প্রতিদিন ধার করে চলছে চার ব্যাংক by মনজুর আহমেদ

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমশই নাজুক হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ব্যাংকগুলোতে সংস্কার করায় ২০১০ সালের শেষভাগে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল।


কিন্তু এর পর থেকেই অবনতির দিকে এগিয়ে গেছে ব্যাংকগুলো। পরিস্থিতি এমনই যে, ব্যাংক চারটিকে এখন প্রতিদিন ধার করে চলতে হচ্ছে।
পরিস্থিতি এখন এতটাই নাজুক যে, সোনালী ব্যাংকের প্রতি ১০০ টাকার সম্পদের বিপরীতে আয় হয় মাত্র ১২ পয়সা। আর জনতার আয় ৭৮ পয়সা, অগ্রণীর ৩৪ পয়সা এবং রূপালীর আয় ৪৫ পয়সা। বিশ্বব্যাপী এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী মাত্রা হচ্ছে এক টাকা ৩০ পয়সা বা তার বেশি আয়। আয়ের এই হিসাব ২০১২ সালের জুন মাসের ভিত্তিতে।
শুধু সম্পদের ভিত্তিতে নয়, বিনিয়োগের বিপরীতেও ব্যাংকগুলোর আয় ক্রমশ কমছে। যেমন, ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে সোনালী ব্যাংকের আয় হয় তিন টাকা ১৪ পয়সা, জনতার দুই টাকা ৯৭ পয়সা, অগ্রণীর তিন টাকা ৯৯ পয়সা এবং রূপালীর আয় হয় তিন টাকা ৯৬ পয়সা।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দু-তিন বছরে। ২০০৭ সালের শেষে ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি করার পর কিছু অগ্রগতি হয়েছিল। কিন্তু এখন দ্রুত অবনতি হচ্ছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর তৈরি করা সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘অতিসম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, সংস্কারের ফলে অর্জিত সাফল্যগুলো ক্রমান্বয়ে ম্লান হয়ে পড়ছে।’
ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, ঋণ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মানও সন্তোষজনক নয়। ঝুঁকিনির্ভর সম্পদ অর্থাৎ ভালো মানের ঋণের পরিমাণ কমে ক্রমশ বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ। ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাবেই এ অবস্থা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে।
ব্যাংকগুলোর এই পরিস্থিতি সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির আগের সময়ের। হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বড়ভাবে জড়িয়ে আছে। ফলে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে একটি বৈঠক করে এসব উদ্বেগের কথা জানিয়ে দিয়েছে বলেও সূত্রে জানা গেছে।
পরিস্থিতির বর্ণনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য এককথায় দায়ী হচ্ছে খারাপ শাসনব্যবস্থা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ পুনঃপ্রবর্তন হওয়ার ফল ভালো হয়নি। এই বিভাগ যেসব পরিচালক ও এমডি-ডিএমডি নিয়োগ দিয়েছে, সেগুলো যথাযথ হয়নি।’ তিনি বলেন, মালিক হিসেবে সরকার পেশাদারির পরিচয় দিয়ে লোক নিয়োগে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা কোম্পানি করার পর ভালোর দিকে যাত্রা শুরু করে আবারও খারাপ হয়ে পড়েছে।
খেলাপি ঋণ ও আদায় পরিস্থিতি: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর একটা সমঝোতা চুক্তি আছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শর্ত দিয়েছিল, ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনবে। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। জুন শেষে এই ব্যাংকগুলোর ১৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ সময় সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে সর্বাধিক ৮৫৮ কোটি টাকা, জনতার ২০৭ কোটি, অগ্রণীর ৩৪৭ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকের বেড়েছে ১৩৭ কোটি টাকা।
আদায় পরিস্থিতি আরও হতাশাজনক। সমঝোতার শর্ত অনুসারে ২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের আদায় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৬৮৭ কোটি, আদায় হয়েছে ১৮৬ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৯৫ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ১৪৩ কোটি টাকা বা ৪৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অগ্রণীর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮৩ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ১৩৬ কোটি টাকা বা ৩৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২৬ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ২২ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও বিনিয়োগের বিপরীতে আয় ভবিষ্যতে আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা, প্রতিটি ব্যাংকে ইতিমধ্যেই ঝুঁকিনির্ভর সম্পদ অর্থাৎ ঋণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলোতে বিপুল হারে খেলাপি ঋণ বাড়বে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে।
