অভিযোগ নিচ্ছে না সাভার থানা- আমিনবাজারের গ্রাম থেকে পাঁচ যুবক নিখোঁজ by অরূপ রায়

সাভারের আমিনবাজারের বরদেশী ও বেগুনবাড়ি গ্রামের পাঁচ যুবকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ৫ থেকে ২৩ অক্টোবর—১৯ দিনের মধ্যে এঁরা একে একে নিখোঁজ হন। পরিবারের সন্দেহ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন এঁদের তুলে নিয়ে গেছেন।


১০ অক্টোবর সকালে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন বরদেশী গ্রামের আবদুস সাত্তার (২৫)। পাঁচ দিন আগে ৫ অক্টোবর বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি একই গ্রামের তমিজ উদ্দিনের জামাতা সাইফুল ইসলাম (৩৩)। ২৩ অক্টোবর দুপুরে ঈদের কেনাকাটার জন্য ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়ে নিখোঁজ হন তিন বন্ধু: মো. সেলিম, মনির হোসেন ও বেগুনবাড়ি গ্রামের সাইফুল ইসলাম। এঁদের বয়স ২৬ থেকে ৩২ বছর।
এই পাঁচ যুবকের পরিবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ঢাকার দারুস সালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। র‌্যাবের প্রধান কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয় একটি। তবে সাভার থানায় একাধিক পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের করতে গেলে পুলিশ তা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ওই যুবকদের স্বজনেরা।
এই বরদেশী গ্রামেই ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে মেরেছিল গ্রামবাসী। এ ঘটনায় গ্রামের আবদুল মালেক নিহত ছাত্রদের বিরুদ্ধে সাভার থানায় ডাকাতির মিথ্যা মামলা করেছিলেন। পরে হত্যাকারী সন্দেহে এই মালেকই গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সর্বশেষ নিখোঁজ চার যুবক সাত্তার, সেলিম, মনির ও সাইফুলের নাম উল্লেখ করা হয়। এঁরা অন্যদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে দৌড়ে যাচ্ছিলেন বলে তিনি জবানবন্দিতে বলেন। মালেক এখন জামিনে রয়েছেন। গতকাল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
এর আগে গত ১৩ আগস্ট এক দিনে পাঁচজন নিখোঁজ হয়েছিলেন সাভারের হেমায়েতপুর থেকে। পরে এক চিকিৎসককে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত সন্দেহে র‌্যাব তাঁদের মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার দেখায়।
সাত্তারের নিখোঁজ ও জিডি: সাত্তার নিখোঁজ হওয়ার পর দারুস সালাম থানায় হারানো-সংক্রান্ত জিডি করেন তাঁর ভাই আবুল হোসেন। এতে উল্লেখ করা হয়, ১০ অক্টোবর সকালে বাগবাড়ি থেকে ছেলে নিবিড়কে নিয়ে বরদেশীতে স্কুলে যাচ্ছিলেন সাত্তার। গাবতলীর বিউটি সিনেমা হলের সামনে পৌঁছানোর পর একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে তিনজন লোক এসে সাত্তারকে তুলে নিয়ে যায়।
সাত্তারের শ্বশুরবাড়ি বিউটি সিনেমা হলের পেছনে, বাগবাড়ির জি/১৮, বসুপাড়ায়। বাবাকে তুলে নেওয়ার পর নিবিড় নানার বাড়িতে চলে যায়। নিবির প্রথম আলোকে বলে, ‘টেম্পোতে ওঠার জন্য নানাবাড়ি থেকে হেঁটে গাবতলী যাচ্ছিলাম। পথে মাইক্রোবাস থেকে নেমে তিনজন জোর করে আমার আব্বুকে ধরে নিয়ে যায়। আমাকে বলে, তুমি নানুর বাসায় চলে যাও। মাইক্রোবাসে উঠে বাবাও আমাকে বলে, বাসায় চলে যেতে। আমি নানার বাসায় চলে আসি।’
সাত্তারের ভাই আবুল হোসেন বলেন, তাঁরা দারুস সালাম থানায় জিডি করেন এবং র‌্যাবের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত আবেদনও করেছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। তাঁর দাবি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনই তাঁর ভাইকে তুলে নিয়ে গেছেন।
একসঙ্গে তিনজন নিখোঁজ: এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরদেশী গ্রামের সেলিম ও মনির এবং বেগুনবাড়ি গ্রামের সাইফুল ঈদের কেনাকাটা করতে ঢাকার উদ্দেশে বের হন ২৩ অক্টোবর দুপুরের পর। বিকেলে পরিবারের লোকজন তাঁদের মুঠোফোন বন্ধ পান। এর পরই তাঁরা খোঁজ করতে থাকেন। ২৫ অক্টোবর সেলিমের ভাই কামাল হোসেন সাভার থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। কিন্তু পুলিশ তা নথিভুক্ত না করে আমিনবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম সরদারকে তদন্ত করতে দেয়।
