নতুন ইতিহাস ফের বিজয়ী বাঙালী ৩৪ বছরের দীর্ঘ লড়াইয়ে- কলঙ্ক মুক্ত জাতির

পুবের আকাশে শুকতারা উঠতে তখন কয়েক ঘণ্টা বাকি। রাতের শেষ প্রহর তখন আকাশের গায়ে জেগে উঠতে শুরম্ন করেছে। তখনও ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নারী-পুরম্নষ।
তাদের ভেতর কেউ কেউ নীরবে তাকিয়ে আছে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখের রঙিন মূর্তির দিকে। নিয়ন বাতির আলোয় জ্বল জ্বল করছে চমশার ভেতর দিয়ে সে চোখ দু'টো। মূর্তিটির সামনের বেদি ওই রাতেই ছেয়ে গেছে ফুলে ফুলে। পেছনে নিসত্মব্ধ অন্ধকার একটি বাড়ি। যে বাড়ির ভেতর রাখা আছে মোটা ফ্রেমের এ চশমাটি। কারও ব্যবহারের জন্য কোন টেবিলে নয়; জাদুঘরের সামগ্রী হিসেবে। তবে রাজপথের মানুষের প্রাণের স্পন্দনে আজ যেন এ মূর্তির চোখে আলো জ্বলে উঠেছে। নিসত্মব্ধ বাড়িটি অন্ধকারেও যেন বাঙ্ময়।
বৃহস্পতিবারের রাতের প্রথম প্রহরে আজ এ বাড়িটির সামনে এসেছে বিজয়ী মানুষ। তারা উলস্নাসে, শ্রদ্ধায় নানান প্রকাশ ঘটিয়েছে। অনেকে চলে গেছে, অনেকে রাতের শেষ প্রহরেও এখানে আছে। আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে এমনই শেষ রাতে এ বাড়ির সামনে মানুষ নয়, এসেছিল মানুষের রূপধারী একদল পশু। তারা এসেছিল সশস্ত্র অবস্থায়। এখানে এসে তারা হত্যা করেছিল গোলাপের থেকে সুন্দর ও পবিত্র এক শিশুপুত্রকে। তারা হত্যা করেছিল, নতুন করে পৃথিবী সাজাতে মেহেদি রাঙা হাতে যে তরম্নণী নববধূ হয়ে এসেছিল স্বপ্নভরা যুবকের হাত ধরে_ তাকে মেহেদি শুকানোর আগেই। আর যে চশমাটি এখন এ বাড়ির জাদুঘরসামগ্রী_ গুলিতে ছিটকে পড়েছিল, সে চশমাটি। তাদের গুলিতে বুক ঝাঝরা হয়ে রক্তাক্ত হন হিমালয়ের চেয়ে বিশাল এক মানুষ। হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে, তাঁর সময়ের তিনি ছিলেন পৃথিবীর সব থেকে উঁচু মানুষ। তিনি আমাদের জাতির জনক। আমাদের রাষ্ট্রের স্রষ্টা। চিরকালের অবহেলিত, নিপীড়িত একটি পশ্চাৎপদ জাতির তিনি পিতা। তাঁকে যারা হত্যা করেছিল তাদের সামনেও তিনি নেমে এসেছিলেন পিতার মতো বিশাল এক বুক নিয়ে। নির্মম ঘাতকরা সে বুকেই চালিয়েছিল গুলি।
তারপর দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর কেটে গেছে এ জাতির জীবন থেকে। জাতি কেবলই পরিচিত হয়েছে পিতৃহনত্মা জাতি হিসেবে, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। কয়েক খুনী আর ষড়যন্ত্রকারীর কাজের দায় বহন করতে হয়েছে প্রতিমুহূর্তে, প্রতিৰণে জাতিকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতের প্রথম প্রহর থেকে এখানে যারা এসেছিল, তারা ভারমুক্ত। তাদের মুখের ভাষা, বুকের ভাষা বার বার বলতে থাকে, পিতা তোমার হত্যাকারীকে আজ আমরা ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়েছি। আমরা কিছুটা হলেও পাপমোচন করেছি। ইতিহাসের চরম সত্যকে প্রকাশ ঘটিয়ে তাই তারা যেন জানিয়ে যায়_ খুনীরা এসেছিল তস্করের মতো আর আমরা এসেছি বিজয়ী বেশে। তারা তোমার এ বাড়ির সামনে এসেছিল রাতের অন্ধকারকে আরও গাঢ় করতে, আমরা এসেছি নতুন দিনের সূর্যকে আহ্বান জানাতে।
সত্যিই ইতিহাসের পাতা বলবে, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে নতুন সূর্য ওঠার দিন। যে সূর্যকে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর গ্রহণের কালো ছায়া ঢেকে রেখেছিল, বৃহস্পতিবার সকালে কলঙ্কের গ্রহণমুক্ত হয়ে সেই সূর্যই উঠল বাংলাদেশে। ৩২ নম্বর বাড়িতে জাতির জনককে চৌত্রিশ বছর আগে হত্যা করার ভেতর দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল এ জাতির সংবিধানকে; আইনের শাসনকে। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর পরে সেই আইনের ভেতর দিয়েই শাসত্মি দেয়া হলো ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারের পাঁচ জঘন্য খুনীকে এবং এ পাঁচ খুনীকে ফাঁসি দেবার ভেতর দিয়ে বাঙালী তার হাজার বছরের ইতিহাসে আরও একবার প্রমাণ করল, বাঙালী মাথা নোয়াবার জাতি নয়। সে বিজয়ী হয়। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর খুনী ও খুনীদের সহযোগীর বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম করে বাঙালী জয়ী হলো। ১৯৭১ সালে বাঙালী যেমন বিস্ময়কর বিজয়ের ভেতর দিয়ে বিশ্ব বুকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব্ব অর্জন করেছিল। তেমনি এবারও প্রমাণ করল নিজের শ্রেষ্ঠত্ব। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দেশে দেশে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক নেতাদের হত্যা করা হয়; যা ছিল মূলত সাম্রাজ্যবাদী চক্রানত্মের এক নোংরা ও জঘন্য খেলা। তাদের এ খেলায় নিহত হয়েছেন আলেন্দে থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিব অবধি। একের পর এক দেশে এসেছে সামরিক শাসন। ঘটেছে সামরিক অভু্যত্থান। এ সামরিক অভু্যত্থানকারীরা অনেক জায়গায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে গণঅভু্যত্থানের তোড়ে। কিন্তু কোথাও বিচার করে কেউ শাসত্মি দিতে বা ফাঁসি দিতে পারেনি সামরিক অভু্যত্থানকারী সেনা সদস্যদের।
বাঙালী যেমন '৫২ থেকে সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে '৭১ এসে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে প্রমাণ করেছিল বাঙালী শ্রেষ্ঠ, তেমনি আবার ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ২০১০-এর ২৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহরে এসে সামরিক অভু্যত্থানকারী খুনীদের ফাঁসি দিয়ে প্রমাণ করল, বাঙালী শ্রেষ্ঠ।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর একদল তরম্নণ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরম্নদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল, তারাও এসেছিল এ বাড়িটির সামনে বৃহস্পতিবারের রাতের এ প্রহরে। এদের সংগ্রাম থেকে শুরম্ন করে আজকের আইনের শাসনের বিজয়ী নেত্রী শেখ হাসিনা অবধি_ এ বিশাল সংগ্রামের ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হলো বাঙালী আবার বিজয়ী হয়েছে। বাঙালীর এ বিজয়ের ভেতর দিয়ে নতুন যুগের সূচনা হলো। ১৯৭১ সালে বিজয়ের ভেতর দিয়ে বাঙালী যেমন নতুন যুগের সূচনা করেছিল এ সূর্যোদয়ের ভেতর দিয়েও সূচনা হলো নতুন যুগের। ১৯৭৫-এর হত্যাকা-ের ভেতর দিয়ে যেমন বাংলাদেশকে সংবিধান থেকে চু্যত করা হয়েছিল, গণতন্ত্র ও আইনের সব ধরনের শাসন থেকে বিচু্যত করা হয়েছিল। খুন ও সন্ত্রাস হয়ে উঠেছিল এ দেশের রাজনীতির ও সমাজের অন্যতম অঙ্গ। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কয়েক খুনীর ফাঁসির ভেতর দিয়ে দেশ ওই পথ থেকে বের হয়ে এলো। এখন দেশের রাজনীতি আবার আইনের কাঠামোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হলো। সমাজ থেকে সন্ত্রাস নিমর্ূল করার পথ শুরম্ন হলো। বৃহস্পতিবার রাতের প্রথম প্রহর থেকে শুধু রাজধানীতে নয়, সারাদেশে যে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে শুরম্ন করেছে, মানুষ যে রাতের অাঁধারেও ঘর ছেড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে রাসত্মায় নেমে এসেছিল_ এ কেবল '৭৫-এর খুনীদের ফাঁসি হয়েছে বলে নয়। এ আনন্দ মূলত আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠার আনন্দ। কারণ এখন মানুষ নিশ্চিত হতে পেরেছে, '৭৫-এর খুনীদের যখন বিচার করতে সমর্থ হয়েছি, তখন বিচার হবে '৭১-এর খুনীদের। কারণ '৭৫-এর খুনী ফারম্নক যেমন দম্ভভরে এ বাংলাদেশে ঘুরেছে। তাদের দোসরদের সহযোগিতায় সংসদে গেছে। '৭১-এর খুনী আলী আহসান মুজাহিদরা এখনও সেই দম্ভ করছে। মাত্র কয়েকদিন আগেই '৭৫-এর খুনীদের স্যালুট জানাতে হয়েছে। মানুষ তাদের সামনে অনেকটা অসহায় ছিল। এখন তারা শক্তি পেয়েছে। তারা নিশ্চিত, বিচার হবে '৭১-এর খুনীদেরও। ফাঁসিতে ঝোলানো সম্ভব হবে ২১ আগস্টের খুনী ও তাদের মূল পরিকল্পনাকারীদেরও।
'৭৫-এর পরদিন থেকেই প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরম্ন হয়েছিল আর তার শেষের সূচনা হলো পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে। পরবর্তী প্রজন্ম ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ এ খুনীদের বিচারের পৰে রায় দিয়েছিল বলে আজ বাংলার মাটিতে ফাঁসি হলো '৭৫-এর খুনীদের। খুলে গেল দ্বার সকল খুনীর বিচার করে ফাঁসি দেবার। '৭১, '৭৫, ২১ আগস্ট সব খুনীর। নতুন প্রজন্ম এ নতুন ভোর এনে দিল। ওরা মহামানবকে হত্যা করে অন্ধকার এনেছিল, নতুন প্রজন্ম আইনের শাসনের ভেতর দিয়ে পশু হত্যা করে আলো নিয়ে এলো। তাই আজ ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গোপসাগর অবধি ছড়িয়ে গেছে নতুন ভোরের আলো। খুনীদের ফাঁসি হলো। জাতির কলঙ্কমোচনের পর বাঙালী বিজয়ী হলো। যে বাড়িতে এসেছিল তস্করের পায়ে খুনীরা, ওই বাড়িতেই রাতের শেষ প্রহরে এলো বিজয়ী মানুষ ফুল হাতে।

No comments

Powered by Blogger.