হাসন সখী by অন্নদাশঙ্কর রায়

ক্লাসে যারা ডাকসাইটে দস্যি ছেলে, পড়া বলতে পারে না, বেঞ্চির উপর দাঁড়ায়, তারা বসে পিছনের সারিতে। একদিন তাদের রাজা সূর্যমোহন এসে আমায় বললে, 'আজ থেকে তুমি হলে আমাদের মন্ত্রী। আমাদের সঙ্গে বসবে, খাতা দেখতে দেবে, প্রম্পট্ করবে। কেমন, রাজি?'


আমি নবাগত, আমার ছেলেবেলার ইস্কুল থেকে নাম কাটিয়ে পুরী জেলা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। কাউকে চিনিনে বললে হয়তো ভুল বলা হবে, কারণ আমার এক দূর সম্পর্কের দাদা আমার সহপাঠী, তারই কাছে বসি ও তারই সঙ্গে বেড়াই। এমন যে আমি, সেই আমাকেই কিনা মন্ত্রী মনোনয়ন করলেন সেকেন্ড ক্লাসের ছোট লাট সূর্যমোহন ছোটরায়।
শুনেছিলাম তাদের অসাধ্য কাজ নেই। ফুটবল খেলার সময় ফাউল করে পা ভেঙে দেওয়া তাদের নিত্যকর্ম। সন্ধ্যার অন্ধকারে ল্যাং মারা ও গলির মধ্যে অদৃশ্য হওয়া তাদের অভ্যাস। আমার যদিও ফুটবল খেলার ব্যসন ছিল না, সমুদ্রতীর থেকে বাসায় ফিরতে প্রায়ই অন্ধকার হত। বাসা ছিল গলির ভিতরে, সুতরাং ভয়ের হেতু ছিল। আমি আর কথা কাটাকাটি না করে পিছনের সারিতে মুখ ঢাকলুম।
এই ঘটনা যে কেউ লক্ষ করবে অতটা আমি ভাবিনি। আমি অপরিচিত নগণ্য ব্যক্তি, কেই বা আমাকে চেনে? কিন্তু দিন কয়েক পরে আমাদের ইংরেজি মাস্টার কেশববাবু আমাকে অযাচিত অপমান করলেন আমি খারাপ ছেলেদের একজন বলে। তার পর কী মনে করে আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, 'ওভ ুড়ঁ ধিহঃ ঃড় নব ধ মড়ড়ফ নড়ু ভড়ষষড় িসু ঘরষঁ.'
কেশববাবুর ছেলে নীলাদ্রি পড়ত আমাদেরই ক্লাসে, বসত সামনের সারিতে। সত্যিকারের ভালো ছেলে, ফার্স্ট সেকেন্ড হত। আমি তার সঙ্গে আলাপের চেষ্টা করিনি, সেও আমার সঙ্গে না। আমি লাজুক, সে অহংকারী। অন্তত লোকে তো তাই বলে। তার বাবা যখন এত মানুষের মাঝখানে আমাকে অপমান করে গেলেন তখন আমিও আমার মুখরক্ষার জন্যে তার কথাগুলির অন্য অর্থ করলুম। আমার দুষ্ট ছেলের দলটিকে মন্ত্রণা দিলুম, 'ওহে মাস্টার মশাই কী করতে বললেন শুনলে তো। নীলুকে ফলো করতে হবে। তার মানে, নীলু যখন যেদিকে যাবে তোমরাও তখন সেই দিকে যাবে। কিন্তু খবরদার, নীলু যেন টের না পায়।'
সে দিন থেকে আমাদের মন্ত্র হল নীলুকে ফলো করো। আমরা ওটার উপর বাঁদরামি ফলিয়ে ওর উচ্চারণ করতুম, ফল্লো মাই নীল্লো!
তখন ঠাহর হয়নি এর পরিণাম কী হতে পারে। একদিন আমাদের দলের দীনকৃষ্ণ এসে আমার কানে কানে বললে, 'জানিস, ও কোথায় যায়?'
'কোথায়?'
'কাউকে বলিসনে। সমুদ্রের ধারে একটা ছোট দোতলা বাড়ি আছে, চক্রতীর্থের দিকে। সেখানে রোজ বিকেল বেলা নীলু গিয়ে কাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, শুনবি?'
'কাদের সঙ্গে?'
'মেয়েদের সঙ্গে!'
ডিটেকটিভ বই পড়েও আমি এমন রোমাঞ্চিত হইনি। সেদিন আমার ইচ্ছা করছিল দুনিয়ার লোককে ডেকে বলতে, আহা! নীলু কেমন ভালো ছেলে দেখলেন তো আপনারা! ফল্লো মাই নীল্লো!
মেয়েদের উল্লেখ শুনে আমি আমার মুখখানাকে যথাসাধ্য সাধু সন্ন্যাসীদের মতো করে বললুম, 'আমরা দুষ্টু ছেলে বটে, কিন্তু দুশ্চরিত্র নই। আমাদের আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ, আমরা কি কখনো মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারি!'
