ভালুকার কুমির খামার : রফতানি খাতে নতুন পণ্য by আবুল হোসেন

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কার বিপরীতে রফতানি খাতে নয়া সংযোজন হতে যাচ্ছে ব্যক্তিউদ্যোগে বাণিজ্যিক খামারের কুমির। তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের মতো এই প্রথম বাংলাদেশের কুমির যাবে আনত্মর্জাতিক বাজারে।
কুমির রফতানিকারকদের নামের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হবে বাংলাদেশের নাম। দেশে আসবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। কারণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই রফতানি খাত। আর এ খাতে এ রকম উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে ময়মনসিংহের ভালুকার রেপটাইলস ফার্ম। ব্যাংকের সহায়তায় ব্যক্তিউদ্যোগের বাণিজ্যিক এই কুমিরের খামারে এই মুহূর্তে রফতানিযোগ্য কুমির রয়েছে ১৪১টি। আনত্মর্জাতিক বাজারে এর মূল্য প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ এই খামার থেকে প্রতিবছর পাঁচ হাজার কুমিরের চামড়া রফতানি করা যাবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা। এ থেকে প্রতিবছর চামড়া রফতানি করে বছরে অনত্মত পাঁচ মিলিয়ন ইউএস ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব হবে বলে দাবি করছে রেপটাইলস কর্তৃপৰ। এর বাইরে কুমিরের মূল্যবান মাংস, দাঁত ও হাড় তো আছেই। বিপরীতে নতুন করে খামারে বিনিয়োগ করতে হবে না উদ্যোক্তাদর। প্রয়োজন কেবল সরকারের উদার সহায়তা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ বিশ্বের মধ্যে কুমির রফতানিতে ও খামারের দিক থেকে অন্যতম বৃহৎ খামারে পরিণত হবে ভালুকার এই কুমিরের খামার। বর্তমানে সর্ববৃহৎ স্থানটি ধরে রেখেছে অস্ট্রেলিয়া।
বিভিন্ন জার্নালের সূত্র থেকে জানা যায় অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশে এখন চাষ হচ্ছে কুমিরের। এর চামড়া, মাংস, দাঁত ও হাড়ের চাহিদা রয়েছে বিশ্বের উন্নত অনেক দেশে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, জাপান ও তাইওয়ানসহ অনেক দেশে কুমিরের মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব দেশে প্রতিকেজি কাঁচা মাংস ১৫/২০ ইউএস ডলার ও প্রক্রিয়াজাত মাংস প্রতিকেজি ১৮০-২০০ ইউএস ডলারে বিক্রি হয়ে থাকে। এই মুহূর্তে আনত্মর্জাতিক বাজারে বছরে পাঁচ শ' মিলিয়ন ইউএস ডলারের কুমিরের মাংসের চাহিদা রয়েছে। পাকা চামড়ার চাহিদা রয়েছে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নত অনেক দেশে। ফ্রান্স ও চীনে প্রক্রিয়াজাত করা কুমিরের প্রতিটি চামড়ার ব্যাগ ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে ৫০ হাজার ইউএস ডলারে বিক্রি হচ্ছে। ২০০৯ সালে আনত্মর্জাতিক বাজারে প্রায় ৫০ হাজার কুমিরের চামড়া বিক্রি হয়েছে। আর ২০০৮ সালে প্রায় ৪০ হাজার চামড়া বিক্রি হয়েছে। কুমিরের হাড়ের নির্যাস থেকে তৈরি হচ্ছে নামীদামী সুগন্ধি। প্যারিস কুমিরের হাড় থেকে এই দামী সুগন্ধি তৈরি করছে। এ ছাড়াও কুমিরের দাঁত থেকে তৈরি হচ্ছে দামী ও মূল্যবান গহনা। বস্তুত কুমিরের কোন কিছুই ফেলনা নয়, বরং অনেক মূল্যবান। আর এ কারণেই হয়ত ধনকুবের বা টাকাওয়ালাকে তুলনা করা হয় 'টাকার কুমির' বলে। আনত্মর্জাতিক বাজারের এ রকম চাহিদা ও নিশ্চিত লাভজনক ভেবেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহায়তা নিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হাতিবেড় গ্রামে ২০০৪ সালে প্রায় ১৫ একর জমিতে ব্যক্তিউদ্যোগে গড়ে তোলা হয় বাণিজ্যভিত্তিক কুমিরের খামার। ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে ৬০ ও ভালুকা উপজেলা সদর থেকে এই খামারের দূরত্ব ২০ কিমি। 'ঝুঁকি তো নয়ই, বরং অনেকটা নিরাপদ বিনিয়োগ' দাবি করে ভালুকার রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশতাক আহমেদ ও খামার ইনচার্জ মফিজুল ইসলাম জানালেন খামার প্রতিষ্ঠার শুরম্ন, বর্তমান অবস্থা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নানা বৃত্তানত্ম। মালয়েশিয়ার সারওয়াত থেকে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০টি স্ত্রী ও ১৫টি পুরম্নষসহ ৭৫টি কুমির আমদানি করে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরম্ন করে রেপটাইলস ফার্ম। খামারের ১৫ একরের মধ্যে সাড়ে পাঁচ একর জমির ১৮ হাজার স্কয়ার ফুট ওয়াটার এরিয়ার পৃথক সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা ৩২টি ফ্রেশ ওয়াটারের পুকুরে ছাড়া হয় এসব কুমির। আমদানি করা এসব ব্রম্নড কুমিরের জন্য খামারে তলদেশ পাকা করা ৩২টি পুকুর খনন করা হয়। খাবার হিসেবে দেয়া হয় মাছ ও মুরগির মাংস। প্রাকৃতিক পরিবেশেই কুমিরের লালনপালন ও বেড়ে ওঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগ করার পর উদ্যোক্তাদের নতুন করে বিনিয়োগের ওপর ব্যাংকের কোন সহায়তা নেই। উদ্যোক্তারা জানান, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে পুকুরে ছাড়া কুমির থেকে ২টি কুমির প্রথম ডিম দেয় ৬৯টি। এই ডিম থেকে ৩টি বাচ্চা হলেও ইনকিউবেটরের অভাবে শেষতক টেকেনি। ২০০৭ সালে খামারের ১৫টি কুমির থেকে ডিম পাওয়া যায় মোট ৬০৬টি। এর মধ্যে ফার্টাইল ডিম ছিল মাত্র ২০৮টি। পরিচর্যার পর এই ব্যাচ থেকে বাচ্চা মেলে ১৪১টি। বস্তুত এটিই ছিল খামারের প্রথম সফল ব্যাচ। এ সময়েই উদ্যোক্তারা মিডিয়ার কাছে ২০০৯ সাল থেকে এই খামারের কুমির রফতানি হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
২০০৮ সালে ১৭টি কুমির থেকে ডিম মেলে নয় শতাধিক। এর মধ্যে ৩৯৯টি ফার্টাইল ডিম থেকে বাচ্চা পাওয়া যায় ২৪০টি। গত ২০০৯ সালে ২৩টি কুমির থেকে ডিম পাওয়া যায় রেকর্ড সংখ্যক ১১৫০টি। এর মধ্যে ৫৭৫টি ফার্টাইল ডিম থেকে বাচ্চা টেকে ৪২৫টি। এই তিন ব্যাচে এখন বাচ্চা রয়েছে ৮০৫টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে রফতানিযোগ্য কুমির হয়েছে প্রথম ব্যাচের ১৪১টি। চলতি বছর দ্বিতীয় ব্যাচের আরও ২৪০টি কুমির রফতানিযোগ্য হচ্ছে। এভাবে খামারে বেঁচে থাকা ৬৭টি ব্রম্নড কুমির একসঙ্গে ডিম দেয়া শুরম্ন করলে আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ এই খামার হবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কুমির খামার। তখন এই খামার থেকে বছরে কেবল কুমিরের চামড়া থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা আসবে অনত্মত পাঁচ মিলিয়ন ইউএস ডলার। এর বাইরে কুমিরের মাংস, হাড় ও দাঁত তো আছেই। সবকিছু মিলিয়ে ভালুকার এই কুমিরের খামার হয়ে উঠবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস। এ সময়ে খামারে নতুন করে কোন বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে না বলেও জানানো হয়। বলা হয় কুমিরের গড় আয়ু হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ বছর। ১০-১২ বছর বয়সে ডিম দেয় কুমির। খামারের জন্য আমদানি করা কুমির থেকে অনত্মত আগামী ৩০ বছর ডিম পাওয়া যাবে। এ সময়ে খামারের ডিম থেকে যে বাচ্চা হবে তা থেকেই উৎপাদন ব্যবস্থা সচল থাকবে বছরের পর বছর। খামারের কুমিরের জন্য খাবারের যোগান আর কুমির পরিচর্যাসহ খামার ব্যবস্থাপনায় জড়িত স্টাফ কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ছাড়া এ সময় অন্য কোন খরচ হবে না। ২-৫ বছর বয়সের কুমিরের দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৫ মিটার ও পেটের সাইজ ৩২-৪০ সেন্টিমিটার হলেই রফতানিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। বর্তমানে খামারের যে অবস্থা তাতে প্রতিমাসে গড়পড়তা ৬-৭ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে কুমিরের খাবার যোগানে। রফতানিযোগ্য যে শতাধিক কুমির রয়েছে সেটি চালান হলে এই খরচ খানিকটা কমে আসবে। একই সঙ্গে কিছুটা উঠে আসবে বিনিয়োগের অঙ্ক। উদ্যোক্তাদের কাছে ইউরোপ ও জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশের অফার রয়েছে এই কুমির নেয়ার। খামারীদের আশা ছিল, এই কুমির রফতানি হলে অনত্মত এক কোটি ৫০ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু রফতানির পর্যায়ে এসে বন বিভাগের এক উদ্ভট পরামর্শে বিপাকে পড়েছে খামার কর্তৃপৰ। কেবল তাই নয়, বন বিভাগের এ রকম পরামর্শ মানতে গিয়ে যে সময়ৰেপণ হচ্ছে তা থেকে বাতিল হয়ে যেতে পারে কুমির রফতানির অফার। জানা যায়, তিনটি শর্তে গত ২০০৪ সালে কুমির আমদানির অনুমোদন দেয় সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়, কুমির আমদানি ও রফতানির ৰেত্রে বন বিভাগের পূর্বানুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া রফতানিযোগ্য প্রতিটি কুমিরকে শনাক্ত করতে ইলেকট্রনিক মার্কিং করতে হবে বলেও জানানো হয়। খামার কর্তৃপৰ এজন্য ২০০৮ সালের অক্টোবরে আবেদন করে বন বিভাগের কাছে। প্রধান বন সংরৰকের দফতর থেকে জানানো হয়, এটি রফতানির সময় প্রয়োজন পড়বে। খামারীরা রফতানির অফার পেয়ে ৬৭ কুমির রফতানি করার জন্য ইলেকট্রনিক মার্কিং করতে অনুমোদিত কোম্পানির সেই মার্কারও আমদানি করে। কিন্তু পরবতর্ীতে গত ডিসেম্বরে এসে প্রধান বন সংরৰকের দফতর থেকে নতুন এক আদেশে বলা হয়, রফতানির আগে খামারের সকল কুমিরকে এই মার্কিং করতে হবে। এ রকম পরিস্থিতিতে ২০০৯ সালে কুমির রফতানি সম্ভব হয়নি। এখন অফার বাতিলের আশঙ্কা করছে খামার কর্তৃপৰ। একই সঙ্গে চলতি বছরের জানুয়ারিতে যে কুমির রফতানির কথা বলা হয়েছিল তা নিয়েও তৈরি হয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা।

No comments

Powered by Blogger.