গ্রীষ্ম শুরু না হতেই বিদ্যুত বিভ্রাট, সঙ্কট বাড়বে- অতিরিক্ত ১৬শ' মে.ও. চাহিদা মেটাতে পিডিবি হিমশিম by রশিদ মামুন

 গ্রীষ্ম শুরম্ন না হতেই বিদু্যত বিভ্রাট মাত্রা ছাড়াচ্ছে। ক্রমান্বয়ে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাসা বাড়ি থেকে শুরম্ন করে শিল্পকারখানা সবখানেই বিদু্যতের অভাবে জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
সেচ মৌসুম শুরম্ন হওয়ায় অতিরিক্ত এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদু্যতের চাহিদা মেটাতে গিয়ে পিডিবিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
পিডিবি সূত্র মতে, এখন দেশে গড় বিদু্যত উৎপাদন হচ্ছে ৩ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার মেগাওয়াটের মতো। তাদের হিসেবেই দৈনিক ঘাটতি রয়েছে ৮০০ মেগাওয়াটের মতো। তবে বেসরকারী হিসেবে ঘাটতির পরিমাণ হাজার মেগাওয়াটের উপরে। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী (বীর বিক্রম) গ্রীষ্ম মৌসুমে নগরবাসীকে লোডশেডিংয়ের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বিদু্যত মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, লোডশেডিং হবে না এটা ঠিক নয়, সরকার কৃষিকে গুরম্নত্ব দিয়ে সেচে নিরবিচ্ছিন্ন বিদু্যত দেয়ায় শহরের মানুষের কিছুটা কষ্ট হবে। পিডিবির হিসেব মতে ঢাকা এলাকায় দৈনিক বিদু্যত চাহিদা ১৬৩০ থেকে ১৬৫০ মেগওয়াট সেখানে লোডশেডিং হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৫০ মেগাওয়াটের মতো। চট্টগ্রাম এলাকার বিদু্যত চাহিদা ৪২০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট সেখানে লোডশেডিং করা হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট, খুলনা এলাকায় বিদু্যত চাহিদা ৪০০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট সেখানে গড় লোডশেডিং ৯০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট, রাজশাহী এলাকায় চাহিদা ৩৬০ থেকে ৩৭০ মেগাওয়াট ওই অঞ্চলে লোডশেডিং করা হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ মেগাওয়াট, কুমিলস্না এলাকায় চাহিদা ৩৩০ থেকে ৩৪০ মেগাওয়াট এখানে লোডশেডিং করা হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ মেগাওয়াট। এছাড়া ময়মনসিং এলাকায় ৪০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট, বরিশাল এলাকায় ১৫ থেকে ২০ মেগাওয়াট, রংপুরে ৪০ থেকে ৪৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হচ্ছে। তবে সিলেট এলাকায় চাহিদা ২১০ থেকে ২৩০ মেগায়াট চাহিদার বিপরীতে প্রায় দ্বিগুণ বিদু্যত উৎপাদন হওয়ায় তেমন লোডশেডিং নেই। ইতোমধ্যে গরম পড়তে শুরম্ন করায় বাসাবাড়িতে বিদু্যতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া সেচ মৌসুমে বাড়তি আরও এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদু্যতের প্রয়োজন হচ্ছে।
পিডিবি সেচ মৌসুমকে সামনে রেখে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল চার মাসের জন্য উৎপাদন এবং বন্টনের যে পরিকল্পনা করেছে তাতে দেখা যায়, ক্রমান্বয়ে বিদু্যত সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করবে। এতে বলা হয়েছে ফেব্রম্নয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০০ মেগাওয়াট ঘাটতি মাসের শেষ সপ্তাহে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬৪ মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। মার্চের শুরম্নই হবে ৪৪৯ মেগাওয়াটের ঘাটতি নিয়ে ওই মাসের শেষে গিয়ে যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮৩ মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সম্ভাব্য ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫৭৫ মেগাওয়াট দ্বিতীয় সপ্তাহে যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬৩৮ মেগাওয়াটে। পিডিবি সর্বোচ্চ উৎপাদনের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করায় ঘাটতি পরিমাণ প্রতিবেদনে অনেক কম দেখানো হয়েছে। বেসরকারী হিসেবে এ সময় গড় সঙ্কট এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার মেগাওয়াটের উপরে হবে।