দীনু বললে, 'মেশা দূরে থাক, ওদের কাছে যেতেই আমার বুক ধুকপুক করে। একটি মেয়ে যেই নিচে নামল আমি দিলুম ভোঁ দৌড়। নীলুর, যাই বল, সাহস আছে।'
আমি সেদিন আবিষ্কার করলুম যে আমরা দুজনেই সমান ভণ্ড। যেমন আমি তেমনি দীনু। আসলে আমরা নীলুর অনুসরণ করতে পেলে বাঁচি। দুনিয়ার লোকের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা দুই ভণ্ড সন্ন্যাসী নীলুর পিছু নিলুম। বুক ধুকপুক করছিল বটে দুজনেরই কিন্তু মেয়েদের জন্য নয়, তাদের অভিভাবকদের ভয়ে। মুখে বোলচাল দিচ্ছিলুম, 'নীলুটাকে ধরিয়ে দিতে হবে।' কিন্তু অন্তরাত্মা জানেন যা মনে মনে বলছিলুম। 'যদি ধরা পড়ি তখন?' তখন অবশ্য ভোঁ দৌড়।
বাড়িটার নাম 'ঊর্মিমুখর'। ছোট দোতলা বাড়ি। ফিকে নীল রং। সমুদ্রের হাওয়ায় ছিল সমুদ্রের স্বনন। বাড়িটা সার্থকনামা।
আমরা ওর পাশে ঝিনুক কুড়োতে বালু খুঁড়তে আরম্ভ করে দিলুম গুটি কয়েক অচেনা শিশুর সঙ্গে ভাব করে। নজর রাখলুম নীলুর উপরে। নীলু যখন দোতলায় পেঁৗছল তখন হাসির হররা উঠল তাকে দেখে, না তার পোশাক দেখে, না কী দেখে তা বোঝা গেল না। নীলুও সে হাসিতে যোগ দিলে। আমাদের কানে আসতে লাগল, হা হা। হো হো। হি হি।
নীলুটা যে এমন বাঁদর তা কে জানত। মেয়েদের সঙ্গে সমানে চাল দেয়। কখনো হাসে, কখনো গায়, কখনো খুনসুটি করে। আমরা শুনে পেলুম ওরা ওকে ভূতুম বলে ডাকছে। নামের কী ছিরি। ভূতুম! নীলুর কিন্তু তাতেই আনন্দ। সে পেঁচার মতো আওয়াজ করছে, 'হুঁম... হুঁম... হুঁম...'
দীনু বললে, 'খেতে খেতে আওয়াজ করছে বলে অমন শোনাচ্ছে।'
আমি বললুম, 'বুঝেছি, খাবার লোভেই ছোঁড়া রোজ এদিকে আসে।'
নীলু যে একজন ভাগ্যবান পুরুষ এ বিষয়ে আমাদের দ্বিমত ছিল না। না জানি কী ভালোমন্দ খায়, আমরা তো পাইনে। এতগুলো মেয়ে মিলে রেঁধেবেড়ে খাওয়ায়। হয়তো চপ কাটলেট ডিমের অমলেট। কী বলে ওকে? পুডিং। হয়তো চকোলেট টফি লজেন্স খেতে দেয়, আইসক্রিম লেমনেড সিরাপ।
আমরা স্থির করলুম নীলুর বাবাকে জানাতে হবে সে কুসংসর্গে মিশছে। আমাদের দলের টাইগারের উপর সে ভার পড়ল। ওর মতো ঠোঁটকাটা বেহায়া খুব কম দেখা যায়। মানুষের গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধায়, বিশ্রী গালাগাল দেয়। ওর মুখে কিছু আটকায় না। গুরু লঘু জ্ঞান নেই।
টাইগার একদিন মাস্টার মশায়ের পা মাড়িয়ে দিয়ে ঘটা করে পায়ের ধুলো নিলে। তারপর বললে, 'এবার থেকে নীলুরও পায়ের ধুলো নেব স্যার। সে আমাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে।'
'কেন হে?'
'সে গাছের ডালে বিচরণ করে, নাম তার ভূতুম। একটি নয়, দুটি নয়, অনেকগুলি পেচানী তার সহচারিণী।'
মাস্টার তো হতবাক। তারপরে টাইগারের কানটা নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, 'ভালো করে খোঁজ নিলে জানবে যে নীলু যায় একটি রুগ্ন মেয়েকে একটুখানি আনন্দ দিতে। মেয়েটির যক্ষ্মা, বাঁচবে কিনা সন্দেহ। সহচারিণী যাদের বলছ তাদেরও ঐ কর্তব্য। সহচরও আছে। সব ভদ্র ঘরের ছেলে, ভদ্র ঘরের মেয়ে। তোমাদের মতো ইতর নয়।'
এর পরে আমি নীলুর সঙ্গে যেচে আলাপ করি। সে একটি যক্ষ্মা রোগীকে একটুখানি আনন্দ দিতে যায়, ভূতুম সাজে, লোক হাসায়। এতে আমি তার মহত্ত্বের পরিচয় পেলুম। তাকে খুলে বললুম সমস্ত, মাফ চাইলুম। নিজের দল ছেড়ে সামনের সারিতে বসতে লাগলুম তার পাশে। ইতিমধ্যে সেও পেয়েছিল আমার বিদ্যার পরিচয়। মাস্টার মশায় আমার খাতা দেখে তাকে নাকি বলেছিলেন যে ছোকরার স্টাইল আছে।
অবশেষে সেই অনিবার্য দিনটি এল যেদিন নীলু আমাকে তার অনুসরণ করতে বললে 'ঊর্মিমুখরে'র দোতলায়। সেখানে একখানি ইজি চেয়ার পাতা, তাতে ঠেস দিয়ে বসেছিল বা শুয়েছিল আমাদেরই বয়সের একটি বিষণ্ন রুগ্ন মেয়ে। নীলু বললে, 'এ আমার হাসন সখী।' মেয়েটি একটু হাসল। 'আর আমি এর ভূতুম।'
'তোমার নাম কি বুদ্ধু?' প্রথম আলাপেই প্রশ্ন করল মেয়েটি। আমি বলতে যাচ্ছিলাম আমার নাম, কিন্তু চোখ টিপল নীলু। তখন আমি উত্তর করলুম, 'হ্যাঁ, ভাই, আমার নাম বুদ্ধু।' সে যখন আমাকে তুমি বলেছে আমিও কেন তাকে তুমি বলব না? শুধালাম 'তুমি বুঝি 'ঠাকুমার ঝুলি' পড়তে ভালোবাসো?'
