নারী, তুমি কার আকাশে ওড়ো by ফারহানা ইসলাম জয়া

টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রী, ব্র্যাক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক সাজিয়া আফরিন কিংবা দিল্লির মেডিক্যালছাত্রী দামিনীর জন্য নয়। আরো, আরো গভীর কোনো কষ্ট থেকে উৎসারিত এই লেখার প্রতিটি অক্ষর। যে অক্ষরগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে ব্যক্তিগত অথবা চেনাজানা বহু নারী-জীবনের অপমান।
আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্ষণ মানেই নীরবতা অথবা মৃত্যু। আমাদের সংস্কৃতি এখনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি ধর্ষিতার নাম-পরিচয় গোপন থাকবে, নাকি প্রকাশিত হবে। যে অপরাধে নারী নিজে অপরাধী নয়, তা কেন লুকিয়ে রাখতে হবে? কিন্তু আমরা তো রয়ে গেছি সেই ট্যাবুর মধ্যেই, যেখানে ধর্ষিতাই অপরাধী। টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের শিকার হলো যে ছাত্রী, রাষ্ট্র তো তাকে নিরাপত্তা দিতে পারেইনি, উপরন্তু পরিবারের কাছেও প্রাথমিকভাবে মেয়েটিকে নিগৃহীত হতে হয়েছে। চার পশু মেয়েটির ওপর তাদের পাশবিকতার প্রকাশ ঘটাল, অথচ মেয়েটির বাবা তাকে বাড়িতে আশ্রয় না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। আর ওই অর্ধশিক্ষিত বাবাকে দোষ দিয়ে কী হবে, যেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতির শিক্ষিত ছেলে অভিজিৎ মুখার্জিরই সন্দেহ রয়েছে, লিপস্টিক লাগানো নারীকর্মীরা আদৌ আন্দোলনকারী কি না; কিংবা রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যখন বলেন, দামিনী রাতে বাসে ওঠার আগে কেন সতর্ক হয়নি! তখন আকবর বাদশাহ থেকে হরিপদ কেরানি- সব একাকার হয়ে যায় আমাদের কাছে। আমরা বুঝতে পারি, বিজ্ঞান ও সভ্যতা হাজার বছর অতিক্রম করলেও নারীর প্রতি প্রচলিত সমাজের বিরাজমান দৃষ্টিভঙ্গি খুব কিছু বদলায়নি। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে আরো লক্ষ করি, বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও সহিংসতা প্রতিরোধের সংগ্রামে এখনো শ্রেণীবৈষম্য ক্রিয়াশীল। আর তাই দিল্লির সাম্প্রতিক ঘটনা যেমন গোটা গ্রহবাসীকে ধাক্কা দিয়েছে, অন্য ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। অথচ একই সহিংসতার শিকার তো আমাদের রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার দরিদ্র পরিবারের কিশোরী তুমা চিং মারমা ও লংগদু উপজেলার পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুজাতা চাকমা। ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হতে হয়েছিল তাদের। জানামতে, গেল বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় ৩০ আদিবাসী নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সুজাতা-তুমারা মেডিক্যালের ছাত্রী নয়, তারা প্রান্তিক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ, অর্থনৈতিক পরিচয়ে তারা দরিদ্র শ্রেণীর। সে কারণেই কি তাদের ব্যথা অনেককে ব্যথিত করে না?
প্রতিদিন কোনো না কোনো নারী ঘরে কিংবা কর্মস্থলে বহুমাত্রিক নির্যাতনের শিকার হয়। প্রতিদিন নারী পাচ্ছে গৃহপালিত পশুপর্যায়ের ব্যবহার। আখ মাড়াইয়ের কারখানার মতো তার রস নিংড়ে নেওয়া হচ্ছে, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বানানো হচ্ছে। অক্ষম লজ্জায়, অশেষ অপরাধে, আমি সুজাতা থেকে দামিনী- সবার কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
অভিধান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণ শব্দের অর্থ পেশিশক্তির ব্যবহার করে কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে যৌনকর্মে বাধ্য করা। কিন্তু আমার মনে হয়, ধর্ষণ শব্দের অর্থ আরো বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। শুধু পেশিশক্তি নয়, পাশবিক ইচ্ছাশক্তিসহ আরো অনেক শক্তিই এখানে প্রয়োগ করা হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা এত ব্যাপক ও বহুমুখী যে এই গ্রহবাসী সব নারীই কোনো না কোনোভাবে ধর্ষণ ভয়ে ভীত। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ট্যাবুর কারণে অনেক অনাচারকেই তারা মেনে নেয় অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়। ধর্ষণকারীরা অনাবিষ্কৃত বা আড়ালে থেকে যায়। এখন বোধ হয় সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করার।
