সমকালীন প্রসঙ্গ-সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্য ও করণীয় প্রসঙ্গে by বদরুদ্দীন উমর

ঈদের ছুটির মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক লোকের মৃত্যু হয়েছে। এ জন্য যোগাযোগমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং একই সঙ্গে বলেছেন, এসব দুর্ঘটনার জন্য ড্রাইভাররাই দায়ী। কিন্তু শুধু ঈদের ছুটির মধ্যেই নয়, সড়ক দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশে এখন প্রতিদিনের ব্যাপার।


প্রতিদিনই এখানে সড়ক দুর্ঘটনায় দশ-বিশজনের মৃত্যু হচ্ছে। হিসাব করলে দেখা যায়, এভাবে দুর্ঘটনায় এ দেশে বছরে অন্তত চার-পাঁচ হাজার লোকের মৃত্যু হচ্ছে! এই সংখ্যা নগণ্য নয়। এত বেশি মৃত্যু যেখানে হয় সেখানে বিষয়টিকে যে কত গুরুতর ও জরুরিভাবে বিবেচনা করে তা বন্ধ বা বড় আকারে কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ঠিক কী এ নিয়ে কোনো ধারণা বা সিদ্ধান্ত সরকারের আছে বলে মনে হয় না।
যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, এসব সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ড্রাইভাররা দায়ী। একথা সাধারণভাবে ঠিক। প্রত্যেক দেশের জন্যই এটা প্রযোজ্য। তবে আমাদের দেশে ড্রাইভাররা অন্য যে কোনো দেশের থেকে বেশি দায়ী। সরাসরি হিসাব করলে এটা বলা যায়। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেন এ দেশে ড্রাইভাররা এভাবে দায়ী, তাহলে প্রাথমিকভাবে তার জবাব হবে, এরা যথাযথভাবে ড্রাইভিংয়ের জন্য প্রশিক্ষিত নয়। ঠিকমতো প্রশিক্ষিত না হয়ে রাস্তায় নামার কারণে তারা দুর্ঘটনা ঘটায়। কিন্তু ঠিকমতো প্রশিক্ষিত না হয়ে এরা গাড়ি চালাবার জন্য রাস্তায় নামে কীভাবে_ এর জবাব তো দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অর্থাৎ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে। অর্থাৎ যোগাযোগমন্ত্রী যখন বলেন যে, ড্রাইভাররাই সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তখন সরাসরি ড্রাইভাররা দায়ী হলেও এর প্রকৃত দায়িত্ব বর্তায় সরকারের ওপর। কোনো বিশেষ দলের সরকারের ওপর নয়। বাংলাদেশের একের পর এক সরকারের ওপর। কারণ দল নির্বিশেষে প্রত্যেক সরকারের আমলেই সড়ক দুর্ঘটনা ও তাতে অনেক লোকের মৃত্যু প্রতিদিনের এক নিয়মিত ব্যাপার। খারাপ রাস্তার জন্য কোনো কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেখানেও ড্রাইভারদের দায়িত্ব আছে। রাস্তা যেখানে খারাপ বা বিপজ্জনক সেখানে তার দিকে খেয়াল রেখেই ড্রাইভারের গাড়ি চালানো দরকার। এই খেয়াল রাখার পরিবর্তে বেপরোয়া গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটনারই কথা।
যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা প্রত্যেক দিনই ঘটছে এ কারণে তা নিয়ে বিশেষ কেউ মাথা ঘামায় না। যাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এভাবে মৃত্যুবরণ করে তারা ছাড়া এ নিয়ে আর কারও কিছু যায় আসে না। তবে মাঝে মধ্যে কোনো বিখ্যাত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে তখন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এ নিয়ে খানিকটা হৈচৈ হয়। কয়েক দিন এ নিয়ে কথাবার্তা হয়। কীভাবে এটা বন্ধ করা যায় তা নিয়ে অনেক মতামত শোনা যায়। কিন্তু কয়েকদিন পর অবস্থা শান্ত হয়ে আসে এবং সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বড় রকম নতুন হৈচৈয়ের জন্য কোনো বিখ্যাত ও গণ্যমান্য ব্যক্তির নিহত হওয়ার অপেক্ষা করতে হয়! তবে বারবার এটা ঘটলেও সড়ক দুর্ঘটনার কোনো প্রতিকার হয় না। এটা চলতেই থাকে।
বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে কোনো কর্মক্ষেত্রও দুর্নীতিমুক্ত নয়। যেখানেই জনগণের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সেখানেই দুর্নীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নানা অপরাধমূলক কাজ অবশ্যই হচ্ছে। কাজেই নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনার মতো বড় আকারে সমস্যার সঙ্গে দুর্নীতি যে সম্পর্কিত থাকবে এটা প্রায় এক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। এটা সকলেরই জানা যে, কোনো ড্রাইভার ও গাড়ি রাস্তায় নামার আগে তাদের যোগ্যতা পরীক্ষা করে লাইসেন্স দিতে হয়। আইনগতভাবে লাইসেন্স ছাড়া ড্রাইভার যেমন গাড়ি চালাতে পারে না, তেমনি কোনো গাড়িও রাস্তায় নামতে পারে না ভরঃহবংং পবৎঃরভরপধঃব ছাড়া। এটা মনে রাখা দরকার, ড্রাইভাররা অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী হলেও রাস্তায় চলার মতো যোগ্যতা প্রতিটি গাড়ির দরকার, সেটা ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদি যাই হোক। সে যোগ্যতা বা ভরঃহবংং গাড়ির না থাকলে ড্রাইভারের থেকে গাড়ির কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে নানা রকম গাড়ির সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে এবং দ্রুত বাড়ছে। এর সঙ্গে তাল রেখে ড্রাইভারের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। সড়ক পথকে নিরাপদ রাখার জন্য এই ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোনো সুষ্ঠু সরকারি ব্যবস্থা নেই। এ ক্ষেত্রে কোনো সুষ্ঠু তদারকিও নেই। এজন্য ঢাকা শহর এবং আন্তঃজেলা পরিবহন ব্যবস্থা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়ই দেখা যায়, বাসের হেলপাররা কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছে। এছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সময়ও সংশ্লিষ্ট সরকারি লোকজন ঘুষ খেয়ে লাইসেন্স দিচ্ছে এমন লোকদের, যারা ঠিকমতো গাড়ি চালাতে শেখেনি। গাড়ির ক্ষেত্রেও একই কথা। চলাচল যোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও অনেক গাড়িকেই ভরঃহবংং পবৎঃরভরপধঃব দেওয়া হয়ে থাকে। এ রকম বাস, মিনিবাস, ট্রাকের সংখ্যা অনেক। মালিকরা পুরনো গাড়ি ঠিকমতো মেরামত না করে অথবা নতুন গাড়ি রাস্তায় না নামিয়ে নষ্ট গাড়ি রাস্তায় নামান। অনেক দুর্ঘটনা এই ধরনের নষ্ট গাড়ির জন্যও ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে আশির দশক থেকে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা আতঙ্কজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নিয়ে এরশাদের আমলে অনেক চেঁচামেচি, হৈচৈয়ের কারণে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির যাত্রীদের জন্য ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থার কথা বলা হয়। অনেক বাসের গায়ে সে সময় লেখা থাকত যে, দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের জন্য নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু এরশাদের সময়ে এই ক্ষতিপূরণ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত কেউ পেয়েছিলেন বলে জানা নেই। পরেও বিএনপি বা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষতিগ্রস্তদের কাউকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কবীর কাসেম বরিশাল-পাবনার মধ্যে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এর বিরুদ্ধে বরিশাল শহরে তোলপাড় আন্দোলন হয়, ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। কিন্তু তার পরিবারকে কোনো ক্ষতিপূরণ বাস কোম্পানির মালিক দেয়নি। অবস্থা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশ পরিবহন মালিকদের এক স্বর্গরাজ্য। অদক্ষ ড্রাইভার, রাস্তায় চলাচল অযোগ্য গাড়ি ব্যবহার করে সস্তায় বড় মুনাফা অর্জন এবং দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়মুক্ত থাকার কারণে এই পরিবহন মালিকরা বেপরোয়া।
এসব কারণে দেখা যায় যে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি ড্রাইভাররা দায়ী হলেও এর আসল দায়দায়িত্ব বর্তায় সরকার ও পরিবহন মালিকদের ওপর। কাজেই যোগাযোগমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ড্রাইভারদের দায়ী করলেও দুর্ঘটনার আসল কারণ অনুলি্লখিত থেকে যায়। যোগাযোগমন্ত্রী প্রায়ই সারাদেশে বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিদর্শন করেন। এটা ভালো কথা। এ ধরনের পরিদর্শনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চিহ্নিত করে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে শুধু পরিদর্শনে ও হুকুমদারির দ্বারা কোনো ফল লাভ সম্ভব নয়। এর জন্য যোগাযোগমন্ত্রীর ক্ষেত্রে যা করা প্রয়োজন তা হলো, দেশের বিভিন্ন এলাকায় ড্রাইভার প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা ব্যাপকভাবে করা এবং লাইসেন্সপ্রাপ্তদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণের পর লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে কিনা তার সতর্ক তদারকির ব্যবস্থা করা। গাড়ির চলাচল যোগ্যতার লাইসেন্স সম্পর্কেও একই কথা। ঘুষ খেয়ে কর্তৃপক্ষ যাতে এ ধরনের লাইসেন্স ড্রাইভার বা গাড়িকে না দিতে পারে, সঠিকভাবে যাতে লাইসেন্স দেওয়া নিশ্চিত হয় সেটাই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের প্রধান উপায়। যোগাযোগমন্ত্রীর প্রয়োজন, এই প্রশাসনিক কাজের গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত ড্রাইভার ও চলাচলযোগ্য গাড়ির জন্য লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা। অযোগ্য ড্রাইভার এবং অযোগ্য গাড়িকে যাতে লাইসেন্স দেওয়া না হয় সেটা নিশ্চিত করা। শুধু ড্রাইভারকে দায়ী করে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা তো দূরের কথা, সামান্য কমিয়ে আনাও সম্ভব নয়।
২৯.১০.২০১২

বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.