কোমর ব্যথা বা ব্যাক পেইন
বেশিরভাগ মানুষই জীবনের কোন না কোন সময় কোমর ব্যথাজনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন। আমাদের দেশে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চারজন জীবনের কোন না কোন সময়ে এই সমস্যায় ভোগেন। কোমর ব্যথার কারণ কোমর ব্যথার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ ভাগ হচ্ছে মেকানিক্যাল সমস্যা।
মেকানিক্যাল সমস্যা বলতে মেরুদ-ের মাংসপেশী, লিগামেন্ট মচকানো, আংশিক ছিঁড়ে যাওয়া, দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক সমস্যা, কশেরুকার অবস্থানের পরিবর্তন ও মেরুদ-ের নির্দিষ্ট বক্রতার পরিবর্তনকে বোঝায়। চলাফেরা, জীবিকার ধরন, ধুব বেশি ভার বা ওজন বহন, মেরুদ-ের অতিরিক্ত নড়াচড়া, একটানা বসে বা দাঁড়িয়ে কোন কাজ করা, মেরুদ-ে আঘাত পাওয়া, সর্বোপরি কোমরের অবস্থানগত ভুলের জন্য হয়ে থাকে। অন্যান্য কারণের মধ্যে বয়সজনিত মেরুদ-ে ক্ষয় বা বৃদ্ধি, অস্টিওআথ্রাইটিস বা গেঁটে বাত, অস্টিওপোরোসিস, এনকাইলজিং স্পনডাইলোসিস, মেরুদ-ের স্নায়বিক সমস্যা, টিউমার ক্যান্সার, বোন টিবি, কোমরের মাংসপেশীর সমস্যা, পেটের বিভিন্ন ভিসেরার রোগ বা ইনফেকশন, বিভিন্ন স্ত্রীরোগজনিত সমস্যা, মেরুদ-ের রক্তবাহী নালির সমস্যা, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, মেদ বা ভুঁড়ি অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি।
উপসর্গ
কোমরের ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়তে পারে বা হঠাৎ প্রচ- ব্যথা হতে পারে। নড়াচড়া বা কাজকর্মে ব্যথা তীব্র থেকে বীব্রতর হতে পারে। ব্যথা কোমরে থাকতে পারে বা কোমর থেকে পায়ের দিকে নামতে পারে অথবা পা থেকে কোমর পর্যন্ত উঠতে পারে। অনেক সময় কোমর থেকে ব্যথা মেরুদ-ের পেছন দিক দিয়ে মাথা পর্যন্ত উঠতে পারে। রোগী অনেকক্ষণ বসতে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ব্যথার সঙ্গে পায়ে শিন-শিন বা ঝিন-ঝিন জাতীয় ব্যথা নামতে বা উঠতে পারে, হাঁটতে গেলে পা খিচে আসে বা আটকে যেতে পারে, ব্যথা দুই পায়ে বা যেকোন এক পায়ে নামতে পারে।
অনেক সময় বিছানায় শুয়ে থাকলে ব্যথা কিছুটা কমে আসে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে রোগীর কোমর ও পায়ের মাংসপেশীর ক্ষমতা কমে আসে এবং শুকিয়ে যেতে পারে, সর্বোপরি রোগী চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
যেহেতু আধুনিক এই যুগেও কোমর ব্যথা একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাস্থ্য সমস্যা; তাই এ সমস্যার সমাধানে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
প্রতিকার
ফার্মাকোথেরাপি : চিকিৎসকরা রোগীকে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সাধারণত ব্যথানাশক এনএসএআইডিএস গ্রুপের ওষুধ, মাসল রিলাক্সজেন ও সেডেটিভজ জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন। যেহেতু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে সেজন্য অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করা আবশ্যক।
ফিজিওথরাপি : কোমর ব্যথাজনিত সমস্যার অত্যাধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে ফিজিওথেরাপি। এই চিকিৎসাব্যবস্থায় চিকিৎসক রোগীকে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি, লাম্বার ট্রাকশন শর্টওয়েভ ডায়াথার্মি, অতিলোহিত রশ্মি, ইন্টারফেরেনশিয়াল থেরাপি, ইনফারেড রেডিয়েশন, ট্রান্স কিউটেনিয়াস ইলেকট্রিক নার্ভ ইস্টিমুলেটর, ইলেকট্রিক নার্ভ ও মাসেল ইষ্টিমুলেটর, অটো মেনুয়াল ট্রাকশন, হাইড্রোথেরাপি, লেজার থেরাপি ও বিভিন্ন প্রকার ব্যায়ামের মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তা ছাড়া চিকিৎসা চলা অবস্থায় কোমরে নির্দিষ্ট অর্থোসিস বা ব্রেস প্রয়োগ করে থাকেন।