'ভালোবাসি। সবচেয়ে ভালো লাগে কিরণমালার কাহিনী। আমি যেন কিরণমালা আর তোমরা যেন অরুণ বরুণ। তোমরা যেন মস্ত এক পুরী বানালে মর্মর পাথরের। আর আমি তাকে সাজালুম যত রাজ্যের মণি মাণিক্য দিয়ে। তবু কিসের যেন অভাব। তাই তোমাদের বললুম, যাও তোমরা, নিয়ে এসো সেই সোনার পাখি আর সেই মুক্তা ঝরার জল।'
মেয়েটির আসল নাম চাঁপা। এককালে ওর গায়ের রং চাঁপার মতো ছিল, এখন শুকিয়ে কালো হয়ে আসছে। মুখে এক প্রকার মাদকতা বা মদিরতা। নেশা লাগে ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকলে। দেখতে যে খুব সুন্দর তা নয়, কিন্তু তন্ময় হয়ে কথা যখন বলে তখন মনের সৌন্দর্য এসে তনুর সৌন্দর্য হয়।
সেদিন ওদের ওখান থেকে যখন ফিরলুম, তখন চোখে আমার জল। নীলু লক্ষ করলে।
বললে, 'কাঁদছিস নাকি?'
'কাঁদব না তো কী? হাসব? আমি কি তোর মতো পাষাণ?'
'আমি যে হাসি তা পাষাণ বলে নয়। হাসি ওকে হাসাতে।'
'ওকে হাসাতে চাইলেও আমি হাসতে পারব না। এ কি হাসির কথা যে একটি সুন্দর ফুল দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে! হায় ভগবান, কেন আমাদের এত অক্ষম করে সৃষ্টি করলে। কেন, কেন, ওগো একটিবার বলে দাও কেন আমরা পারব না ওকে মুক্তা ঝরার জল দিয়ে বাঁচাতে।'
নীলু শুধু বললে, 'মানছি তোর স্টাইল আছে।'
এখন যেমন আমি একজন হাস্যরসিক তখন তেমন ছিলুম না। তখন ছিলুম উচ্ছ্বাসপরায়ণ ও অরসিক। সেই যে সেদিন ফিরলুম আর ও মুখো হলুম না। নীলু ডাকলে চোখের জল মুছি। বলি, 'যেদিন পারব ওকে মুক্তা ঝরার জল এনে দিতে সেদিন যাব। তার আগে নয়।'
নীলু হাসিয়ে হাসিয়ে বলে, 'বুঝেছি। প্রথম দর্শনেই প্রেম। দ্বিতীয় দর্শনের আবশ্যক হত বিয়ের আশা থাকলে।'
আমি তাকে তাড়া করে যাই। ভাবি, নীলুটা এমন নিরেট।
পুরীতে আরো কিছু কাল থাকলে হয়তো আবার যেতুম, কিন্তু যে কারণেই হোক আমাকে আবার নাম লেখাতে হলো আমার ছেলেবেলার ইস্কুলে। পুরী থেকে বিদায় নিলুম অকালে।
প্রায় চার বছর পরে পাটনা কলেজের উত্তরে গঙ্গার ধারে বেড়াচ্ছি, এমন সময় নীলুর সঙ্গে মুখোমুখি। শুনলুম সে পাটনা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পড়ে, ওভারসিয়ার হয়ে বেরোবে। তার বাবা হঠাৎ মারা যান, তাই কলেজে পড়বার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না।
নীলু বললে, 'তোর চেহারার তো বিশেষ পরিবর্তন দেখছিনে। তোর স্বভাবটি কি তেমনি আছে? কথায় কথায় কান্না।'
'তোর শরীরটা তো বেশ খোট্টার মতো হয়েছে। স্বভাবটি কি তেমনি আছে? কথায় কথায় হাসি!'
এর থেকে হাসন সখীর প্রসঙ্গ। নীলু বললে, 'বেঁচে আছে। তার চেয়ে বড় কথা ভালো আছে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে।'
'বলিস কী! এত দূর! আমি আশ্চর্য হলুম। 'আমি ভাবছি এ অসম্ভব হলো কী করে? কে তাকে এনে দিলে মুক্তা ঝরার জল? তুই, নীলু? না আর কেউ?'
