মধ্যরাতের টক শো ও সিঁদ কাটা-গলা কাটার কথকতা by কাজী সিরাজ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রক্তে রাজনীতি। তিনি একাধারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তের উত্তরাধিকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করছেন। চরম দুঃসময়ে তিনি আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন। দিলি্ল থেকে নিয়ে এসে তাঁকে যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদে অভিষিক্ত করা হয়,


তখন দলের অনেক সিনিয়র নেতা ও ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদ ছিলেন_যাঁদের সবাই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে নিহত তাঁর পিতার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্বের কোন্দল এতই তীব্র ছিল যে সবাই মিলে আপস প্রার্থী হিসেবে সভানেত্রী পদে তাঁকেই বাছাই করেন। মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেন এবং আওয়ামী লীগকে (শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অংশ, আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশাল ও দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বাধীন অংশ) ঐক্যবদ্ধ করে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী শক্তি ও বিএনপির সামনে একটি চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড় করান। নেতৃত্ব গ্রহণের ১৫ বছরের মাথায় তিনি তাঁর দলকে পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে বিরূপ সমালোচনাকে আমলে নিয়ে এটাও একই সঙ্গে বলতে হবে যে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী তিন জোটের যুগপৎ আন্দোলনে ১৪ দলীয় প্রধান জোটের (পরে বামপন্থী দলগুলো বেরিয়ে গিয়ে পাঁচদলীয় বাম জোট গঠন করলে আটদলীয় জোট) প্রধান নেত্রী ছিলেন তিনি। ধারণা করা গিয়েছিল, এরশাদের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে। কিন্তু ১৪৪ আসনে জিতে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে সরকার গঠন করে বিএনপি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়া যেন কিছুতেই মানতে পারেননি শেখ হাসিনা। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বহুল প্রশংসিত হয়েছিল। ভোটদান শেষে শেখ হাসিনা নিজেও বলেছিলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। কিন্তু ফল ঘোষণার পর তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বললেন যে নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। সেই থেকে জাতি অন্য এক শেখ হাসিনাকে দেখতে থাকল। সব বিষয়ে সরকারের বিরোধিতা। বঙ্গবন্ধুর কন্যা, রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা নিয়ে গেলেন ব্যক্তিগত রেষারেষির পর্যায়ে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে শুধু এক হাতে তালি বাজেনি। খালেদা জিয়াও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বা সৌহার্দ্যপূর্ণ রাখার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেননি। দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত রেষারেষি তাঁদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ছড়িয়ে পড়েছে দুই দলের তৃণমূল নেতা-কর্মী-সমর্থক পর্যন্ত। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অনেকটাই বদলে গিয়েছিলেন। তাঁর বাক্সংযম প্রশংসিত হয়েছিল সর্বত্র। ফলও পেয়েছেন। স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে তিনি সরকার গঠন করেন। সেটাই ছিল বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। দিন যত যায়, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত প্রধানমন্ত্রীর ভাষাও বদলায়। ভাষা প্রয়োগে, শব্দ চয়নে বাক্সংযম দেখালেও রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আক্রমণের হানা বাণে ও উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়াও পিছিয়ে থাকলেন না। দুজনের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াল