প্রবারণা- দূর হোক সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার by সুকর্ণ বড়ুয়া

প্রবারণা পূর্ণিমা, বুদ্ধপূর্ণিমার পরে বৌদ্ধদের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব। চন্দ্র-পঞ্জিকার একাদশতম মাসের পূর্ণিমা তিথিতে, ইংরেজি অক্টোবর মাসের শেষের দিকে মহাসমারোহে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরাই প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করে থাকেন। প্রতিবছরের মতো এবারও বাংলাদেশে যথাযোগ্য ধর্মীয় আবহে উদ্যাপিত হলো প্রবারণা পূর্ণিমা।


বুদ্ধের সময় থেকে প্রবারণা পূর্ণিমা প্রথা হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। প্রবারণা পূর্ণিমার প্রধান আকর্ষণ হলো ফানুস ওড়ানো উৎসব, যেটি আজ ধর্মের সীমারেখা অতিক্রম করেছে। অন্য ধর্মের মানুষেরাও ফানুস উৎসবে বৌদ্ধদের সঙ্গে সমবেত হয় বৌদ্ধমন্দিরে।
বৌদ্ধধর্মে যাঁরা সংসারজীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেন, তাঁদের ভিক্ষু বলা হয়। ভিক্ষুরা মন্দিরে অবস্থান করেন এবং কিছু ধর্মীয় নিয়মকানুনের মধ্যেই তাঁদের জীবন পরিচালিত হয়। বুদ্ধের সময়কালে, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সাধারণত এক জায়গায় অবস্থান করতেন না। তাঁরা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন, ভিক্ষার মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করতেন এবং গাছের নিচে রাত্রি যাপন করতেন। অনেক সময়, দূর বনে কিংবা পাহাড়ে নীরব, শান্ত পরিবেশে ধ্যানের জন্য গমন করতেন। কিন্তু, বর্ষাকালে এভাবে ভ্রমণ করা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষত এই সময় তাঁদের গ্রামবাসীর শস্যখেতের ওপর দিয়ে যেতে হতো। ফলে অনেক সময় শস্যের ক্ষতিসাধন হতো। গ্রামবাসীরা বুদ্ধকে শস্যের ক্ষতির কথা জানালে বুদ্ধ সব ভিক্ষুকে ডেকে বর্ষাকালের তিনটি মাস মন্দিরের ভেতরে থাকার বিধান দেন। সেই থেকে শুরু হয় তিন মাসব্যাপী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ‘বর্ষাবাস’ পালন।
ইংরেজি বছর হিসেবে জুলাই মাসের শেষের দিকে বর্ষাবাসের আরম্ভ হয় এবং অক্টোবর মাসের শেষের দিকে এর শেষ হয়। বর্ষাবাসের তিনটি মাস ভিক্ষুরা সাধারণত বাইরে যেতে পারেন না। তাঁরা মন্দিরেই একসঙ্গে অবস্থান করেন এবং ধর্মচর্চা করে সময় কাটান। গৌতম বুদ্ধ চারটি সত্য পর্যবেক্ষণ করেছিলেন: ১। জগতে দুঃখ আছে, ২। সেই দুঃখের কারণ আছে, ৩। দুঃখ মুক্তির উপায়ও আছে এবং ৪। ধ্যানের মাধ্যমেই সে মুক্তি সম্ভব। আর এই মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই ভিক্ষুরা বর্ষাবাসের তিনটি মাস ধ্যান ও প্রার্থনাকর্মের মধ্যেই নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করে থাকেন। সাধারণ বৌদ্ধরাও এই সময় মন্দিরে ভিক্ষুদের কাছে আরও গভীর ধর্মোপদেশ শোনার সুযোগ লাভ করেন।
