বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় বাংলায় রূপান্তর : by এনামুল হক

আমি জনাব তৌফিক নেওয়াজের এই বক্তব্যের সঙ্গেও একমত যে সংবিধানে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতির যে অবস্থান নির্দেশ করা ছিল তার পরিপ্রেেিত শুধু একটিমাত্র আইন_ সেনাবাহিনী আইন ১৯৫২-এর কারণে এবং সশস্ত্রবাহিনীর "সর্বাধিনায়ক" হবার জন্য নিহত রাষ্ট্রপতিকে সেনাবাহিনীর সদস্য বলে গণ্য করা যায় না।
আপীলকারীদের বিজ্ঞ কেঁৗসুলিরা আরও বলেছেন যে, দণ্ডবিধির ১৩৯ ধারা ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৯ ধারার আলোকে ফৌজদারি আদালতে আপীলকারীদের বিচার অনুষ্ঠানে বাধা আছে। দণ্ডবিধির ১৩৯ ধারাটি সপ্তম অধ্যায়ে অন্তভর্ুক্ত যেখানে ১৩১ থেকে শুরু করে ১৪০ ধারা পর্যন্ত আছে। দেখা যাবে যে, ১৩১ ধারায় বিদ্রোহ ঘটাতে সহায়তা করা বা কোন সৈনিক, নাবিক বা বিমানসেনাকে তার কর্তব্য থেকে বিচু্যত করতে প্ররোচিত করার চেষ্টা, ১৩২ ধারায় ঐ সব কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে বিদ্রোহ সংঘটিত হলে তাতে সহায়তা করা এবং অন্যান্য ধারায় অপরাপর অপরাধে সহায়তা করা সংক্রান্ত অপরাধের কথা উল্লেখ আছে এবং ১৩৯ ধারায় ১৩১ থেকে ১৩৮ পর্যন্ত ধারাসমূহে বর্ণিত অপরাধসমূহে সহায়তাদানের জন্য সেনাবাহিনী আইন ১৯৫২, নৌবাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৬১, বিমানবাহিনী আইন ১৯৫৩-এর আওতাধীন যে কোন ব্যক্তিকে দণ্ডবিধির বিধান অনুযায়ী শান্তিদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে বিদ্রোহে সহায়তার মতো অপরাধ সংঘটনের জন্য নয়, বরং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও হত্যার গুরুতর অপরাধের জন্য আপীলকারীদের বিচার ও দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরিপ্রেেিত বর্তমান আপীলগুলোর েেত্র দণ্ডবিধির ১৩৯ ধারার কোন প্রয়োগ বা কার্যকারিতা নেই। দণ্ডবিধির ৫৪৯ ধারার েেত্র দেখা যায় যে, এই ধারাটি এক বিশেষ প্রকৃতির এবং এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী আইনের আওতাভুক্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ার নিয়ে নেয়া হয়েছে। এই ধারায় ব্যবহৃত "এই বিধি যে আদালতের েেত্র প্রযোজ্য সেই আদালতে কিম্বা কোর্ট মার্শালে বিচারযোগ্য" কথাগুলোর অর্থ হলো এই যে, যে অপরাধের জন্য অপরাধীর বিচার করা হবে সেটা হতে হবে এমন অপরাধ যা ফৌজদারি আদালত এবং কোর্ট মার্শাল আমলে নিতে তথা বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারে। কথাগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধকে আমলে নিতে দুই আদালতের প্রাথমিক এখতিয়ারকে বুঝানো_ অপরাধের দোষগুণের ভিত্তিতে সে ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ারকে নয়। ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শাল উভয় আদালতে বিচারযোগ্য অপরাধের েেত্র উপরে যেমন আলোচনা করা হয়েছে তেমনি এই দুই আদালতের এখতিয়ারগত সংঘাত এড়ানোর জন্য সেনাবাহিনী আইনের ৯৪ ও ৯৫ ধারায় উপযুক্ত বিধান রাখা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতে প্রযোজ্য সেনাবাহিনী আইন ১৯৫০-এর ১২৫ ও ১২৬ ধারা এবং সেনাবাহিনী আইন ১৯৫২-এর ৯৪ ও ৯৫ ধারা অরে অরে এক।