অনেকটাই সাপে-নেউলে। অষ্টম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের লোকজনও কেউ কেউ বলেছেন যে তাঁদের দলের জয়-পরাজয় নির্ভর করবে নেত্রীর কথাবার্তার ওপর। কেননা ১৯৯৬-২০০১-এর আমলনামা এমনিতেই ভালো নয়। তার ওপর বাক্সংযম হারালে আরো বিপদ। সে বিপদ হয়েছে। নির্বাচনে হেরে যায় আওয়ামী লীগ। সরকার গঠন করে বিএনপি-জামায়াত জোট। তার পর থেকে সংসদে ও সংসদের বাইরে শেখ হাসিনার বক্তব্য নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। তিনি সর্বদা ছিলেন বেশ আক্রমণাত্মক। খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের প্রসঙ্গ হলে তো কথাই নেই। পরিস্থিতি আজ এমন জায়গায় যে আমাদের দেশের প্রধান দুই দলের নেত্রী_সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার মধ্যে টকিং টার্ম পর্যন্ত নেই। একজন আরেকজনের পরিবার নিয়ে টানাটানি করেন। দুজন পরস্পরকে 'চোর' ডাকেন।
এসব ভাষা ও কুৎসিৎ ইঙ্গিত এখন মিডিয়া ভুবনকেও স্পর্শ করেছে। ১১ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মধ্যরাতের টিভি টক শোর ওপর সওয়ার হলেন। কিন্তু কেন? পরদিন তার উপশমযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে দেওয়ার প্রয়োজনও কেউ বোধ করেননি। দলের পক্ষ থেকেও দায়িত্বশীল কেউ এ ব্যাপারে কোনো কথা বলছেন না। সেদিন গণভবনে রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তাঁর সরকারের আমলে অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পত্রিকা চালাতে পারে কে? যাঁরা অনেক ব্যবসা-ট্যাবসা করেন। তাঁদের অনেক চাহিদা। আমরা অনেক সময় সব চাহিদা পূরণ করতে পারি না। তখন তাঁরা বেজার হন।' বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'টক শো' নামের মধ্যরাতের শো হয়। মধ্যরাতে ঘুম কামাই করে কারা? আগে জানতাম মধ্যরাতে সিঁদ কাটতে যায়। এখন টক শোতে যায় আমাদের গলা কাটতে। টক শোতে এমন অনেকের কাছ থেকে কথা শুনতে হয়, যাঁরা উপদেষ্টা হয়ে একটা নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।' এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে মধ্যরাতে টেলিভিশন টক শোতে অংশগ্রহণকারীদের তিনি চোরের সঙ্গে তুলনা করলেন! এত দিন চোর শব্দটি দুই নেত্রী দুজনের বিরুদ্ধে বলে পুলক অনুভব করতেন। তাঁদের স্তাবক ও তোষামোদকারীরা তালিয়া বাজিয়ে বলত_'ভালো বেশ গো'! এবার তিনি তা ব্যবহার করলেন টক শোতে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে। মধ্যরাতের টক শোতে যাঁরা যান, তাঁদের অনেককে প্রধানমন্ত্রী যেমন চেনেন, তেমনি দেশের জনগণও (যাঁরা টক শো দেখেন) চেনেন। তাতে শিক্ষক-সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা তথা সুশীল সমাজের লোকেরা যেমন যান, তেমনি মধ্যরাতে যান রাজনীতিবিদরাও_যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দলের লোকজনও আছেন। তবে সাম্প্রতিককালে টক শোগুলোতে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়, তাতে লীগ সরকারের বেনিফিশিয়ারি, সমর্থক, স্তাবকরা সুবিধা করতে পারেন না। লাইভ অনুষ্ঠানগুলোতে শ্রোতা-দর্শক শাসক দলের অনুগ্রহভাজনদের উদ্দেশে যেসব প্রশ্নের বাণ হানেন, তাতে এয়ারকন্ডিশনড্ স্টুডিওতেও তাঁরা ঘামতে থাকেন। প্রাসঙ্গিক বিষয়ের বিশ্লেষণ সরকারের অনুকূলে নেওয়া কঠিন। যেমন_রামুর ঘটনার ওপর এক টক শোতে একজন আলোচক বললেন, তদন্তের আগে বিএনপির সংসদ সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে দুষলেন, তাতে আসল অপরাধীদের শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিচারের আগেই রায় ঘোষণার মতো হয়ে গেছে তাঁর অভিযোগ। একজন সিনিয়র সম্পাদক আপত্তি জানিয়ে বললেন, 'প্রধানমন্ত্রী কথাটা সেভাবে বলেননি। তিনি তো বলেননি যে বিএনপির ওই সংসদ সদস্যই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন।' অথচ সব পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলেই খবর এলো, 'রামুর ঘটনায় বিএনপির সংসদ সদস্যকে দুষলেন প্রধানমন্ত্রী।' কী বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী? তিনি বলেছিলেন, 'সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় যখন এখানকার মানুষ শান্ত হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন স্থানীয় সংসদ সদস্য এসে বলে গেলেন যে তিনি চলে যাওয়ার পর মন্দিরে আগুন লাগানো শুরু হলো!' সঙ্গে সঙ্গে দর্শক প্রতিক্রিয়া ছিল_আর কিভাবে বললে প্রধানমন্ত্রী যে বিএনপির স্থানীয় সংসদ সদস্যকে অভিযুক্ত করেছেন, তা বোঝা যাবে? আরেকটি চ্যানেলে প্রধানমন্ত্রীর ওয়ান-ইলেভেনের মতো ষড়যন্ত্রের শঙ্কা নিয়ে একজন আলোচক বললেন, প্রধানমন্ত্রী তো এখন ক্ষমতায়। ধরছেন না কেন ওই ষড়যন্ত্রকারীদের? সঙ্গে সঙ্গে একজন সিনিয়র সাংবাদিক প্রতিবাদ করে বললেন, এভাবে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করা ঠিক নয়। তিনি ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেননি, বলেছেন ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। বোঝা গেল, তাঁর বক্তব্যে ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালকই যেন লজ্জা পাচ্ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতেও লীগ সরকারকে ডিফেন্ড করতে পারছেন না কেউ। বর্তমানে টক শোতে আলোচনার মূল বিষয়ই সমকালীন প্রসঙ্গ। এতে থাকছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, হত্যা, গুম, গুপ্তহত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছাত্রলীগের সীমাহীন দৌরাত্ম্য, শেয়ারবাজার লুণ্ঠন, ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও যোগাযোগব্যবস্থায় সংকট, দুর্ভোগ ইত্যাদি। আলোচকরা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ঘটনা ও পরিস্থিতির বিশদ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলোচনায় জনমতের প্রতিফলন ঘটে। টক শোর আলোচনায় সরকারকে কোনো পয়েন্ট দেওয়া যায় না। দালালি করতে গেলে পয়েন্ট উল্টো মাইনাস হয়ে যায়। সাধারণ নির্বাচনের ১৪-১৫ মাস আগে পরিস্থিতিটা সরকারের জন্য বিব্রতকরই বটে! কাজেই মধ্যরাতের টক শোর ওপর প্রধানমন্ত্রী বিরাগ হতেই পারেন। তাই বলে অংশগ্রহণকারীদের 'চোর' সাব্যস্ত করবেন! সরকার পক্ষের কেউ হয়তো বলবেন, প্রধানমন্ত্রী তো 'চোর' শব্দটি ব্যবহার করেননি। মধ্যরাতে সিঁদ কাটতে তো চোরই যায় চুরি করতে, কোনো ফকির-দরবেশ তো ইবাদত করার জন্য সিঁদ কাটেন না।
সমস্যা-সংকটের কথা অকপটে তুলে ধরলে তার সমাধানে সরকার উদ্যোগী হতে পারে, জনসাধারণের উপকার হয় তাতে। সরকারের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরলে সরকার তা সংশোধন করে নিতে পারে। সরকারের সমালোচনা করলেই তা সরকারের গলা কাটা হিসেবে বিবেচিত হবে কেন? তা ছাড়া টিভি সমালোচনায় বিরোধীদলীয় ও এবং বিএনপি-জামায়াতকেও কেউ ছেড়ে কথা বলেন না। বর্তমান সরকারের দুর্নীতির কথা যেমন বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতির কথাও বলা হয়। ওয়ান-ইলেভেনের পর 'রাজনীতিবিদদের' যে সাফারিংসের কথা বলা হয়, সে সম্পর্কে আমরা কেউ কেউ তো সুযোগ পেলেই বলি যে তাঁরা তো এবার রাজনীতির জন্য সাফার করেননি; তাঁরা জেল খেটেছেন দুর্নীতির অভিযোগে; দেশে প্রায়-গৃহযুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির কারণে। এক পক্ষ ক্ষমতায় গিয়ে আদালতে আপিল হিয়ারিংয়ের মাধ্যমে, আদালতের রায়ে দায়মুক্ত না হয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেরাই নিজেদের মামলা সব প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করছে। যাঁরা এবার ক্ষমতায় যেতে পারেননি, সুযোগ এলে তাঁরাও যে একই কাজ করবেন, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আমরা চাই, আদালত তাঁদের দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করুক আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তখন কেউ আর 'সাফায়ার রাজনীতিবিদদের' দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ পাবে না। টক শোতে এ কথাগুলো বলা কারো গলা কাটা বলে সমালোচিত হবে কেন?