কামাল হোসেন প্রথম আলোকে জানান, সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে সাভার থানায় অভিযোগ দিতে গেলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা ধমক দিয়ে বের করে দেন।
মনিরের মা হালিমা খাতুন বলেন, তাঁর ছেলে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় তিনি জিডি করতে তিন দফায় সাভার থানায় যান। কিন্তু থানা থেকে খোঁজাখুঁজি করতে বলা হয়। সর্বশেষ গত রোববারও সাভার থানায় যান তিনি। কিন্তু পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। অবশেষে অভিযোগটি নিয়ে আমিনবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গেলে ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক শহিদুল ইসলাম সরদার অভিযোগটি রেখে তাঁকে বিদায় করে দেন।
থানায় জিডি বা অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে বিফল হন বরদেশী ও বেগুনবাড়ি গ্রামের দুই সাইফুলের পরিবারও।
বেগুনবাড়ির সাইফুলের বড় ভাই মাইবুল ইসলাম বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজি করে ভাইকে না পেয়ে তিনি সাভার থানায় লিখিত অভিযোগ করতে গেলে থানা অভিযোগ নেয়নি।
বরদেশীর সাইফুল ইসলামের স্ত্রী রুমা বেগম জানান, তাঁর স্বামীর বাড়ি রাজবাড়ী জেলার কালুখালি উপজেলার রতনদিয়া গ্রামে। বিয়ের পর থেকে তাঁর স্বামী বরদেশী গ্রামে থেকে বিদ্যুৎমিস্ত্রির কাজ করতেন। ছয় ছাত্র খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি দুই মাস জেল খাটার পর জামিনে মুক্ত হন।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে ভালো বলছেন না গ্রামবাসী: স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ জানায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও স্থানীয়ভাবে অবৈধ মাদক ব্যবসা করার অভিযোগ আছে।
বরদেশী ও বেগুনবাড়ি গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বেগুনবাড়ির সাইফুল এবং বরদেশীর মনির ও সাত্তার মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এলাকায় ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাইফুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। এই মামলায় তিনি জামিনে আছেন। সাত্তার ২০০৫ সালে ফেনসিডিলসহ আটক হয়েছিলেন। আর মনির আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে আসছিলেন।
পুলিশের বক্তব্য: আমিনবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম সরদার প্রথম আলোকে বলেন, মনিরের মা ও তাঁর এক আত্মীয় মৌখিকভাবে নিখোঁজের কথা জানিয়েছেন। থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার পর আর কোনো যোগাযোগ করেননি তাঁরা।
সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘একটা অভিযোগ এসেছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সে মাদক ব্যবসায়ী। আমিনবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। বাকিগুলোর কথা বলতে পারব না।’ অভিযোগ দায়ের করতে গেলে ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজনকে ধমকানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেখানে নিখোঁজ হয়েছে সেখানেই অভিযোগ দিতে হয়। অনেকে না জেনে অন্য থানায় চলে আসে। তখন সংশ্লিষ্ট থানায় যেতে বলা হয়, আর কিছু না।’
ছয় ছাত্র হত্যা মামলার সর্বশেষ অবস্থা: গত বছরের ১৭ জুলাই ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার পর দুটি মামলা হয়। ছয় ছাত্রের বিরুদ্ধে একটি ডাকাতির মামলা করেন স্থানীয় বালুর ব্যবসায়ী আবদুল মালেক। আর ছয় ছাত্রকে হত্যার ঘটনায় মামলা করেন সাভার থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন। এ হত্যা মামলা তদন্তে থানা-পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে সিআইডি গ্রেপ্তার করে ডাকাতি মামলার বাদী আবদুল মালেককে। একই সঙ্গে থানা-পুলিশের ভূমিকা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি করে পুলিশ সদর দপ্তর। তথ্যানুসন্ধানের পর কমিটি মত প্রকাশ করে যে ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা ছিল ‘অপেশাদার ও দায়িত্বহীন’। এরপর গত ৭ আগস্ট মামলার তদন্তভার সিআইডি থেকে র‌্যাবের কাছে স্থানান্তর করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.