যক্ষ্মা রোগ চিকিসায় ডটস পদ্ধতি

পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশের মতো যক্ষ্মা বাংলাদেশের অত্যনত্ম প্রচলিত একটি রোগ ও দ্বিতীয় ঘাতক ব্যাধি হিসাবে পরিগণিত। ১৯৯৯ সালের পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশে মোট ৬০ লাখ যক্ষ্মা রোগী রয়েছে, তার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৬ লৰাধিক ছোঁয়াচে অর্থাৎ চিকিৎসার আওতায় না আসা পর্যনত্ম যারা ক্রমাগত রোগ বিসত্মার করে যাচ্ছে।
প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ নতুন যক্ষ্মা রোগীর আগমন ঘটছে এবং প্রায় ৮০ হাজার লোক এ রোগে প্রাণ হারাচ্ছে। হিসাবমতে প্রতি ২ মিনিটে ১ জন করে যক্ষ্মায় মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে পৃথিবীর ৩ ভাগের এক ভাগ মানুষ যক্ষ্মা রোগে ইনফেকশনপ্রাপ্ত।
যক্ষ্মা রোগের চিচিৎসা মোটেই ব্যয়বহুল নয়। মাত্র ৪-৫ টি ওষুধ নিয়মিত ৮ মাস খেলেই যক্ষ্মা রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়। যেসব কারণে আমাদের দেশে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে - রোগীদের অধিকাংশই দরিদ্র এবং তাদের ওষুধ ক্রয়ে অৰমতা, দেরিতে রোগ নির্ণয় হওয়া, পূর্ণ সময় পর্যনত্ম ওষুধ সেবনে রোগীর অনীহা অথবা অবহেলা, ওষুধ সেবনের দু'এক মাসের পর রোগের লৰণগুলো কমে যাওয়াকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে ভেবে ওষুধ সেবন বন্ধ করা, নিয়মিত ওষুধ সেবন না করে বিরতি দিয়ে ওষুধ সেবন করা, রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে রোগীর ধারণা না থাকা ইত্যাদি।
যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়লে মানসম্পন্ন ওষুধ নিয়মিত ৮ মাস সেবন করার পর এ রোগ সম্পূর্ণরূপে ভাল হয়ে যায়। এ রোগে আক্রানত্ম রোগীর সুস্থ না হওযার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নিযমিত নির্দিষ্ট সময় পর্যনত্ম ওষুধ সেবন না করা। আর এ কারণেই যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীতে ডটস অর্থাৎ শর্ট কোর্স কেমোথেরাপি স্ট্রাটেজি গ্রহণ করা হয়েছে। ডটস পদ্ধতিতে শর্ট কোর্স কেমোথেরাপি রেজিম দেয়া হয়। অর্থাৎ মাত্র ৮ মাস যক্ষ্মার ওষুধ সেবন করতে হয়। এর মধ্যে প্রথম ২ মাস ৪টি ওষুধ এবং পরবর্তী ৬ মাস শুধু মাত্র ২টি ওষুধ সেবন করতে হয়। রোগীরা প্রতিদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে ওষুধ সেবন করে যাবেন। এভাবে নির্দিষ্ট সময় পর্যনত্ম রোগীর চিকিৎসা চলবে। আর স্বাস্থ্যকর্মীর দায়িত্ব হচ্ছে রোগীর ওষুধ সেবন নিশ্চিত করা।
যক্ষ্মা চিকিৎসায় ডটস চিকিৎসা ব্যবস্থা নয় এটি একটি পদ্ধতি মাত্র। এ পদ্ধতিতে নতুন কোন ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। নিয়মানুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যনত্ম ওষুধ সেবন নিশ্চিত করাই এ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য। আমাদের দেশে ১৯৯৩ সালে-এর কার্যক্রম শুরম্ন হয়। পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যক্ষ্মা চিকিৎসার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রোগী ওষুধ খাচ্ছেন, কিন্তু কিছুদিন খেয়ে আবার বিভিন্ন কারণে বন্ধ করে দিচ্ছেন। আমাদের দেশে এরকম চিকিৎসা শুরম্ন করার কিছুদিন পর বন্ধ করে দেয়ার হার শতকরা ৬০-৮০ ভাগ। এভাবে বার বার চিকিৎসা শুরম্ন করার কিছুদিন পর বন্ধ করার ফলে যক্ষ্মা জীবাণুসমূহ ব্যবহৃত ওষুধের বিরম্নদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সৰম হয়। ফলে এসব ওষুধ অকার্যকর হয়ে দাড়ায়। এমনিতেই বাংলাদেশে যৰ্না একটি চিকিৎসা সমস্যা। তার উপর নতুন ধরনের এ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু আমাদের আরও শঙ্কিত করে তুলছে। অন্যদিকে যক্ষ্মার সঙ্গে ঘাতক ব্যাধি এউডসের জোট বাধা নিয়েও আমরা চিনত্মিত। এইডস যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা ব্যাহত করছে। আর একটি হিসেবে দেখা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বে যক্ষ্মা রোগ আবার বিসত্মার লাভ করছে এবং বিসত্মৃত হচ্ছে এইডস রোগীর সংখ্যাও। তাই এখনই আমাদের ব্যাপকভাবে সচেতন ও তৎপর হতে হবে। যাতে করে রেজিস্ট্যান্টস জীবাণু ঘটিত যক্ষ্মার বিসত্মার কমিয়ে আনা যায়। তার জন্য প্রয়োজন রোগীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পুূর্ণমাত্রায় নিয়মিত ওষুধ খাবার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা