যায়দিন ভালো দিন by রণজিৎ বিশ্বাস

আমাদের চারপাশে যে ক'টি কথা আমরা বড় বেশি শুনি, তার একটি হচ্ছে_ যায়দিন ভালো। এর অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে_ আসে দিন মন্দদিন। যায়দিন ভালো অর্থ চলে দিন খারাপ এবং আসে দিন আরও খারাপ।


এ কথার সুর ধরে একজন প্রায় বৃদ্ধ পেশাজীবী হাটের মাঝেই বলে বসলেন_ পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম, দেশ স্বাধীন হইয়া কী লাভ হৈল! এমন হইলে দেশ স্বাধীনই করতাম না!
অনেক মানুষের ভিড়ে সহসা বলে ফেলা এমন কথা যন্ত্রণার ঠেলায় বেরিয়ে আসা স্বগতোক্তির মতো। এর উদ্দিষ্ট কেউ থাকে না। খুব চিন্তা-ভাবনার ফসলও নয়, এ জাতীয় মূল্যায়ন সবাই এর জবাব দিতে পারে, অথবা কেউ এর জবাব না দিলেও চলে।
আমার কলেজ জীবনের এক সহপাঠী হারাতে হারাতে পোড়ো বাঁশঝাড়ে শেষ কঞ্চির মতো এখনও যে সুহৃদ তালিকায় পড়ে আছে, সেদিন বলে বসল_ কী বুঝলা? দেশ স্বাধীন হইয়া আসলেই কি কিছু হয় নাই?
: তোমার ওই লোক কোন বিবেচনায় এমন ঝাড়ূমারা কমেন্ট করেছে, তিনিই জানেন। কাজটা ভালো হয়নি। তিনি নিজের চারপাশে তাকাননি, তাকালেও বাস্তবতার ভাষা বোঝেননি। অথবা এমনও হতে পারে, নষ্ট ও ভ্রষ্ট আদর্শের কিছু লোক যেমন নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মিথ্যাচার করে, তিনিও তেমন করেছেন। লোকটি তাদের পক্ষের কোনো অ্যাক্টিভিস্টও হতে পারে।
: তাহলে ঘটনাটা কী!
: ঘটনাটা মিলিয়ে দেখার ও বিশ্লেষণ করার। দেশ স্বাধীন হইয়া কিছুই হৈল না, এ দেখার মতো ভুল দেখা তুমি দেখেছো কি-না জানি না, আমি দেখি নাই। এ দেখা প্রবঞ্চনার দেখা, আত্মপ্রবঞ্চনার।
তোমার আর আমার কথা ধর, পাকিস্তান থাকলে আমরা কী হইতাম! তুমি ছাত্র ভালো, লেখাপড়ায় তোমার ধার আছে, তারপরও কী হইতে পারতা বলা মুশকিল, আমার মতো যাদের নামে মাতৃভাষার শব্দ বেশি, তাদের তো আবার ডাবল অসুবিধা, বড়জোর আমি স্কুলের হেডমাস্টার হইতাম, নইলে কোনো অফিসের বড় কেরানি।
: তোমার কথাটা ভাববার। আমি আবার এভাবে ভাবি। আমার তো আবার খুব গ্রামে যাওয়া হয়, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলি।
আমাদের পাড়ায় বল আর আমাদের বাড়িতে বল, ঘরে ঘরে একটাই চৌকি ছিল। ঘরের কর্তা সেখানে শুতেন অথবা বিশিষ্ট কোনো অতিথির জন্য সেটির ব্যবহার হতো। কোনো খাট বা পালঙ্ক নয়। নিরেট চৌকি!
পরিবারের অন্যলোকদের বিছানা হতো মাদুর বা হোগলার চাটাইয়ের ওপর।
তখন গ্রামের লোক নতুন আত্মীয় বাড়িতে যেতে ধার করা শার্ট-পাঞ্জাবি কাঁধের ওপর নিয়ে যেত। হয়তো শর্তই থাকত সেরকম অথবা সেটি যদি কোনোক্রমে নিজের হতো, তিনি ভাবতেন_ অধিক ব্যবহারে জীর্ণ হবে। ঘামের তোড়ে লবণ শুষবে। স্যান্ডেলের বেলায়ও তাই। ক্ষয়ে যাওয়ার ভয়ে, হাতে কিংবা বগলে করে নিয়ে এসে, ধূলিধূসর পা ধুয়ে পরে নিতেন আত্মীয় বাড়ির পুকুরঘাটে।
ধনী কিংবা গ্রামের বিচারে আমাদের মতো উচ্চ মধ্যবিত্ত 'টুইনটুইন্যা' গেরস্তের বাড়িতে একখান কাঠের চেয়ার থাকলে থাকত, না থাকলে না, গরিবের বাড়িতে সে ছবি তো কল্পনাই করা যেত না। অথচ এখন দেখ, গ্রামে একান্ত গরিব বাড়িতেও খান কয়েক প্লাস্টিকের চেয়ার দেখা যাবে। মানুষের পায়ে অন্তত স্পঞ্জের এক জোড়া স্যান্ডেল পাওয়া যাবে। অতিথি আপ্যায়নের জন্য তারা মোটামুটি মানসম্পন্ন বিস্কুট আর কোল্ড ড্রিংসের জন্য দৌড়োদৌড়ি করে।
শহুরে গরিবদের বাড়িতে তুমি ছোট একটা টিভিসেট দেখবে, যেনতেন একটা শোকেস দেখবে, সোফার পুরো সেট না হলেও হাতলওয়ালা ও সোফাসুলভ কম উচ্চতার একটা-দুটা প্রশস্ত চেয়ার পাবে।
গ্রামে এখন তুমি হাহাকার পাবে না। মানুষ না খেয়ে নেই। জিনিসপত্র তারা কিনতে পাচ্ছে। শহরে মধ্যবিত্তরাও প্রয়োজনের সময় মিনারেল ওয়াটারের একটা-দুটা বোতল কিংবা টয়লেট টিস্যু অ্যাফর্ড করতে পারছে। এসব ছোট ছোট সূচক আমরা মাথায় রাখি না। শুধু বলি আর মানুষ হাসাই ১০ টাকা সের চাল তো খেতে পাচ্ছি না। অত টাকা কেজি মাথামুণ্ডু তো কিনতে পারছি না। যারা এসব বলিস, তারা এটা তো দেখবি_ মানুষের আয় কত বেড়েছে, ক্রয় ক্ষমতা কেমন দাঁড়িয়েছে। সত্য হচ্ছে দেশ স্বাধীন হয়ে কিছুই হয় নাই একথা মিথ্যা। এ বীক্ষণ ভ্রান্ত বীক্ষণ। যারা এ মিথ্যা বলে ও বলায়, তাদের উপযুক্ত প্রাপ্য সিলেটের লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টের বেত্রসোহাগ।
 

No comments

Powered by Blogger.