কেন নারীকেই বলা হয় রাস্তায় রাতে একা চলাচল না করতে? কেন রাস্তাই নারীর জন্য নিরাপদ হয়ে ওঠে না? কেন নারীকেই শুধু সাবধানে থাকতে বলা হবে? নারীকে কী চোখে দেখা হবে, কেন পুরুষ সেই শিক্ষা পাবে না? কেন নারীকেই বারবার বলা হয়, তার পোশাক যেন 'উগ্র' না হয়, পর্দার বাইরে যেন না যায়? যেসব উপদেশ-আদেশ, নারীর ওপর পরিবার থেকে বর্ষিত হয়, সেসব আদেশ-উপদেশ কেন পরিবারের ছেলেটিকে শেখানো হবে না? আমরা কি একটি অশিক্ষিত, অসভ্য, কপট, মিথ্যাচারী, অসৎ, ঈর্ষাকাতর, অবিশ্বস্ত, দায়িত্বহীন সুবিধাবাদী, আড়ম্বরপূর্ণ সমাজকাঠামোর বাসিন্দা হয়েই থেকে যাব? সমাজে নারী মাথা তুলে হাঁটবে, নাকি হামাগুড়ি দিয়ে চলবে, নাকি খোঁড়াবে- কেন সেটা নির্ধারণ করে দেয় কিছু নষ্ট মানুষ? নারী মুক্ত থাকবে, নাকি তার পায়ে বাঁধন থাকবে, বাঁধন থাকলে সেটা দড়ির হবে, নাকি শেকলের, সেসব সিদ্ধান্তও নেয় নষ্ট মগজের মানুষেরা। আর রাষ্ট্রযন্ত্রের মগজই যখন পচে যায় তখন শরীর সুস্থ থাকবে- এমন আশা আমরা করতেই পারি না।
পৃথিবীতে শুধু নারীই শোষিত নয়। অধিকাংশ পুরুষও এখনো শৃঙ্খলিত ও শোষিত। তবে শোষিত-শৃঙ্খলিত নারী ও পুরুষের মধ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। সব শ্রেণীর পুরুষ বন্দি ও শোষিত নয়; কিন্তু সব শ্রেণীর নারীই বন্দি ও শোষিত। বিত্তবান শ্রেণীর নারী পরগাছার পরগাছা। বিত্তহীন শ্রেণীর নারী দাসীর দাসী। নারীমাত্রই দ্বিগুণ শোষিত। মাও সে তুং বলেছেন, বিপ্লবের আগে চীনের পুরুষদের বইতে হতো সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তিনটি পর্বত, আর চীনের নারীদের বইতে হতো চারটি পর্বত। চতুর্থটি পুরুষ। বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার যে বিস্তার ঘটছে, তা প্রগতির জন্য যেমন উদ্বেগজনক, নারীর জন্যও তা বিশেষভাবেই ভীতিকর। চারপাশে এখন নানা রঙের পর্দাপ্রথার প্রচ্ছায়া। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-একটির বেশি মেয়ে বোরখা পরে আসত না। আর এখন রাস্তায় বেরোলেই দেখা যায় সারি সারি বোরখা। ক্লাসরুমে বোরখার অন্ধকারে বেঞ্চর পর বেঞ্চ অন্ধকার। ষাটের দশকের আধুনিক প্রগতিবাদের পর এই দশকের মধ্যযুগীয়তা দেখা এক মর্মান্তিক বিবমিষাজাগানো অভিজ্ঞতা। এই অন্ধত্ব যদি ষাটের দশকে থাকত তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।
দামিনীর জন্য ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আপামর জনতা একটি ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের পাহাড়ে সমতলে অগণন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেলেও তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি দূরে থাক, কোনো সামাজিক শক্তিও ঐক্যবদ্ধ হয়নি। দিল্লির সাহসী দামিনীকে ভারতের রাষ্ট্রপতি 'বীরের মৃত্যু' হিসেবে অভিহিত করে ধর্ষকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অঙ্গীকার করেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের ধর্ষিতাদের পরিচয় তারা বীর তো নয়ই বরং ধর্ষণ এখানে জাতিগত নিপীড়নের একটি অন্যতম কৌশলও। তাই কল্পনা চাকমা বলিমিলা, সুজাতা ও তুমাচিংয়ের হত্যাকারীদের শাস্তি দূরে থাক, রাষ্ট্র যেন তাদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর (এন সি আর বি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৪৩৭টি আর ২০১১ সালে ২৪ হাজার ২০৬টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। আমরা কি স্বাধীন দেশের নারীকে মুক্তি দিতে পেরেছি, নাকি নারী পরিণত হয়েছে বিশুদ্ধ শোষিত, সর্বহারায়- সেটা বিচারের জন্য বোধ হয় কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয় না।
নারীর প্রতি সহিংসতাকে রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনার ওপরে ভাবতে না পারলে এই প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। দিল্লির মেয়েটি ধর্ষণের বিরুদ্ধে ভারতে যে অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে, সেই শিখাটি জ্বলতে আমাদের এখানে কত দিন সময় লাগবে, আদৌ জ্বলবে কি না জানি না। জানি না, আমাদের ধর্ষিত মেয়ের চোখের আগুন কেন আমাদের চোখেও সঞ্চারিত হয় না। তবে আমি মনে করি, আমাদের উচিত ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সোচ্চার হওয়া। রাষ্ট্রের ওপর অব্যাহত চাপ তৈরি করা, যাতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে তারা সঠিক বিচারটি করে। আমাদের উচিত, আগামী নির্বাচনের সব প্রার্থীকে এই শপথ নিতে বাধ্য করা যে তাঁরা ধর্ষণ-নির্যাতন চিরতরে বন্ধ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন এবং জনসমক্ষে সে বিষয়ে তাঁদের বলতে হবে। কেননা সামাজিকভাবে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যত সামাজিক আন্দোলনই গড়ে তুলি না কেন, শেষ ভরসাটি রাষ্ট্রের কাছ থেকেই আসতে হবে।
লেখক : পরিচালক, কিংবদন্তি মিডিয়া
joyajoybangla@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.