নীলু আমাকে তার হোস্টেলে ধরে নিয়ে গেল। খেতে দিলে পাটনার অমৃতি আর পল্লী অঞ্চলের ঠেকুয়া। যাক, ছাতু আর লঙ্কা খেতে দেয়নি, এই ঢের। ও নাকি নিজে তাই খেয়ে খেয়ে চেহারা ফিরিয়েছে। পাশেই কোন এক মহাবীরজির আখড়ায় ডন বৈঠক ফেলে, সাঁতার কাটে গঙ্গায়।
সে কিছুতেই স্বীকার করলে না যে তার সখী সেরে উঠেছে তার আনন্দ রসায়নে। বললে, 'দু বছরের উপর আমি পাটনায়, চাঁপা দেওঘরে। ছুটির সময় দেখা হয় অল্প কয়েক দিনের জন্যে। কাজেই আমার কৃতিত্ব কতটুকু! জানিনে আর কেউ আছে কিনা ওখানে।'
পাটনায় নীলুর পড়া শেষ হয়ে গেল আমার আগে, যাবার আগে সে আমাকে খবর দিয়ে গেল যে চাঁপার বিবাহ হয়েছে কলকাতার এক ডাক্তারের সঙ্গে। বললে, 'ওঃ। কী ভাবনাই ছিল ওর জন্যে আমার। ডাক্তার শুনে ধড়ে প্রাণ এল। ও বাঁচবে বহুকাল। চিরকাল বাঁচবে ও। ডাক্তার ঠিক বাঁচাবে ওকে। তোকে বোধ হয় বলিনি যে ডাক্তারটি প্রবীণ ও প্রসিদ্ধ। হাঁ, দোজবর।'
আমি বললুম, 'নীল, মুক্তা ঝরার জল ডাক্তারখানায় মেলে না। মানুষকে যে বাঁচায় সে ডাক্তার নয়। আমি নিশ্চিন্ত হতুম, যদি তোর সঙ্গে ওর বিয়ে হত। হাসছিস যে। তোর না হয় অর্থ নেই, কিন্তু ভালোবাসা তো আছে। তুই কিসে অযোগ্য শুনি?'
'শঙ্কর', নীলু আমার দুহাত ধরে আমার দুচোখে চোখ রেখে বললে, 'তুই বিদ্বান, তুই কবি। কিন্তু বিদগ্ধ নস্। কখনো ভালোবেসেছিস কি না সন্দেহ। যদি কোনো দিন বাসিস তা হলে দেখবি দুরকম ভালোবাসা আছে। সখার সঙ্গে সখীর। প্রিয়ের সঙ্গে প্রিয়ার। চাঁপার সঙ্গে আমার ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্যায়ের নয়, কোনো দিনই ছিল না, তুই ভুল বুঝেছিলি।'
'বুঝেছি।' আমি যেন কত বড় একটা আবিষ্কার করলুম। 'তোরা ছিলি এক হিসাবে ভাইবোন। কেমন, ঠিক ধরেছি কিনা।'
'না ঠিক নয়, বেঠিক। ভাইবোনের ভালোবাসা অন্য জিনিস। চাঁপাকে আমি বোন বলে ভাবতে পারিনে। ও আমার সখী, সই, সহেলী। এই যেমন তোর সঙ্গে আমার সখ্য তেমনি ওর সঙ্গেও। তুই কি আমার ভাই? ভাইয়ের কাছে কি সব কথা বলা যায়? তুই আমার সুহৃদ, তাই তোর কাছে আমার লুকোবার কিছু নেই। তেমনি চাঁপার কাছে।'
'কালিদাস তো গৃহিণীকেই সখী বলে গেছেন। তা হলে চাঁপা কেন তোর গৃহিণী হতে পারে না, বল আমাকে।' আমি চেপে ধরলুম।
'গৃহিণী হয়তো সখী হতে পারে, কিন্তু সখী হতে পারে না গৃহিণী। কেউ যদি জোর করে আমাদের বিয়ে দেয় তা হলেও আমরা স্বামী-স্ত্রী হব না। যদি হই তা হলে আমাদের মুখে হাসি চোখে মিলিয়ে যাবে।'
বছর পাঁচ ছয় পরে আমি বিলেত থেকে ফিরেছি, উঠেছি কলকাতার এক বিখ্যাত হোটেলে। ওরা আমার নাম খবরের কাগজে ছাপিয়েছে। ফলে অনেকেই দয়া করে আসছেন আমাকে দেখতে। বেয়ারা এক রাশ কার্ড নিয়ে এল। তাদের একখানার পিঠে ছাপা ছিল, 'নীলদ্রিনাথ গুপ্ত। মার্টিন এন্ড কোম্পানী।' পাছে চিনতে না পারি সেই জন্যে কালি দিয়ে লেখা ছিল 'নীলু'।
নীলু! আমার বাল্যবন্ধু নীলু! নীলু কলকাতায়, মার্টিন কোম্পানিতে? নীলুকেই অভ্যর্থনা করলুম সকলের আগে।
খাটো শার্ট খাটো প্যান্ট পরা এক লৌহ মানব আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল না পাঞ্জা কষল। আমি শিউরে উঠে বললুম, 'আঃ ছেড়ে দে, ভাই। লাগে।'
'হুঁ'! বাংলা মনে আছে। আমি পরখ করে দেখছিলুম, বাংলা বেরিয়ে আসে, না ইংরেজি!'
শুনলাম চাকরিতে বেশ উন্নতি করেছে, মাইনে পাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারের সমান। বললে, 'সময় একদম পাইনে। এই যে তোকে দেখতে এসেছি এ অনেক কষ্টে। চাঁপার ওখানে তোর নিমন্ত্রণ। আমি তোকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাব সন্ধ্যার পরে। তৈরি থাকবি। না, না, অন্য এনগেজমেন্ট আছে, ও কথা শুনব না। ক্যানসেল ইট। চাঁপা একেবারে অধৈর্য হয়ে উঠেছে তোকে দেখতে। ওঃ, কত কাল পরে। তুই কিন্তু তেমনি আছিস। তোর স্বভাবটিও কি তেমনি আছে?'