২০০৯ সাল শেষে সোনালী ব্যাংকে মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ছিল ২৩ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা, জুন ২০১২-তে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকারও বেশি। জনতায় ’০৯-এ ছিল ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা, জুন ’১২-তে হয়েছে ৩৩ হাজার ২১ কোটি টাকা। অগ্রণীতে ’০৯-এ ছিল নয় হাজার ১৬৯ কোটি টাকা, ’১২-তে হয়েছে ২০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকে ’০৯ শেষে ঝুঁকিনির্ভর মোট ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা, জুন ’১২-তে হয়েছে ১১ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকার বেশি।
ধার করে চলে ব্যাংকগুলো: একসময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মুদ্রাবাজারে অর্থ ধার দিত। এখন উল্টো হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো এখন মুদ্রাবাজার বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করেই দৈনন্দিন কাজ চালায়। জুন মাসের ১৮ কর্মদিবসে হিসাব থেকে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক গড়ে প্রতিদিন ৬৪৫ কোটি টাকা, জনতা ৩৫৯ কোটি এবং অগ্রণী ৫৫৭ কোটি টাকা ধার করে দৈনন্দিন কাজ চালিয়েছে। জুনের পর এ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দত্ত গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই ব্যাংকের যোগ দেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁর যোগদানের সময় পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার কলমানি অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য-সহায়তা নিতে হতো। ব্যাংকের বিধিবদ্ধ জমার নগদ অংশ বা সিআরআর বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করা যেত না বলে বড় অঙ্কের জরিমানা দিতে হতো। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। দৈনন্দিন ধার (কলমানি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য-সহায়তা) কমে ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতিতে সোনালী ব্যাংক ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে?—এ প্রশ্নে প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘এখন টানাটানি চলছে, তাই দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিতে পারছি না। তবে আমদানি অর্থায়ন, ব্যাক টু ব্যাক এলসি, এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও গ্যারান্টি-জাতীয় কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান: ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্র খাতের সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংককে কোম্পানি করা হয়। রূপালী ব্যাংক আগে থেকেই কোম্পানি ছিল। বিগত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ ও ২০০৫ সালের বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাংকের শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও ব্যাংক আধুনিকীকরণ প্রকল্পের (এন্টারপ্রাইজ গ্রোথ ও ব্যাংক মডার্নাইজেশন প্রোজেক্ট—ইজিবিএমপি) আওতায় ব্যাংকগুলোতে তিন বছরের জন্য ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিং কার্যক্রম উন্নতিতে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের পরামর্শ ছিল কোম্পানি গঠনের।
কোম্পানি গঠনের পর বিধিগতভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর সরকারের সরাসরি কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। সরকার কেবল ১০০ ভাগ ও রূপালীর ক্ষেত্রে ৯৫-৯৬ ভাগ মালিকানা থাকায় বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) ভোটাধিকার প্রয়োগের জায়গা থেকে পরিচালক নিয়োগে ভূমিকা নিতে পারে। পরে এই পরিচালকেরাই তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করবেন। কোম্পানি বা তার সংঘবিধি ও স্মারকে এ কথাই বলা আছে।
কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ করা হয়। শুরুতে কেবল সরকারের প্রয়োজনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কথা বললেও এই বিভাগ এখন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আবতীর্ণ হয়েছে। সরকার এসব ব্যাংকে পরিচালক, চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়। তাঁদের মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে, যা সংঘবিধি অনুসারে অবৈধ।
ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়োগ, এমনকি প্রায় সকল পর্যায়ে পদোন্নতির কমিটিতেও থাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধিত্ব। সব বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে মন্ত্রণালয়ে ছুটতে হয়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সমঝোতা চুক্তির শর্ত বা আর্থিক কর্মকাণ্ডের সূচকের উন্নতির দিকে আগ্রহ থাকে না ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের। ফলে এখন বাজারদরে শীর্ষ নির্বাহী নিয়োগ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না; বরং পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.