অর্ডার আসছে। কিন্তু আগামী মাসগুলোতে রাজনৈতিক যে অস্থিরতা তাকে কি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে তা আমরা দেখতে পাবো। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়- বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত কম বেতনের সমস্যা মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। যদিও সরকার মাসে সর্বনিম্ন বেতন ৩৬ দশমিক ৫০ ডলার ধরে দিয়েছে ২০১০ সালে, তারপর থেকে সেই একই অবস্থায় আছে। পরের বছর এই বেতন কাঠামো পর্যালোচনা করার কথা ছিল। শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের পর গত বছরের জুনে আশুলিয়ায় মালিকরা ৩০০ কারখানা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেন। সরকারের মন্ত্রী, মালিক-শ্রমিক ইউনিয়ন ও সরকারের মধ্যে বৈঠকের পর তা খুলে দেয়া হয়েছে। সে সময় প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল শ্রমিকরা যাতে নিত্যপণ্য কম দামে কিনতে পারেন এজন্য তাদেরকে রেশন কার্ড দেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.