চট্টগ্রাম বন্দরে ১০০ বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে চাঞ্চল্য by মহিউদ্দীন জুয়েল

বিএমডব্লিউ, পাজেরো কিংবা মার্সিডিজ বেঞ্জ। কোটি টাকার সব দামি গাড়ি। দেখতে ঝকঝকে। নানান  রঙের। কালো গ্লাস। অত্যাধুনিক। সহজে কাত হয় না। ভেতরে এসি। যারা চড়েন তারা হাইফাই। দেশের অনেক মন্ত্রীকে চড়তে দেখা যায়।

বিলাসবহুল এমন ১০০ গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রামে এখন ব্যাপক চাঞ্চল্য। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে এগুলো পড়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর সব ক’টির মূল্যই কোটি টাকার বেশি। কোনটি আনা হয়েছিল শুল্কমুক্ত সুবিধায়। দেশের বাইরে থেকে। পরে বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আবার কোনটি মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করার সময় আটক হয়েছে। বর্তমানে এসব গাড়ির খোঁজ নেই বেশির ভাগ মালিকের। আসল মালিকদের অনেকে দুদকের ভয়ে সেগুলো ছাড়িয়ে নিতে আসছেন না। কেউ কেউ জাল কাগজপত্র দিয়ে সেগুলো ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও ধরা পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে গাড়িগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তারা খালাস কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, বিগত সময়ের চেয়ে চলতি বছর দামি গাড়ি আমদানি করতে গিয়ে জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটন করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কেবলমাত্র বিএমডব্লিউ, পাজেরো কিংবা মার্সিডিজ বেঞ্জ নয়, কারসাজির ঘটনায় ধরা পড়েছে লেক্সাস ও মিৎসুবিসি মডেলের অনেক কার-জিপ। চট্টগ্রাম কাস্টমস ও গাড়ি ব্যবসায়ীদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চলতি বছরের মাঝামাঝিতে বন্দরে আটক করা হয় ৬টি বিলাসবহুল গাড়ি। এর আনুমানিক মূল্য ১৫ কোটি টাকা। কাস্টমস কর্মকর্তা ও কতিপয় আমদানিকারক সিন্ডিকেট ‘কারনেট’ সুবিধায় এসব গাড়ি নিয়ে আসে। গাড়িগুলোর মধ্যে ছিল বিএমডব্লিউ জিপ, লেক্সাস জিপ, মিৎসুবিসি ও পাজেরো জিপ।
এক শ্রেণীর প্রবাসী বাংলাদেশী ও বিদেশী নাগরিকরা এদেশে চলাচলের জন্য তাদের ব্যবহৃত গাড়ি আনতে পারেন বিনাশুল্কে। একে বলে কারনেট। এই নিয়মে তারা দেশছাড়ার সময় বিদেশে চলে যাওয়ার পর গাড়িগুলো নিয়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এই কাজে নিয়োজিত শক্তিশালী সিন্ডিকেটটি সরকারের শুল্কবিভাগকে ফাঁকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে গাড়িগুলো কিনে নিচ্ছে। পরে তা বাজারে চড়াদামে বিক্রি করে দিচ্ছে। আটক ৬টি গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে ওই সময় ইকবাল নামের এক গাড়ি ব্যবসায়ীর কাস্টমস নিলাম বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মাত্র ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টার কথা শোনা যায়। এ ঘটনা পড়ে জানাজানি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে গাড়ি আমদানির ঘটনা নতুন নয়। তবে এই ক্ষেত্রে জালিয়াত সিন্ডিকেট চক্র কৌশল পাল্টেছে। বছরের শুরুর দিকে এমনি একটি ঘটনায় বেরিয়ে এসেছে ঢাকা ইপিজেডের গোলটেক্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নাম।
এই প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রিক্সের কন্টেইনারে অত্যাধুনিক মডেলের বিএমডব্লিউ ও এডি গাড়ি নিয়ে এসেছিল। পরে এই ঘটনায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ। পরে এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, গাড়ির চালানটি খালাসের দায়িত্ব ছিল নগরীর ২৪০ ডিটি রোড ঠিকানার মেসার্স শিমুল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি সিএন্ডএফ এজেন্ট।