পিডিবি বলেছে গ্যাস সঙ্কটের কারণে বিদু্যত উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘি্নত হচ্ছে। একেবারেই গ্যাস সরবরাহ না থাকার কারণে চট্টগ্রামের রাউজান, শিকলবাহা, বাঘাবাড়ী, হরিপুরের বিদু্যত কেন্দ্রগুলো বন্ধ আছে। সম্মিলিতভাবে এ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ৰমতা ৬৮৮ মেগাওয়াট। এ ছাড়া আরও ৬টি বিদু্যত কেন্দ্র পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। এগুলো হচ্ছে টঙ্গি জিটি-১০৫ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাট পাওয়ার (সিসিপিপি)-৪৫০ মেগাওয়াট, হরিপুর পাওয়ার (সিসিপিপি)-৩৬০ মেগাওয়াট, আরপিসিএল-১১০, ওয়েস্টমেন্ট জিটি-৯০ মেগাওয়াট পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। গ্যাস সঙ্কটের কারণে এসব বিদু্যত কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন অনেক ৰেত্রে অর্ধেকে নেমে আসছে। এতে দৈনিক গড়ে এক হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন কম হচ্ছে।
পিডিবি চেয়ারম্যান এসএম আলমগীর কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, গ্যাস সঙ্কট নিরসনের জন্য পেট্রেবাংলাকে বার বার বলা হচ্ছে। সরকারের উচ্চপর্যায়েও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী ২৩ ফেব্রম্নয়ারি মঙ্গলবার এ বিষয়ে তারা পেট্রোবাংলার সঙ্গে বৈঠক করবেন।
বিদু্যত প্রতিমিন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, সেচ মৌসুমে যাতে বিদু্যত কেন্দ্রগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ দেয়া যায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দেশে নতুন কয়েকটি বিদু্যত কেন্দ্র উৎপাদনে আসছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, আমরা আশা করছি গ্রীষ্ম মৌসুমের শেষের দিকে সঙ্কট কিছুটা কমে আসবে। তিনি পিডিবির সাম্প্রতিক করা ভাড়াভিত্তিক বিদু্যত কেন্দ্রের চুক্তিগুলোর কথা উলেস্নখ করে বলেন, তিন থেকে ৬ মাসের মধ্যে এ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে। যাতে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
লোডশেডিং এ নগর জীবনে স্থবিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীর মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, খিলগাঁও, লালবাগ, মালিবাগ, মগবাজার, পল্টন, আজিমপুরসহ পুরনো ঢাকায় সমস্যা প্রকট। এলাকাভেদে দিনে তিন থেকে চারবার করে বিদু্যত চলে যাচ্ছে। একবার বিদু্যত গেলে আর এক থেকে দেড় ঘণ্টার আগে আসছে না। বিদু্যতের এই আশা-যাওয়ার খেলায় সব থেকে বেশি ৰতিগ্রসত্ম হচ্ছে শিৰার্থীরা। এসএসসি পরীৰার্থীদের প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটছে।
রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা পাপিয়া সুলতানা জানান, বিদু্যত বিভ্রাটের কারণে তার সনত্মানদের লেখাপড়ায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। সারাদিন স্কুল এবং কোচিং করে আসার পর সন্ধ্যায় পড়তে বসলেই বিদু্যত চলে যাচ্ছে। এদিকে সকলের আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় তার পৰে আইপিএস কেনাও সম্ভব হচ্ছে না।
বিদু্যত সঙ্কটের কারণে রাজধানীর ৰুদ্র ব্যবসা থেকে কলকারখানায়ও স্থবিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, লোডশেডিংয়ের জন্য আমাদের দেশে কোন সময় নির্ধারণ করা নেই। যখন যেখানে ইচ্ছা সেখানের বিদু্যত দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। আবার একবার এলে কতৰণ থাকবে তারও নিশ্চয়তা নেই। এজন্য কোন এলাকায় কখন কত সময় বিদু্যত থাকবে না এ ধরনের আগাম ঘোষণার দাবি জানায় তারা।
অন্যদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল মিল মালিকরা। বিজেএমইএ সভাপতি সালাম মোর্শেদী ােভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, গ্যাস সঙ্কটে এমনিতেই পোশাক শিল্পের অবস্থা ভয়াবহ। এরপর শুরম্ন হয়েছে লোডশেডিং। তাও মেনে নেয়া যায় যদি এটা নির্দিষ্ট সময়ে হয়। কিন্তু লোডশেডিং কোন রম্নটিন মানে না। তিনি বলেন, কারখানায় অনেক মূল্যবান যন্ত্রপাতি রয়েছে। বার বার চালু ও বন্ধ হলে এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই বিদু্যত কোম্পানিগুলোর লোডশেডিংয়ের যে তালিকা রয়েছে তা সংশোধন করে সকলকে জানিয়ে দেয়া উচিত বলে তিনি মনত্মব্য করেন।
লোডশেডিংয়ের ৰতির হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে না রাজধানীর ৰুদ্র ব্যবসায়ীরা। গ্রীষ্ম শুরম্নর আগেই মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে তাদের মারাত্মক ৰতি হচ্ছে বলে জানান তারা। এ ব্যাপারে পুরানা পল্টনের দারম্নসসালাম আর্কেডের মলিস্নক পস্নাজার ফটোকাপি ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, বিদু্যত কখন যাবে কখন আসবে তার কোন ঠিক নেই। একবার আসার পর কতৰণ থাকবে তারও নিশ্চয়তা না থাকায় তাদের ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রাজধানীর প্রায় সকল এলাকার ৰুদ্র ব্যবসায়ীরা একই অভিযোগ করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.