বলবীর সিং ও আরেকজন বনাম পাঞ্জাব রাজ্য (১৯৯৫)১ এসসিসি ৯০ মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট মন্তব্য করেছে :
"কোন অপরাধের বিচারের ব্যাপারে ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শাল উভয়েরই যখন এখতিয়ার থাকে তখন কোন আদালতে মামলাটি রজু করা হবে নিজের বিবেচনা বা বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার বিবেচনামূলক মতা প্রথমত : অপরাধী যে গ্রুপ, উয়িং বা স্টেশনে কর্মরত তার কমান্ডিং অফিসারের বা অনুমোদিত অপর কোন অফিসারের হাতে থাকবে। সেই অফিসার যদি ঠিক করেন যে মামলা কোর্ট মার্শালে রজু হতে হবে তাহলে সেটা রজু করার জন্য অপরাধী বা অপরাধীদের বিমানবাহিনীর হেফাজতে রাখতে হবে। কাজেই বিমানবাহিনী আইনের আওতাধীন কোন ব্যক্তি যিনি "সক্রিয় সৈন্য দলে থাকাকালীন অবস্থায়" অপরাধ করেছেন তাঁকে বিচার করার বিবেচনামূলক মতা প্রথমত থাকবে বিমানবাহিনী কতর্ৃপরে। এ ধরনের আসামিকে ফৌজদারি আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে বিচার করবে না কিম্বা বিচারের জন্য সোপর্দ করার ল্যে তদন্ত পরিচালনা করবে না। আদালত আসামির কমান্ডিং অফিসারকে নোটিস দেবে এটা নির্ধারণ করার জন্য যে তারা কোর্ট মার্শালে আসামিকে বিচার করতে চান নাকি ফৌজদারি আদালতকে বিচারকাজ করতে দিতে চান। বিমানবাহিনী কতর্ৃপ যদি কোর্ট মার্শালে ঐ ব্যক্তির বিচার না করার সিদ্ধান্ত নেন কিংবা ১৯৫২ সালের বিধানাবলীর ৪নং বিধি অনুযায়ী অনুমোদিত সময়সীমার মধ্যে ফৌজদারি আদালতের জানিয়ে দেয়া বিকল্প পন্থাটি অবলম্বন করতে ব্যর্থ হয় সে েেত্র আসামিকে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সাধারণ ফৌজদারি আদালতে বিচার করা যেতে পারে।"
যোগীন্দর সিং বনাম হিমাচল প্রদেশ, এআইআর, ১৯৭১, এসসি ৫০০ মামলায় সুপ্রীম কোর্ট মন্তব্য করেছে :
"এটা আরও স্পষ্ট যে ফৌজদারি আদালতেও বিচার হতে পারে আবার কোর্ট মার্শালেও বিচার হতে পারে এমন অপরাধের েেত্র সাধারণ ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শালের মধ্যকার এখতিয়ারগত সংঘাত এড়ানোর জন্য ১২৫ ও ১২৬ ধারায় ও বিধিসমূহে উপযুক্ত বিধান রাখা হয়েছে। তবে ল্য করতে হবে যে, প্রথম েেত্র কোন আদালতে মামলা রজু করতে হবে তা নির্ধারণের জন্য ১২৫ ধারায় উলি্লখিত অফিসারকে বিবেচনামূলক মতা দেয়া হয়েছে। সেই হেতু, আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তি যে সেনাবাহিনী, আর্মি কোর, ডিভিশন বা স্বাধীন ব্রিগেডে কর্মরত তার কমান্ডিং অফিসার অথবা নির্দিষ্ট করে দেয়া অপর কোন অফিসারকে ১২৫ ধারার অধীনে তার বিবেচনামূলক মতা প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন আদালতে মামলাটি রজু করা হবে।
তিনি যখন তাঁর বিবেচনামূলক মতা প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নেবেন যে মামলাটি একটি কোর্ট মার্শালে রজু করতে হবে তখনই কেবল ১২৬(১) ধারার বিধানাবলী কার্যকর হবে। এ কাজের জন্য মনোনীত অফিসার যদি তাঁর বিবেচনামূলক মতা প্রয়োগ না করেন এবং ঠিক করেন যে মামলা কোর্ট মার্শালে রজু হতে হবে তাহলে আইনে সেভাবে বিধান রাখা হয়েছে যেভাবে ফৌজদারি আদালতের সাধারণ এখতিয়ার প্রয়োগ করার প েসেনাবাহিনী আইন স্বভাবতই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।"