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সমাজে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা, ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সর্বদাই উন্মুক্ত ও প্রশংসিত। আমাদের সংবিধানেও তা নিশ্চিত করা আছে। সংবিধানে বলা আছে, ৩৯(১) 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল', ৩৯(২)(ক) 'প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।' মধ্যরাতের টক শো, তাতে অংশগ্রহণ ও স্বাধীন মতপ্রকাশ আমাদের সংবিধানের লঙ্ঘন নয়। এটা স্বীকৃত অধিকার। দেশের সংসদ এখন একদলীয় না হলেও একপক্ষীয়। প্রধান বিরোধী দল সংসদে যায় না। তাদের অভিযোগ, সংসদে গেলে তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। ফলে সংসদে জনগণের নিত্যদিনের সমস্যা-সংকট, অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। মিডিয়াই এখন জনগণের একমাত্র ভরসা। পত্র-পত্রিকায় সত্য ও বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হলে এবং তা সরকারের অনুকূলে না গেলে মালিকরা তাঁদের 'সব চাহিদা' পূরণ করতে না পারায় সরকারের জন্য বিব্রতকর, ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতপূর্ণ অনুযোগ আসলে কতটুকু সত্য, তা খোলাসা করেই বলা উচিত। ভিত্তিহীন অভিযোগ সংবিধান স্বীকৃত সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার অধিকারকেই বিবর্ণ করে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। 'এমন অনেকের কাছ থেকে কথা শুনতে হয়' বলে প্রধানমন্ত্রী ড. আকবর আলি খান ও অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এ দুজনই সাহসের সঙ্গে টক শোতে সত্য ভাষণ দিয়ে চলেছেন। নির্বাচন করতে না পারার ব্যর্থতা তাঁদের নয়, বরং তাঁদের পদত্যাগের ফলেই তো প্রধানমন্ত্রীর 'আন্দোলনের ফসল' মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই সরকার গঠন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনটা অনায়াসেই হয়ে যেত ড. আকবর আলি খান, সুলতানা কামালরা পদত্যাগ না করলে। পদত্যাগ না করে নির্বাচন সম্পন্ন করার কৃতিত্বটা তাঁরা নিতে পারতেন। সে নির্বাচনে কি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন? তখন যেমন তাঁরা সত্যের পক্ষে ছিলেন, এখনো তা-ই আছেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। তাঁদের তখনকার ভূমিকার তো কোনো সমালোচনা করা হয়নি। বরং পদত্যাগের আগে শফি সামী ও সুলতানা কামাল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপি-জামায়াত মহল কর্তৃক সমালোচিত হয়েছিলেন। বেশি দিনের কথা তো নয়। দেশের সব মানুষের নিকট-অতীতের এসব কাহিনী বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাঁদের সমালোচনাটা নিষ্ঠুরই বটে!
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে বিরোধী দলের রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়েও বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোর শক্তি অনেক বেশি। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচির চেয়েও মধ্যরাতের টক শোকে বেশি ভয় পাচ্ছেন? তিনি কি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিকদের প্রচ্ছন্নভাবে মৃদু একটা সতর্কবাণীও দিয়ে দিলেন? তাঁর আমলে দেওয়া সব কয়টি চ্যানেলই তাঁর দলের সমর্থকরাই পেয়েছেন। এতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু এসব চ্যানেলকে এবং একটি 'বিটিভি' বানিয়ে ফেললে তা দেখবে কে? তাহলে তো সরকারের গুণগানে ভরপুর বিটিভি-ই দেখত মানুষ। দর্শকপ্রিয়তা না থাকলে চ্যানেলগুলোর মেইন সোর্স অব রেভিনিউ_বিজ্ঞাপন আসবে কোত্থেকে? সরকার তো লাইসেন্স দিয়েছে, চ্যানেল চালানোর টাকা তো দেয়নি। কোনো কোনো চ্যানেল মাঝেমধ্যে সরকারের দালালি করার চেষ্টা যে করে না তা নয়; কিন্তু তার পরিণাম তাদের জন্য শুভ হয় না। কাজেই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার লড়াইয়ে চ্যানেলগুলোকে সরকারের নোংরা দালালি করলে চলবে না। মানুষ কিন্তু বোঝে কোনটা দালালি আর কোনটা 'হালালি'। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কারো কারো মনে এই শঙ্কা জেগেছে যে অনলাইন সংবাদক্ষেত্র বা তার মাধ্যমে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কুচিন্তার মতো সরকার কি মধ্যরাতের টক শো নিয়ন্ত্রণের কোনো চিন্তাভাবনাও করছে? তাতে কী লাভ? মানুষের কণ্ঠ-বেতারকে নিয়ন্ত্রণ করবেন কিভাবে?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
kayi.shiray@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.