আমি জানতে চাইলুম চাঁপা কেমন আছে, বিয়ে সুখের হয়েছে কিনা, ছেলেমেয়ে কটি, নীলুও কি বিয়ে করেছে, ইত্যাদি। উত্তর পেলুম, নীলুর স্ত্রী চাঁপার সঙ্গে অত মাখামাখি পছন্দ করেন না, তাই চাঁপার সঙ্গে নীলুর কদাচ দেখা হয়। ওদিকে আবার ডাক্তার সাহেবেরও সেই মনোভাব, তিনিও নীলুকে প্রশ্রয় দেন না। এসব বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও তাদের বন্ধুতা অবিকল তেমনি রয়েছে। নীলুর একটি ছেলে, চাঁপার সন্তান হয়নি।
নীলু এক নিঃশ্বাসে উত্তর দিয়ে এক দৌড়ে প্রস্থান করলে। সময় নেই যে। সন্ধ্যার পর কথা রাখলে। ওর নিজের মোটরে করে আমাকে পেঁৗছে দিলে থিয়েটার রোডে। ডক্টর সেন আমাকে সাদর সম্ভাষণ করে তাঁর স্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রীর কাছে ছিলেন আরো কয়েকটি তরুণী। শুনলুম তাঁরা সকলেই মিস। কেউ ও বাড়ির, কেউ পাশের বাড়ির। বাড়ি মানে ফ্ল্যাট। আমার কিন্তু নজর ছিল না আর কারো প্রতি। আমার দৃষ্টির সবটা জুড়েছিল চাঁপা। আমাদের হাসন সখী। আমাদের কিরণমালা। আমাদের হারানো কৈশোর।
চাঁপার গায়ের রং আবার চাঁপাফুলের মতো হয়েছে, ভরন্ত দেহ, সুঠাম গড়ন। কেবল তার চোখ দুটিতে কত কালের ক্লান্তি, কত কালের নিরাশা।
'তার পর, বন্ধু, তোমাকে বুদ্ধু বলে ডাকলে ক্ষমা করবে তো? তুমি বলব না আপনি বলব?' সে হাসল। কী তন্ময় হাসি। সে যখন যা বলে, যা করে, তন্ময় হয়ে বলে, তন্ময় হয়ে করে।
'বুদ্ধু বলতে পারো, বরুণ বলতে পারো, যা বলতে তোমার সাধ যায়, যা বললে তুমি রূপকথার স্বাদ পাও।' আমি আশ্বাস দিলুম। 'না, আপনি কেন? আপনি কবে হলুম?' সেই প্রথম থেকেই তো তুমি।'
'তুমি তো এত দেশ দেখলে, এত রাজ্য বেড়ালে, ঠিক রূপকথার রাজপুত্রের মতো। কই, তোমার রাজকন্যা কোথায়?' সে তেমনি হাসল।
'রাজকন্যা এখনো ঘুমিয়ে। সোনার কাঠি খুঁজে পাইনি।'
'কিন্তু রূপোর কাঠির খোঁজ তো পেয়েছ?'
'তা পেয়েছি, কিন্তু রূপোর কাঠি ছোঁয়ালে তো সে জাগবে না। যে জাগবে না তাকে নিয়ে আমি কী করব! আমার অন্য কাজ আছে, হাসন। আমি একজন কবি।'
এমনি কত কথাবার্তা। সব সাংকেতিক ভাষায়। সে বুঝল যে আমি তার ননদদের কাউকে, তার প্রতিবেশিনীদের কাউকে বিয়ে করব না। একটু ক্ষুণ্ন হলো। তার আশা ছিল, ওদের একজনকে বিয়ে করে আমি তার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক পাতাব। তা হলে দেখাশোনা সুগম হবে। কিন্তু আমি নীলুর দৃষ্টান্ত দিলুম। বিয়ের পরে সব মেয়েই সমান। কেউ কারো স্বামীকে স্বাধীনতা দেবে না সখীর সঙ্গে মিশতে, নিজের বোন হলেও না, বৌদি হলেও না।
ডিনার টেবিলে আমি ছিলুম তার ডান দিকে, খেতে খেতে কথা বলছিলুম সাংকেতিকে। ডিনারের পর অন্যান্য মেয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হলো। হাসন তাতে খুব খুশি হলো না, নীলুকে নিয়ে বসল তাস খেলতে। আমার কানে এল, 'বুদ্ধু দেখছি এক নম্বর ফ্লার্ট। বিয়ে করবে না একজনকেও, তবু সকলের সঙ্গে রঙ্গ করা চাই।'
ডাক্তার সাহেবের লক্ষ সব সময় নীলুর উপর, আমাকে তিনি প্রতিযোগী বলে গণ্য করেননি। নীলু বেচারা সমস্তক্ষণ উসখুস করছিল, তার লক্ষ একটা ক্লক ঘড়ির উপরে। দেরি করলে তার বৌ রাগ করবে। লৌহমানবও তার বৌকে ভয় করে। আমার এমন হাসি পাচ্ছিল ভাবতে। আমি তাকে রহস্য করে বললুম, 'আজ তোর কপালে ঝাঁটা আছে।'
বিদায়বেলায় চাঁপা বললে, 'আবার যখন কলকাতা আসবে, দেখা করবে তো?' বুদ্ধু, আবার যেন দেখা হয়।' কী জানি কেন আমার চোখ সজল হলো। নীলু বললে, 'চল, তোকে রেখে আসি। ইচ্ছা ছিল এক দিন আমার ওখানে ডাকতে, কিন্তু কালকেই আমাকে মফঃস্বলে বেরোতে হচ্ছে। আসছে বার কলকাতা এলে আমার ওখানেই উঠিস।'