সার্জারি : যদি দীর্ঘদিন ফার্মাকোথেরাপি ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা চালানোর পরও রোগীর অবস্থার পরিবর্তন না হয় রোগীকে অবস্থা অনুযায়ী কোমর-মেরুদ-ের অপারেশন বা সার্জারির প্রয়োজন হয়। সার্জারির পরবর্তীতে রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নির্দেশ মতো নির্দিষ্ট ব্যায়াম দীর্ঘ দিন চালিয়ে যেতে হয়।
দৈনন্দিন কাজে সতর্কতা
নিচ থেকে কিছু তোলার সময়-
* কোমর ভাঁজ করে কিংবা ঝুঁকে তুলবেন না। হাঁটু ভাঁজ করে তুলুন।
কোন কিছু বহন করার সময়
* ঘাড়ের ওপর কিছু তুলবেন না।
* ভারি জিনিস শরীরের কাছাকাছি রাখুন।
* পিঠের ওপর ভারি কিছু বহন করার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে বহন করুন।
দাঁড়িয়ে থাকার সময়
* ১০ মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
* হাঁটু না ভেঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকবেন না।
* দীর্ঘক্ষণ হাঁটতে বা দাঁড়াতে হলে উঁচু হিল পরবেন না।
* অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হলে কিছুক্ষণ পর পর শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিন।
* দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ছোট ফুট রেস্ট ব্যবহার করুন।
যানবাহনে চড়ার সময়
* গাড়ি চলানোর সময় স্টিয়ারিং হুইল থেকে দূরে সরে বসবেন না। সোজা হয়ে বসুন।
* ভ্রমণে ব্যথার সময় লাম্বার করসেট ব্যবহার করুন।
বসে থাকার সময়-
* আপনার চেয়ারটি টেবিল থেকে বেশি দূরে নেবেন না।
* সামনে ঝুঁকে কাজ করবেন না।
* কোমরের পেছনে সাপোর্ট দিন।
* এমনভাবে বসুন যাতে ঊরু মাটির সমান্তরালে থাকে।
* নরম গদি বা স্প্রিংযুক্ত সোফা বা চেয়ারে বসবেন না।
শোয়ার সময়
* উপুড় হয়ে শোবেন না। ভাঙ্গা খাট, ফোম বা স্প্রিংয়ের খাটে শোবেন না।
* সমান তোশক ব্যবহার করুন।
* বিছানা শক্ত, চওড়া ও সমান হতে হবে। শক্ত বিছানা বলতে সমান কিছুর ওপর পাতলা তোশক বিছানোকে বোঝায়।
মেয়েরা যেসব নিয়মকানুন মেনে চলবেন
* অল্প হিলের জুতো বা স্যান্ডেল পরুন, বিভিন্ন জুতোর হিলের উচ্চতা বিভিন্ন না হওয়াই উচিত।
* তরকারি কাটা, মসলা পেষা, কাপড় কাচা ও ঘর মোছার সময় মেরুদ- সাধারণ অবস্থায় এবং কোমর সোজা রাখুন।
* কোমর ঝুঁকে বাচ্চাকে কোলে নেবেন না। ঝাড়ু দেয়া, টিউবওয়েল চাপার সময় কোমর সোজা রাখবেন।
* মার্কেটিং বা শপিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট দাঁড়ানো বা হাঁটার পরে বিশ্রামের জন্য একটু বসবেন।
* বিছানা গোছানোর সময় কোমর ভাঁজ না করে বরং হাঁটু ভেঙ্গে বসা উচিত।
কোমর ব্যথা বেশি হলে বিছানা থেকে শোয়া ও ওঠার নিয়ম
* চিৎ হয়ে শুয়ে এক হাঁটু ভাঁজ করুন।
* এবার অন্য হাঁটুটি ভাঁজ করুন। হাত দুটি বিছানায় রাখুন।
* এবার ধীরে ধীরে এক পাশ কাত হোন।
* পা দু’টি বিছানা থেকে ঝুলিয়ে দিন, এবার কাত হওয়া দিকের হাতের কনুই এবং অপর হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসুন।
* দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে বসুন এবং মেঝেতে পা রাখুন।
* এবার দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে দাঁড়ান।
ওজন কমান
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করুন
গরু, খাসির মাংস, ডালজাতীয় খাবার, মিষ্টিজাতীয় খাবার, তৈলাক্ত খাবার খাদ্য তালিকা থেকে কমিয়ে শাকসবজি, তরিতরকারি, ফলমূল খাদ্য তালিকায় বেশি করে রাখুন।
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন এবং যাদের দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস আছে, তা বন্ধ করে রাতে শিগগিরই শুয়ে পড়ুন।
ডা. মোঃ সফিউল্যাহ্্ প্রধান
পেইন ও ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, ডিপিআরসি, ২ প্রবাল হাউজিং, রিং রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
মোবাইল : ০১৭১৬৩০৬৯১৩।
No comments