বুদ্ধের সময়, তিন মাস বর্ষাবাসের পর সব বৌদ্ধ ভিক্ষু একত্র হয়ে বুদ্ধের কাছে আসতেন। বুদ্ধ তখন ভিক্ষুদের কাছে এই তিন মাসের আবদ্ধ জীবনে কী অনুধাবন করেছেন তা জানতে চাইতেন। তখন ভিক্ষুদের কেউ কেউ তাঁদের ভালো অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা বলতেন, আবার কেউ বা কষ্টের কথা বলতেন। কথিত আছে, কোনো একসময়, তিন মাস বর্ষাবাস শেষে একদল ভিক্ষু বুদ্ধের কাছে জানান যে একই সঙ্গে অবস্থানের কারণে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার ভয়ে তাঁরা অত্যন্ত শঙ্কিত ছিলেন। এই কারণে তাঁরা তিন মাস নীরবেই নিজেদের মধ্যে কথা না বলে কাটিয়ে দেন। কিন্তু বুদ্ধ তাঁদের বলেন, ‘চুপ করে থাকলে কোনো উন্নতি আসবে না, বরং তিন মাসের পর, সন্ন্যাসজীবনের ভালোমন্দ, নিজের দোষত্রুটি নিয়ে আলোচনা করাই উত্তম, তাতে শুদ্ধতা ও উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়।’ সেই থেকে বুদ্ধ বিধান করেন, বর্ষাবাসের তিন মাসের ঠিক পরদিন, ভিক্ষুরা একত্র হবে, একে অপরকে তিন মাস বর্ষাবাসের ভালোমন্দ অবহিত করবে, বর্ষাবাসকালে কোনো মন্দ কাজ হয়ে থাকলে তার জন্য নিজের দোষ স্বীকার করবে এবং অনুতপ্ত বোধ করবে। এই সমাবেশটি প্রবারণা সমাবেশ নামে পরিচিত। প্রবারণা শব্দের অর্থ ‘আমন্ত্রণ করা’ অর্থাৎ ভিক্ষুদের সমাবেশে আমন্ত্রণের কারণেই এর নাম ‘প্রবারণা’।
প্রবারণা সমাবেশ ভিক্ষুদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সমাবেশে ভিক্ষুরা খোলাখুলিভাবে তাঁদের সন্ন্যাসজীবনের ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, একে অপরের কাছ থেকে উপদেশ লাভ করেন। সমাজের, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিজেদের কর্মপন্থার পরিবর্তন আনতে পারেন। ফলে ধর্মের সামগ্রিক উন্নতি সাধন সম্ভবপর হয়। ভিক্ষুদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ বৌদ্ধরাও এই দিনটি পূর্ণিমা উৎসব পালন করেন। এ দিনে বিহারগুলো বিভিন্ন রংবেরং ও আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়। বৌদ্ধরা এদিন বৌদ্ধমন্দিরে যান, পূজা করেন, প্রদীপ জ্বালান। তারপর বুদ্ধের পঞ্চশীল শপথ গ্রহণ করেন এবং ভিক্ষুদের কাছে ধর্মোপদেশ শ্রবণ করেন। পঞ্চশীলগুলো হলো প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা, চুরি না করা, খারাপ কামনা থেকে বিরত থাকা, মাদক সেবন না করা এবং মিথ্যা না বলা।
প্রবারণা পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যা থেকে আকাশে ওড়ানো শুরু হয় ‘ফানুস’। রাতের অন্ধকার আকাশে আলোকিত ফানুসগুলোকে মনে হয় মাথার ওপর একেকটা মঙ্গলপ্রদীপ, যে প্রদীপ মনের সব অন্ধকার দূর করে, মনকে আলোকিত করার প্রেরণা দেয়। প্রবারণার এই মঙ্গলপ্রদীপের আলোয় তাই দূর হোক সব সাম্প্রদায়িক অন্ধকার, বৌদ্ধদের সমবেত প্রার্থনার শক্তিতে বিনাশ হোক সব সাম্প্রদায়িক অপশক্তির, যা কিছু মন্দ তা ভুলে গিয়ে সব ধর্মের মানুষের পরস্পরের প্রতি আবারও ভালোবাসা, বিশ্বাস ফিরে আসুক—এই হোক প্রবারণা পূর্ণিমায় সবার কামনা।
সুকর্ণ বড়ুয়া: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট।
sukarna_barua@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.