জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে উপেক্ষিত বাংলা by সোহেল রহমান

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেলেও জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে উপেতি রয়েছে বাংলা। সরকার ও নানা মহলের পক্ষ থেকে সভা, সেমিনারে বলা হলেও জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে এতদিন কোন জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি অর্জনের এগারো বছর পরও ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ তথ্যাদি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর কাছে পাঠানো হয়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, বাংলাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষার স্বীকৃতি আদায় এই মুহূর্তে খুবই চ্যালেঞ্জিং।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পাওয়ার পরও বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা অবহেলিতই থেকে গেছে। বাংলাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে বিগত কয়েকটি সরকারের আমলে তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। শুধুমাত্র ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী মিশনগুলোতে দায়সারা গোছের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে পালন করা হয়। যে সকল দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন নেই সেখানে তাও পালন করা হয় না। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষার স্বীকৃতি দেয়ার প্রসত্মাব দেন। এর মাধ্যমে বাংলাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে এ নিয়ে বাংলাদেশের প থেকে সরকারীভাবে তেমন কোন কূটনৈতিক উদ্যোগও নেয়া হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পাওয়ার পর দু'একটি ফোরামে বাংলাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ঘোষণা দাবি করা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রসত্মাব পাঠানো হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা করার জন্য জোরালো তৎপরতা চালানো হলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় ও মৌলিক বিষয়গুলো উপেতি থেকে যেতে পারে। তাই বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা ঘোষণার পরিবর্তে সাহায্য, খাদ্য সংগ্রহ ও জলবায়ুর মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রয়োজন। সূত্র জানিয়েছে, বাংলাকে অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ঘোষণার জন্য সরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এর বাসত্মবায়ন ততটা সহজ হবে না। এ মুহূর্তে বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানালে অন্যান্য ভাষাভাষীরাও তাদের ভাষার জন্য একই ধরনের দাবি উত্থাপন করবে। আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার এতদিন পরও বাংলাদেশের প থেকে জাতির ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ইতিহাস, তাৎপর্য ইত্যাদি নিয়ে তথ্যসামগী্র জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর কাছে পাঠানো সম্ভব হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মূখপাত্র বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষার স্বীকৃতি আদায় খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তার পর সেই চ্যালেঞ্জিং কাজের জন্য আমরা কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। বিষয়টির সঙ্গে জাতিসংঘ ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত। বাংলাকে অফিসিয়াল ভাষার স্বীকৃতি পেতে হলে সংস্থার সকল সদস্যরাষ্ট্রের সর্বসম্মত সিদ্ধানত্মের প্রয়োজন হবে। তিনি জানান, আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে বিদেশে বাংলাদেশী মিশনগুলোতে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। প্রতিবছর মিশনগুলোতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণী পাঠানো হয়। এ ছাড়া যে সকল দেশে মিশন নেই সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প থেকে অনারারি কনসাল ও কূটনীতিকদের বার্তা পাঠানো হয়।
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের নবেম্বর মাসে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার একুশে ফেব্রম্নয়ারির তাৎপর্য ও পটভূমি সংক্রানত্ম তথ্য ছয়টি ভাষায় অনুবাদ করে বিভিন্ন দেশে পাঠানোর সিদ্ধানত্ম নেয়। বিভিন্ন দেশ তখন বাংলাদেশের কাছে মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পটভূমি ইত্যাদি তথ্য জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিনত্মু পরবতর্ী সরকারের অনাগ্রহের কারণে এই উদ্যোগ বেশি দূর এগোতে পারেনি। ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যনত্ম সরকার ভাষা আন্দোলনের কিছু তথ্য দিয়ে একটি ছোট আকারের পুসত্মিকা তৈরি করে। এ ছাড়া আনর্ত্মজাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রকল্প সীমিত তথ্য সংবলিত একটি ওয়েবসাইট খুলেছে।
১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ কানাডায় বসবাসরত মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার অব দ্য ওয়ার্ল্ড নামের একটি বহুভাষী ও বহুজাতিক ভাষাপ্রেমী গ্রম্নপ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচি কোফি আনানের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠায়। আবেদনপত্রে দণি আমেরিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশের অসংখ্য ুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভাষা ব্যবহার না করার জন্য বাধ্য করা, কাউকে মাতৃভাষা ভুলে যেতে বল প্রয়োগ করা হচ্ছে, সে সকল ভাষাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না। কোন কোন চমৎকার ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, এ ধরনের আচরণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আনত্মর্জাতিক সনদের মারাত্মক লঙ্ঘন। একসময় বাংলা ভাষাকেও এই সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বলে তাদের আবেদনে ২১ ফেব্রম্নয়ারি পটভূমি ব্যাখ্যা করা হয়। বাঙালীরা ভাষার জন্য যে জীবন উৎসর্গ করেছে সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। সে জন্য ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিলে প্রতিটি মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর একটি অন্যতম দৃষ্টানত্ম হবে। এই আবেদনপত্রে স্বার করেন দশ ব্যক্তি। এঁদের মধ্যে ফিলোপিনোভাষী আলবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবাল, ইংরেজীভাষী জেসন মরিন ও সুসান হজিনস, ক্যান্টোনিসভাষী ড. কেলভিন চাও, কাছিভাষী নাসরিন ইসলাম, জামর্ানভাষী রিনাতে মার্টিনস, হিন্দীভাষী করম্নণা যোশী, বাংলাভাষী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম। আবেদনপত্রের উত্তরে জাতিসংঘের সদর দফতর থেকে তাঁদের জানানো হয়, বিষয়টি নিয়ে ইউনেস্কোতে যোগাযোগ করতে হবে। সে অনুযায়ী তাঁরা ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের কাছে প্রসত্মাব পেশ করে। জবাবে ইউনেস্কো তাঁদের জানায়, এ ধরনের প্রসত্মাব ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রসমূহের যে কোন জাতীয় কমিশন থেকে উত্থাপিত হতে হবে। ভাষাপ্রেমী গ্রম্নপের প থেকে রফিকুল ইসলাম টেলিফোনে বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশ ইউনেস্কোর জাতীয় কমিশন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিামন্ত্রী এএইচএসকে সাদেকের অনুমোদন নিয়ে প্রসত্মাবটি ইউনেস্কো সদর দফতরে পেশ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ত্রিশতম সাধারণ সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন সংরণ ও শিার সকল েেত্র বহুভাষা ব্যবহারে অগ্রগতি অর্জন সম্পর্কিত ইউনেস্কোর নীতিমালার আলোকে ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে প্রতিবছর তা বিশ্বের সকল সদস্যরাষ্ট্র ও ইউনেস্কো সদর দফতরে উদ্যাপনের জন্য একটি রেজু্যলেশন পেশ করেন। ইউনেস্কোর ২৮টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রসত্মাব লিখিতভাবে সমর্থন করে।

No comments

Powered by Blogger.