তারপর নানা কারণে ওদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেনি। প্রায় সাত বছর পরে ছুটি নিয়ে মিহিজামে বিশ্রাম করছি, একদিন ঠিক দুপুর বেলা একখানা মোটর এসে আমার দরজায় থামল। লাফ দিয়ে নামল একটা কুকুর, তা দেখে ছুটে এল আমার দুই ছেলে। উত্তেজিত হয়ে বললে, 'বাবা, দেখবে চলো কাদের মোটর আর কুকুর।'
বেরিয়ে দেখি সাহেবী পোশাক পরা এক ভদ্রলোক, ওভারকোট গায়ে দেওয়া শাড়ি পরা এক মহিলা। আরে, এ যে আমাদের নীলু, সঙ্গে ওর স্ত্রী রত্নাবলী। আমার স্ত্রী রান্নাঘরে ছিলেন, তাঁকে ইতিমধ্যে কুকুরের ও মোটরের খবর দেওয়া হয়েছিল, মহিলার খবর দেওয়া হয়নি। আমার ডাক শুনে তিনি বাইরে এলেন ও থাকবার নিমন্ত্রণ জানালেন। শোনা গেল নীলুরা আসানসোল থেকে এসেছে জমি কিনতে, একটু পরে আসানসোল ফিরে যাবে, থাকবে না। যদি রান্নার দেরি না থাকে খেয়ে যাবে।
আমি বললুম, 'আমরা একটার সময় টিফিন খাই, এখনো এক ঘণ্টা বাকি। চল নীলু, তোকে একখানা মনের মতো জমি দেখাই।'
নীলু রাজি হলো। তার স্ত্রী আমার স্ত্রীর সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন। শীতের দুপুর। হাওয়া দিচ্ছিল। আমরা পায়ে হেঁটে কতক দূরে গেলুম। মোটর এবং কুকুর রইল ছেলেদের হেফাজতে। জিজ্ঞাসা করলুম, 'নীলু, চাঁপা কেমন আছে?'
নীলু উত্তর দিলে, 'সে অনেক কথা। আরেক দিন বলব।'
'আরেক দিন মানে তো আরো সাত আট বছর। তার চেয়ে তুই যেটুকু পারিস বল।'
'আচ্ছা। তবে সারাংশটুটু বলি।'
বিয়ের অল্প কয়েক দিন পরেই তার স্বামী তাকে বলেন অপারেশন করতে হবে। কিসের অপারেশন, চাঁপা অত শত বোঝে না। মত না দিলে যদি প্রাণসংশয় হয় সে কথা ভেবে মত দেয়। অপারেশনের পরে টের পায় চিরজীবনের মতো বন্ধ্যা হয়েছে। তার মনে দারুণ আঘাত লাগে। নীলুকে বলে, আর বেঁচে থেকে কী হবে! কী হবে প্রাণ রেখে, যদি প্রাণ দিতে না পারি! নীলু বলে, কত মেয়ে বন্ধ্যা হচ্ছে নৈসর্গিক কারণে। মনে করো, তুমিও তাদের একজন। তোমার স্বামীর চার পাঁচটি ছেলেমেয়ে, তারা তোমাকে মা বলে। তুমি তাদের মানুষ করে তোল, প্রচুর বাৎসল্য রস পাবে।
কিন্তু কিছুদিন পরে ভদ্রলোক তাঁর ছেলেমেয়েদের অন্যত্র সরালেন। বাড়িতে রইল তাঁর ভাই বোন, চাঁপার ননদ দেওর। তাদের নিয়ে চাঁপার সময় কাটত মন্দ না, কিন্তু তাদের সঙ্গ পেয়ে তার হৃদয় ভরবে কেন! স্বামীর সঙ্গ পাওয়া ভার, তাঁর পসারের ক্ষতি তিনি সইতে পারেন না, আর পসারও তাঁর অসাধারণ। সে নীলুকে চিঠি লেখে ফোন করে, সাধে। কিন্তু নীলুরও কি উপায় আছে! তারও যে ঘরে বাইরে হাকিম, এখানে জবাবদিহি, ওখানে কৈফিয়ৎ। নীলু পরামর্শ দিলে, চাঁপা, তুমি একটা কোনো কাজ বেছে নাও। কাজ করো, কাজ করে যাও। পৃথিবীতে আমরা হৃদয় ভরাতে আসিনি, এসেছি মাটি খুঁড়তে, বাড়ি গড়তে, রাস্তা বানাতে, শহর বসাতে, ভোগোপকরণ উৎপাদন করতে, শিক্ষা বিস্তার করতে, স্বাস্থ্য বর্ধন করতে, আনন্দ দিতে ও পেতে। চাঁপা, তুমি যে কোনো একটা কাজ বেছে নাও, তা হলেই বাঁচবে।
সে এক এক করে অনেক রকম কাজে হাত দিলে, কিন্তু দিতে না দিতে গুটিয়ে নিলে। বললে, আমার পুরী কবে নির্মাণ করবে, তাই বল? অরুণ বরুণ, কবে আনবে মুক্ত ঝরার জল, সোনার বরণ পাখি? আমি এ বাড়িতে বাঁচব না, অরুণ। আমাকে আমার নিজের বাড়ি দাও। কত লোকের বাড়ি তৈরি করো, সখীর বাড়ি তৈরি করতে পারো না?