এবং ভাল মানের ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখা। এ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে-রোগীকে প্রতিদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে স্বাস্থ্যকমর্ীর মাধ্যমে ওষুধ সেবন করতে হয়। ফলে রোগীর দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজ বাদ পড়ে যায়। এবং রোগী আর্থিকভাবে ৰতিগ্রসত্ম হয়ে থাকে। যাতায়াতের জন্য অনেক সময় নষ্ট হয়। যাতায়াত খরচ রোগীর পৰে বহন করা সম্ভব নাও হতে পারে। যাতায়াত খরচ যা তা দিযে প্রতিদিনের ওষুধ বাজার থেকে কিনেও খাওয়া সম্ভব। অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক রোগীর পৰে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসে প্রতিদিন ওষুধ সেবন করা সম্ভব না হতে পারে। তাই আর্থিকভাবে ৰতিগ্রসত্ম রোগীদের ৰতিপূরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগীদের ওষুধ সেবনের ব্যবস্থা করা। স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে রোগীদের ওষুধ সেবনের ব্যবস্থা করা। এৰেত্রে এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, মসজিদের ইমাম, স্কুলের শিৰক, গ্রাম প্রধান অথবা এলাকার শিৰিত সচেতন যে কোন লোক স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন করতে পারেন।
যক্ষ্মার এ ভয়াবহতা অনুধাবন করে বাংলাদেশে যক্ষ্মার সংক্রমণ কমাবার লৰ্যে এবং যক্ষ্মা যাতে বাংলাদেশের মত গরিব দেশে স্বাস্থ্য সেবার ৰেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে না পারে সে লৰ্যে দ্রম্নত রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসার জন্য বিশেষ করে ছোঁয়াচে যক্ষ্মা রোগীর দ্রম্নত চিকিৎসা এবং যক্ষ্মার সংক্রমণরোধ করার লৰ্যে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৯৯৩ সালে বহুল আলোচিত ডটস কার্যক্রম হাতে নেয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের ৪টি উপজেলায় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ পাইলট প্রজেক্ট শুরম্ন করে এবং বর্তমানে উপজেলা, জেলাসহ সকল সরকারী ও বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ কার্যক্রমের লৰ্য হচ্ছে ৭০% ছোঁয়াচে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা এবং তাদের ৮৫% চিকিৎসার মাধ্যমে রোগমুক্ত করা। ডটস কার্যক্রমে চিকিৎসার ব্যয় খুবই কম এবং যেহেতু রোগী প্রথম দুই মাস স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান অথবা সংশিস্নষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীর নিকট উপস্থিত হয়ে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে থাকেন তাই অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে রোগ নির্ণয় নিরাময় আশাব্যঞ্জক। তবে এ কার্যক্রম সফল করার জন্য প্রয়োজন সর্বাগ্রে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ ও অর্থ যোগান দেয়া। সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল তৈরি করা। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাদানে কর্মরত স্বাস্থ্য কর্মীদের অনত্মভর্ুক্তি এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা। রোগীর সঠিক তথ্য সংরৰণ এবং নিয়মিত পর্যালোচনার ব্যবস্থা রাখা। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের এ কার্যক্রমে একজন নতুন যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসার জন্য মাত্র ৩০০০/- টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে এবং যদি কোন কারণে রোগী এমডিআর জীবাণু আত্রানত্ম হয়, তখন এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১ লৰ টাকা। তাই বাংলাদেশের মত গরিব দেশে নিয়মিত এবং প্রত্যৰ তত্ত্বাবধান চিকিৎসার কোন বিকল্প নেই। তাই বিগত বছরে কার্যক্রমের সফলতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বর্তমানে দেশের সকল জনগোষ্ঠী এ কার্যক্রমের আওতাধীন আছেন। দেশের ৬ লাখ ছোঁয়াচে রোগীর ৭০% বর্তমানে রোগ নির্ণয় শেষে চিকিৎসা পাচ্ছে। ফলে যক্ষ্মা আক্রানত্ম ৮৪% রোগী রোগমুক্ত হচ্ছে এবং ছোঁয়াচে রোগীদের মধ্যে প্রায় ৮০% চিকিৎসায় সফলতা লাভ করছে।
অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিকুর রহমান
অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন
জাতীয় বৰব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.