মেজর ইজি বারসে বনাম বোম্বাই রাজ্য, এআইআর ১৯৬১, এসসি ১৭৬২ মামলায় বিচারপতি সুবভা রাও মন্তব্য করেছেন :
"অতএব এই আইনের উদ্দেশ্য স্বতঃপ্রমাণিত। এটা আইনের ২নং ধারায় বর্ণিত সেনাবাহিনীর লোকদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের েেত্র প্রযোজ্য। এই আইনে সুনির্দিষ্ট সাজার ব্যবস্থাসহ নতুন অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে, আগে থেকে বিদ্যমান অপরাধের জন্য উচ্চতর সাজার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সত্য বলে ধরে নেয়া দেওয়ানি অপরাধকে এই আইনের অধীন অপরাধ বলে পরিগণিত করে তোলা হয়েছে, এতে এখতিয়ারগত সংঘাত নিরসনের সন্তোষজনক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উপরন্তু এই আইনে কতিপয় শর্তসাপে েআসামিকে উপযর্ুপরি কোর্ট মার্শাল ও ফৌজদারি আদালতে বিচারের সুযোগ রাখা হয়েছে। এই আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য কার্য বা অকরণ ভারতে বলবত অপর যে কোন আইনেও শাস্তিযোগ্য হয়ে থাকলে সেসব েেত্র ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ারের পথে এই আইন সুস্পষ্ট কোন বাধা নয়। এই আইনের প্রয়োজনীয় নিহিতার্থ দ্বারা কোন নিষেধাজ্ঞা টানাও সম্ভব নয়। ১২৫, ১২৬ ও ১২৭ ধারায় এ ধরনের কোন সিদ্ধান্ত টানার সুযোগ নেই। কেননা ওসব ধারায় একই অপরাধের েেত্র ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শালের মধ্যে এখতিয়ারগত সংঘাত নিরসনের ব্যবস্থা সুস্পষ্ট ভাষায় শুধু করাই হয়নি, একই অপরাধের েেত্র আসামির উপযর্ুপরি বিচারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।"
আপীলকারীরা জামিল হকের মামলার ওপর আস্থা সহকারে নির্ভর করেছিলেন। সেই মামলায় রিট আবেদনকারীদের ১৯৮১ সালের ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে সংঘটিত বিদ্রোহের অপরাধের জন্য সেনাবাহিনীর আইন ১৯৫২-এর অধীনে কোর্ট মার্শালে বিচার ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ঐ বিদ্রোহের পরিণতিতে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রাণ হারিয়েছিলেন। আবেদনকারীরা সেনাবাহিনী আইনের অধীনে গঠিত কোর্ট মার্শালের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছিলেন। হাইকোর্ট সংপ্তি শুনানির পর রিট পিটিশন প্রত্যাখ্যান করেন। আপীল বিভাগ আলোচ্য মামলার তথ্যাদি বিচার করে মন্তব্য করেছিল : "কোর্ট মার্শাল যদি যথাযথভাবে গঠিত হয়ে থাকে এবং সংঘটিত অপরাধ কোর্ট মার্শাল কতর্ৃক আমলযোগ্য হয় তাহলে বাকিটা হলো সা্য-প্রমাণ নির্ভর বিচার্জ বিষয়ের প্রশ্ন যে সম্পর্কে সকল কতর্ৃপরে অভিমত হলো এই যে, হস্তপে করার মতো এখতিয়ার রিটের নেই। ১০২ ধারায় এখতিয়ার দেয়া হয়েছে কি-না সে বিষয়টি পরীা করে দেখাই শুধু এই আদালতের কাজ এবং যখন এই উপসংহারে পেঁৗছানো হয় যেম এখতিয়ার প্রদান করা হয়নি, তখন ওখানেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায়।"
(ক্রমশ)

No comments

Powered by Blogger.