বাস্তবিক এর কোনো উত্তর নেই। ইচ্ছা করলেই নীলু পারে হাসনকে তার নিজের বাড়ি দিতে। অবশ্য মুক্ত ঝরার জল কিংবা সোনার বরণ পাখি দেওয়া তার সাধ্য নয়। শঙ্করেরও অসাধ্য। কিন্তু বাড়ি! মনের মতো বাড়ি দিতে পারবে না সখীকে। নীলু ভাবে কিন্তু উপায় খুঁজে পায় না। মনের মতো একখানা বাড়ি মানে কত কালের সঞ্চয়। স্ত্রীকে বঞ্চিত করে সখীকে দেবে তার সঞ্চয়! তা কি হয়! রত্না কী মনে করবে! সমাজ কী মনে করবে! নীলু পিছিয়ে যায়। কথা দিতে পারে না। চাঁপা একেবারে অবুঝ। যে মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকার বাড়ি তৈরি করেছে সে মানুষ পাঁচ সাত হাজার টাকার বাড়ি তৈরি করতে পারত না! তার কি টাকার অভাব! আর দেওঘর তো সস্তা।
ডাক্তারের টাকার অভাব নেই, চাঁপা চাইলেই সাত হাজার টাকার চেক পায়। কিন্তু চাইবে কী করে! ডাক্তার কি অরুণ বরুণ, বুদ্ধু ভূতুম! তিনি তাকে দয়া করে বিয়ে করেছেন, যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছেন, পারত পক্ষে অবহেলা করেন না, কিন্তু তাঁর কাছে কি সখীর মতো দাবি করা চলে। না, তাঁর সঙ্গে তেমন সম্পর্কই নয়। কোন সুবাদে চাইবে!
নীলু কিছু করলে না, পরিণামে চাঁপার আবার জ্বর হতে লাগল এবং সে কথা শুনে নীলুর মনে হলো সে-ই দায়ী। তখন সে দেওঘর মধুপুর গিরিডি অঞ্চলে জমি খুঁজতে শুরু করে দিলে রত্নাকে না জানিয়ে! বাড়িও তৈরি হলো বেনামীতে মধুপুরে। খরচ যা পড়ল তা এল বোনাস থেকে। কিন্তু প্রশ্ন উঠল, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে? ডাক্তারকে সমঝাবে কে যে মধুপুরে না গেলে চাঁপার শরীর সারবে না? কে তাঁকে বিশ্বাস করাবে যে সেখানে চাঁপার আপন বাড়ি আছে? চাঁপার আত্মীয়দের একে একে ডাক পড়ল। তাঁদের জেরা করে ডাক্তার জানতে পারলেন তাঁকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। শেষকালে একটা মনোমালিন্য ঘটল। চাঁপা চলে গেল মধুপুর। বছর খানেক সবুর করে সেন আবার সাদী করলেন।
চাঁপা সে কথা শুনে দুঃখিত হলো না, বরং অভিনন্দন জানালে। নীলু তো চটেমটে লাল। বোকা মেয়ে, নিজের স্বার্থ বোঝে না। আর হতভাগা ডাক্তার, কেবল শরীরটি বোঝে। মানুষের যেন মন বলে কোনো পদার্থ নেই। কিন্তু নীলুর চোখ কপালে উঠল যখন চাঁপা লিখলে, আমি একা থাকলে মরে যাব। অরুণ বরুণ, তোমরাও এখানে এসো। আবার আমরা হাসব, আমরা গল্প করব, গান করব, রাঁধব আর খাব। তোমরা আনবে মুক্তা ঝরার জল, অর্থাৎ অফুরন্ত জীবন। তোমরা আনবে সোনার বরণ পাখি, সোনালি রঙের শুক, অর্থাৎ সুখ। অরুণ বরুণ, তোমরা কবে আসবে?
এক বার নয়, দুবার নয়, বারবার আসতে লাগল চিঠি। নীলু আর চুপ করে থাকতে পারলে না, গেল মধুপুর। দেখলে সখী শুকিয়ে যাচ্ছে চাঁপা ফুলের মতো। ওকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র পন্থা ওর সঙ্গে সময় কাটানো। কিন্তু সময় যে বয়সসুলভ ছিল সে বয়সে তো আর নেই। এখন সময় মানে টাকা, টাকা প্রাণধারণের উপায়। নীলু ওকে অনেক কিছু দিতে পারে, কিন্তু সময় দেবে কী করে? নিজের স্ত্রীকেই সময় দিতে পারে না, রোজ ঝাঁটা খায়। ঝাঁটা নয় খোঁটা, একই কথা। পরের স্ত্রীকে সময় দেবে? বাপ রে! সমাজ ফোঁস করে উঠবে না? সমাজের কথা দূরে থাক, ঘরের লোকটি কি রক্ষা রাখবে?