তাদের শিপিং এজেন্ট ছিল হালিশহর জি ব্লকের মেসার্স কোলিয়ার শিপিং লিমিটেড। চট্টগ্রাম বন্দরে স্ক্যানিং করে চাঞ্চল্যকর এই জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটন করা হয়। এতে খোঁজ মেলে ৩ হাজার সিসি’র ৭৩০-আই মডেলের বিএমডব্লিউ গাড়ি ও আরেকটি ১৯৮৪ সিসি’র এ-৪ মডেলের এডি গাড়ি। আটক বিলাসবহুল বিএমডব্লিউ গাড়িটির মোটর ভেহিক্যাল রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ৮, ইঞ্জিন নং-৩১৮৯৯৬৮৯। এই ঘটনায় শুল্কসহ প্রায় ৫ কোটি টাকার ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের একটি সূত্র জানায়, গত এক বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনায় আটক হওয়া এসব গাড়ি এখন বন্দরের শেডে রাখা হয়েছে। তবে এর অনেক গাড়ি কৌশলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে বাইরে খালাস করা হয়েছে। খালাস করে সেগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছেন আমদানিকারকরা। ঢাকার গুলশানের ইমতিয়াজ চৌধুরী এবং সিলেটের রায়নগরের আলমগীর হোসেনের নামে আমদানি করা দু’টি ল্যান্ড রোভার গাড়ি জাল কাগজে খালাস হয়ে গেছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। জালিয়াত চক্রের কয়েকজন সদস্য জানান, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নকল কাগজপত্রের মাধ্যমে বিলাসবহুল এসব গাড়ি খালাসের চেষ্টা করছে বেশ কয়েকটি চক্র। খালাসের আগে বাংলাদেশ অটোমোবাইল এসোসিয়েশন থেকে নিশ্চয়তাপত্র তৈরি করা হচ্ছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ৫০টি জালপত্র জব্দ করেছে। কেবল তাই নয়, ব্যাংক গ্যারান্টির বদলে জালিয়াত চক্র এএবি থেকে কাউন্টার গ্যারান্টি নিচ্ছে। এরপর তারা কারনেট সুবিধায় গাড়ি ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে এএবি’র সভাপতি আজমালুল হোসাইন জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি ও অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির স্বাক্ষর জাল করে এই কাজটি করা হচ্ছে। পরে এই বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় গাড়ি খালাস কার্যক্রম।
এব্যাপারে জানতে চাইলে কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মাহমুদুল হাসান বলেন, বেশ কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ার পর আপাতত গাড়ি খালাস হচ্ছে না। গাড়িগুলোর বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।
কাস্টমস ও বন্দরের দু’টি সূত্র জানায়, কারনেট সুবিধায় আমদানি করা বেশির ভাগ গাড়ি এদেশে এসে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বৃটেনে বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিকদের একটি চক্র এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। সমপ্রতি কাস্টমসের এক অনুসন্ধানে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে। বর্তমানে খালাস হয়ে যাওয়া অনেক গাড়ি শুল্ক না দিয়েই লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এসব গাড়ি অনুসন্ধানে নেমেছে তাদের তদন্ত দল। অন্যদিকে যেসব গাড়ি বন্দরের শেডে রাখা হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে সহসাই কোন সিদ্ধান্ত আসছে না। ফলে এসব গাড়ি এভাবেই পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান বাজার মূল্যে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ির দাম এক কোটি থেকে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। অন্যদিকে মিৎসুবিসি পাজেরো জিপের দাম ৯০ লাখ থেকে এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা। একটি লেক্সাস জিপের দাম ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি ৫ লাখ টাকা। একটি লেক্সাস কারের দাম ৩৬ লাখ থেকে ৯০ লাখ টাকা পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার ড. মতিউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, গাড়ি জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে কাস্টমস। সামপ্রতিক সময়ে চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদের একটি অংশ পর্যটক সুবিধায় গাড়ি নিয়ে এসে সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। তারা কৌশলে সেগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে গাড়ি ব্যবসায়ীদের কাছে। আবার আরেকটি চক্র মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বড় বড় কন্টেইনারে গাড়ি পাচার করার চেষ্টা করছে।

No comments

Powered by Blogger.