অন্দরে নির্বাসিত- বলতে চাই

বিশ শতক থেকে নারী-প্রগতির যুগ শুরম্ন হয়েছে। আজ আর তারা অবরোধবাসিনী নন। সমাজের সর্বেেত্রই তাদের বিচরণ, তাদের কার্যকারিতা সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও কি তারা সমঅধিকার পাচ্ছে? এ প্রশ্ন বিবেকবান মানুষকে অবশ্যই নাড়া দেয়।
এক যুগে মেয়ে সনত্মানকে জন্মের পর মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। আজ আর তা বাবা-মা করেন না। বরং সাদরে লালন-পালন করে এক সুপাত্রের(?) সংসারে তাকে অধিষ্ঠিত করতে প্রয়াস পান। কিন্তু আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করি দেখতে পাই বাসত্মব চিত্র। সে যেন মেয়েদের এক অগি্নপরীার জীবন। অধিকাংশ েেত্র পাত্রীর মা-বাবা পাত্রের বাড়ির কাছে যেন জিম্মি হয়ে থাকেন। নানাভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন মেয়ের স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির_ পোষা বেড়ালকে পর্যনত্ম। আমি জানি, অনেক পুত্রের মায়েরা আমার এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুষ্টিমেয় সংসার ছাড়া অধিকাংশ মেয়েদের বিবাহিত জীবন দুঃসহ বেদনাময়। অনত্মঃপুরের অনত্মরের সীমাহীন বেদনার খোঁজ আমরা ক'জন করি। স্বামী দেবতা, তাই তাদের নির্যাতনের কাহিনী বুকে চেপে রেখে নিষ্প্রাণ কাষ্ঠ পুত্তলিকা অথবা ঘরে সাজাবার জন্য বনসাই হয়ে যাচ্ছেন আমাদের শত-সহস্র মায়েরা। তাদের গর্ভে জন্ম নিচ্ছে না রাজা রামমোহন রায়, শেরেবাংলা অথবা বঙ্গবন্ধুর মতো সনত্মান। ভীত-শঙ্কিত, নির্যাতিত মায়েদের গর্ভে দুর্বল, ভীতু অসুস্থ অথবা সন্ত্রাসী সনত্মান জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা বেশি। আজ রসু খাঁদের দল ভারি হয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের স্বামী দেবতারা যারা বীরদর্পে বলিষ্ঠভাবে সমাজে মুখোশ পরা ফেরেশতা সেজে ঘুরছেন। আপনাদের উত্তরসূরিদের কথা চিনত্মা করে গর্ভধারিণীদের যোগ্য মর্যাদা দিন। দেশের ভবিষ্যৎ, আগামী প্রজন্মের ওপর। সে কথা মনে রেখে পদপে গ্রহণ করলে এক নির্মল/নিরাপদ ধরণী আমরা পাব।
আমি ফেরেশতা স্বামী অর্থাৎ ফেরেশতার মতো ভাল স্বামীদের কথা বলছি। তাদের অনেকের অন্দর মহলের নির্বাসিত স্ত্রীদের হাহাকার ধ্বনি শুনলে এক ভিন্ন চিত্রের সন্ধান মিলবে। নাম না জানা মেয়ে ধরম্নন সখিনা, স্বামী বড় চাকুরে। ফেরেশতার মতো ভাল সবাই বলে। তার অধিনস্থ কর্মচারীর নতুন বিয়ে করা বউ তার বাড়িতে ২ দিনের জন্য রেখে কর্মচারীটি বাইরে গিয়েছিল। দুদিন পর এসে দেখল বউটি ফ্যানের সঙ্গে কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কারণ অজানা। পুলিশ এলে বস বললেন মেয়েটি ঊসড়ঃরড়হধষ ছিল। স্বামী বাইরে যাওয়ায় অভিমানে এ কাজ করেছে। গরিব কর্মচারীর চাকরির মায়ায় টুঁ শব্দ করতে সাহস পেল না। আর সখিনা লজ্জায়-ঘৃণায় স্বামীর সঙ্গে আর সহজ হতে পারেনি। নিতে পারেনি কোন সনত্মান। কিন্তু সংসার ছেড়েও যেতে পারেনি। ফেরেশতা স্বামীর মুখোশ খুলতে চেষ্টা করলে তাকে হয়ত পাগলা গারদে যেতে হতো। আর ঝর্ণার কথা বলি। বিয়ের দিন বরের বেশে নিজের দোজবরে বিপত্নীক দুলাভাইকে দেখে ঝর্ণা রাসত্মায় দৌড়াতে দৌড়াতে অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরতেই বিয়ে। বিয়েতে তার মতামত নেয়ার চিনত্মা কেউ করেনি। এত ভাল বর কেবল বয়স বেশি আর দুটি বাচ্চা। সে তো নিজের বোনের বাচ্চা। কিন্তু ঝর্ণা আর সম্পূর্ণ সুস্থ হলো না। ভারসাম্যহীন অবস্থায় তার সনত্মান জন্মাল। কিন্তু একটি নির্বোধ, আর একটি বিকলাঙ্গ। ধরম্নন লম্বা চুলের মেয়ে শিতি মিনার কথা। তার চুল দেখে মুগ্ধ হলো বড় লোকের এক ছেলে। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই যে মিনার বড্ড ঘুম পায়। গভীর রাতে স্বামী কাজ সেরে এলে তার ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়। এই অপরাধে একদিন তার লম্বা চুল ধরে মাটিতে ফেলে দিয়ে লাথি মেরে ঘুম ভাঙ্গালো মিনার। অনত্মঃসত্ত্বা মিনার প্রচুর রক্তপাতে সনত্মানটি আর নিষ্ঠুর পৃথিবীর আলো দেখতে পেল না। প্রাণচঞ্চল শিশুর মতো নিষ্পাপ মেয়েটি সত্মব্ধ হয়ে গেল। লম্বা চুলগুলো কেটে ছোট করে ফেলেছে। সম্ভাবনাময় এক মমতাময়ী মা হয়ত আর ফুলে ফলে ভরে উঠবে না। সাদরে লালন করা চারাগাছটি মহীরূহে পরিণত হবে না_ সে এক সাজানো বনসাই হয়ে জীবন কাটাবে। নিজ আত্মার অবমাননার কথা চিরদিন বুকে চেপে রাখতে হবে। অর্ধবৃদ্ধা রমণী যদি তার ৮/১০ সনত্মানের জন্মদাতা স্বামীকে যেঁচে বিয়ে করান তবে তাকে নিয়ে হাসবেন না চমকাবেন না_ তার স্বামী বড়ই পরহেজগার। পবিত্র মানুষ। ২য় বিবাহ তো জায়েজ আছে। তিনি কখনও না জায়েজ কাজ করেন না। স্ত্রী তার অর্ধাঙ্গিনী বোঝতে পারছেন তিনি অচল হয়ে পড়ছেন। তাই স্বামীর মর্মবেদনা(?) বুঝে তিনি এ কাজ করতে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু স্ত্রীর এ লজ্জা, এ মর্মবেদনা যে কত গভীর তা কি উপলব্ধি করবেন ফেরশতা স্বামী? দূরবীন দিয়ে দেখুন। আপনি আপনার আশপাশেই দেখতে পাবেন এদের। দেখবেন এদের হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে কত কান্না। আরও একটি লজ্জার কথা এই যে, প্রায়ই দেখতে পাই, মহিলাদের বিরম্নদ্ধে মহিলারাই যেন কথা বলতে অত্যনত্ম উৎসাহী। আমরা যখন শাশুড়ির পদমর্যাদা পাই তখন অতীতের নির্যাতন-নিপীড়ন যার ভুক্তভোগী আমরাই ছিলাম, সে স্মৃতি আমাদের পুত্রবধূদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে না। বরং আমরা জিঘাংসাপরায়ণ হয়ে উঠি। পুত্র এবং বধূর মধ্যে মধুর সম্পর্ক আমাদের বিচলিত করে তোলে। এর কারণ মনসত্মত্ত্ববিদরা হয়ত বলতে পারবেন। নির্যাতিত সব মেয়েদের প থেকে অনুরোধ, অনুগ্রহ করে ড়িসবহ ধমধরহংঃ ড়িসবহ-এ আমরা যেন রূপানত্মরিত না হই। ডড়সবহ ভড়ৎ ড়িসবহ হওয়ার চেষ্টা করম্নন। আমাদের সবার সনত্মানের সুন্দর এক ভবিষ্যত গড়ার জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বাইরের জগতে পুরম্নষ স্বামী যে গৌরব নিয়ে চলেন অনত্মঃপুরেও তার প্রতিছায়া বিদ্যমান রাখুন। পেশায় শিাবিদ স্বামী কিন্তু তার স্ত্রীর বিয়ের পর লেখাপড়া হয় বন্ধ। কিন্তু কেন? মনে হয় স্ত্রীদের ডানা ছাঁটা পাখি অথবা কাচের বাক্সে ভরা বনসাই করার দায়িত্ব এসব মুখোশধারী ফেরেশতা স্বামীরা গ্রহণ করেছেন। অনুগ্রহ করম্নন, আগামী প্রজন্মকে আমাদের উত্তরাধিকারীদের ভবিষ্যত আলোকময় করার চেষ্টা করম্নন। অন্যথায় তথাকথিত ফেরেশতাদের নেকাব খোলার দায়িত্ব আমাদের উত্তরসূরিরা গ্রহণ করবে। আমরা অপরাজিতা। পরাজিত হব না। আমার স্বামী সত্যিকার অর্থে একজন ভাল মানুষ ছিলেন। আমি একজন সুখী স্ত্রী এবং সু-সনত্মানের জননী। কিন্তু আমার পৃথিবী তো শুধু এদের নিয়ে নয়। চারিদিকের হাহাকার ধ্বনি আমাকে বিচলিত করে, অবসরের আনন্দকে করছে বিধ্বসত্ম। কিন্তু এও জানি আমার ভাল মানুষ স্বামী ও তাঁর জাতিকে নিয়ে আমার এই সমালোচনা হয়ত পছন্দ করতেন না। তার বিদেহী আত্মার কাছে মা প্রার্থী। কারণ আমি বলতে চাই।
ম আমেতুল খালেক বেগম
সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.