নীলু অনেক খরচ পত্তর করে ওর জন্যে সঙ্গিনী নিয়োগ করলে। বই কিনে দিলে। গ্রামোফোন, রেডিও, রিফ্রিজারেটর কিনে দিলে। ওর বসবার ঘর শোয়ার ঘর ডিস্টেম্পার করা হলো। মার্বেল পাথর আনিয়ে মেঝে বাঁধিয়ে দেওয়া গেল। তা সত্ত্বেও সখী বলে, ওতে আমার হৃদয় ভরবে না। আমি চাই বান্ধব বান্ধবী। বান্ধবীদের সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ আমার চিঠির জবাব পর্যন্ত দেয় না। এমনকি, মিনতি, যার সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে সেও আমার কাছে আসবে না। তুমি একমাত্র বান্ধব যে আমাকে বাঁচাতে সাহায্য করেছ। আর সবাই স্বার্থপর। ভূতুম, তোমার কাছে আমি চিরঋণী। এ ঋণ জন্মান্তরেও শোধ হবে না। জন্মান্তরে যেন তোমার মতো বন্ধু পাই। তোমাকেই বন্ধু রূপে পাই।
'তারপর?' আমি এতক্ষণ পরে কথা কইলুম।
'তারপর?' নীলু শুকনো গলায় বললে, ''আমি তার আত্মীয়দের অনুনয় বিনয় করলুম, টাকা দিতে চাইলুম, কিন্তু কেউ কেন রাজি হবে তার কাছে থাকতে? তাদের প্রাণের দাম আছে, তারা সংসারী মানুষ, তাদের উপর নির্ভর করছে বহু অসহায় প্রাণী। তারা বললে, 'দাও ওকে কোনো স্যানিটরিয়ামে পাঠিয়ে। ভাওয়ালীতে কি মদনপল্লীতে। অন্ততপক্ষে যাদবপুরে। আমরাও সাহায্য করব।' বোঝে না যে মধুপুরে ওর নিজের বাড়ি, ওর 'মায়াপুরী', ওখান থেকে ও কোথাও যায় তো স্বর্গে।''
'তারপর, ও কি এখনো সেইখানে আছে, না স্বর্গে?'
'তারপর, আমি সমস্ত খুলে বললুম আমার সহধর্মিণীকে। বললুম, ও যদি মরে যায় তো আমার ভিতরটা শুকিয়ে যাবে, ঝুনো নারকেলের মতো। তুমি কি তেমন স্বামী নিয়ে সুখী হতে পারো, রত্না? যদি না হও তো আমাকে ক্ষমা করো, আমাকে অনুমতি দাও মাঝে মাঝে ওর ওখানে হাজিরা দিয়ে আসবার, অবশ্য উঠব আমি ডাক-বাংলোয়। তুমিও যেতে পারো আমার সঙ্গে। রত্না যখন দেখলে যে আমার ভিতরের মানুষটাই মরতে বসেছে তখন অনুমতি দিল। কিন্তু আমার সঙ্গে যেতে রাজি হলো না। এই ভাবে দুবছর কাটল। সখী আবার সজীব হলো, তার রং ফিরল, হাসি ফুটল। মনে হলো তার সুখ না থাকলেও দুঃখ নেই। কিন্তু ওটা আমার মনের ভুল। ভিতরে ভিতরে ও শুকিয়ে যাচ্ছিল ঠিকই। সখ্যের অভাবে নয়, প্রেমের অভাবে। আমি তার কী করতে পারি!'
'থাক', আমি সান্ত্বনা জানালুম, 'যে যাবার সে গেছে, তার কথা ভেবে মন খারাপ করিসনে। তুই তোর যথাসাধ্য করেছিস। সংসারে এই বা কজন করে। তুই আদর্শ বন্ধু।'
'কিন্তু ও বেঁচে আছে। হ্যাঁ, বেঁচে আছে। ভালো আছে। সুখে আছে। ও পেয়ে গেছে মুক্তা ঝরার জল, সোনার শুক পাখি।'
'য়্যাঁ! এ অসম্ভব সম্ভব হলো কী করে! করলে কে!'
'ওরই মতো এক যক্ষ্মা রোগী। মধুপুরেই ওদের আলাপ। ওরা এখন এক সঙ্গেই থাকে। আমি কিছু বলিনে। দেখেও দেখিনে শুনেও শুনিনে। জীবন বড় না নীতি বড়? মানুষ বড় না সমাজ বড়? শঙ্কর, তুই তো কবি ও সাহিত্যিক। তোর কী মনে হয়?'
উচ্ছ্বাস আমার কণ্ঠ রোধ করেছিল। কোনো মতে বলতে পারলুম, 'ওরা নিরাময় হোক!' কলকাতায় নীলুর সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল এই সেদিন। রবীন্দ্র জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক আসরে। রত্না ছিলেন সঙ্গে। কুশল-বিনিময়ের পর ওকে একান্তে টেনে নিয়ে শুধালাম, 'সখীর খবর কী?'
'ভালো আছে। ওদের জীবন পরিপূর্ণ হয়েছে। ওরা এখন তিন-চারটি ছেলেমেয়ের মা বাপ।'
আমি চমকে উঠলুম। 'বলিস কী! হলো কী করে!'
নীলু হেসে বললে, 'হয়নি। রুগ্ন দেখে আশ্রয় দিয়েছে। হাসন তাদের আপন সন্তানের মতো ভালোবেসে মানুষ করছে।'
'খরচ জোগায় কে?'
'যে জোগাত সেই জোগায়।'
'রত্না জানে?'
'জানে। তারও তো মায়ের প্রাণ। এত দিনে তার গ্লানি মুছে গেছে। আমাকে আর ঘরে-বাইরে সংগ্রাম করতে হয় না।'
আমি তার হাতে হাত রেখে বললুম, 'নীল, তোকে যদি ফলো করতে জানতুম ধন্য হতুম। চাঁপার সঙ্গে দেখা হলে বলিস, যে বাঁচায় সেই বাঁচে।'

No comments

Powered by Blogger.