রায়েই সমাধান আছে সঙ্কটও কেটে যাবেঃ বিচারপতি খায়রুল হক by নাশরাত চৌধুরী
সময়ের তপ্ত ইস্যু তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। এর পক্ষে ও বিপক্ষে অনড় অবস্থান নিয়ে বিভাজিত হয়ে পড়েছে জাতি। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালেও সমাধান আসেনি। প্রধান বিচারপতির সংক্ষিপ্ত রায়ের পর-পরই সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদ।
রোববার রাতে এসেছে পূর্ণাঙ্গ রায়। এরপর সৃষ্টি হয়েছে সংবিধানের আরও সংশোধনীর পরিস্থিতি। দেশের ধূমায়মান পরিস্থিতিতে কি ভূমিকা রাখবে প্রধান বিচারপতির এ পর্যবেক্ষণ ও অভিমত? তিনি নিজেই বা কি ভাবছেন? গতকাল সোমবার সকালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক কথা বলেন মানবজমিন-এর সঙ্গে। উত্তর দেন সময়ের জ্বলন্ত কিছু প্রশ্নের। বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল- এটি বৈধ ও আইনসম্মত। আমাদের এখানে আপিলটি এসেছিল হাইকোর্টের রায় ঠিক কি বেঠিক, এটি বৈধ কি অবৈধ- সে প্রশ্ন নিয়ে। এ কারণে আমাদেরকে সে বিচারই করতে হয়েছে। বলতে হয়েছে- এটি অবৈধ ও বেআইনি। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর বাইরে আমরা চাইলেও অনেক কথা বলতে পারি না। তবে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে আমরা এরপরও অনেক কথা লিখেছি। কারণ, এর প্রয়োজন ছিল।
এই রায়ে তো আসলে কোন সমাধান নেই, রাজনৈতিক সঙ্কটও কাটবে বলে মনে হচ্ছে না- আপনি কি মনে করেন?
এবিএম খায়রুল হক বলেন, এই রায়ে সমাধান অবশ্যই আছে। সঙ্কটও কেটে যাবে। আর সঙ্কট যাতে তৈরি না হয় কিংবা না বাড়তে পারে এই জন্যই বলা যেতে পারে অনেক কথা বলেছি। কারণ, সেখানে সমস্যা সমাধানের জন্য দু’টি উপায় বলে দেয়া হয়েছে। এক, ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। দুই, ছোট পরিসরে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা যেতে পারে। সেটা কেমন করে গঠন করা হবে তা সংসদেই ঠিক করতে হবে। যেহেতু অনির্বাচিতদের নিয়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে বারবার কথা উঠেছে, আপত্তি উঠেছে- এ কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কথা বলা হয়েছে। কারণ সরকারে জনগণের প্রতিনিধি থাকবেন না- এটা কেমন করে হয়? এ কারণে জনপ্রতিনিধির কথা বলেছি।
৪২ দিন সময় রাখার কারণ কি?
আমার কাছে মনে হয়েছে ৪২ দিন যুক্তিসঙ্গত সময়। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সব কর্মকাণ্ড সমাধা হতে পারে। এর পরও যদি সংসদ সদস্যরা মনে করেন তারা ৩০ দিন কিংবা ৬০ দিন সময় করবেন সেটাও তারা করতে পারেন। সেই সুযোগ রয়েছে। আর যদি তারা এভাবে না মানেন তাহলে তারা চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা আগামী দুই মেয়াদের নির্বাচনের জন্য বহাল রাখতে পারেন। এ প্রথা বাতিল এ কথাটি আমরা বলিনি। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতিদের না রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে যদি কোন কারণে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে তারা কোন সমাধানে পৌঁছতে না পারেন তাহলে তারা চাইলে আবার প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদেরও রাখতে পারবেন। সেটা নির্ভর করছে সংসদ সদস্যদের ওপর। একজন বিচারক হয়ে সংসদকে আমরা কোন নির্দেশ দিতে পারি না। আর পারি না বলেই আমাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ রাখার পাশাপাশি কি কি করা বাঞ্ছনীয় ও করা যেতে পারে তা বলেছি। আমি মনে করি ভবিষ্যতে সরকার যে প্রথাই করুক না কেন এর একটি করতে হবে। অনির্বাচিত সরকার বিশ্বের কোন দেশেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ সেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব নেই। এখানে জনগণের প্রতিনিধি নিয়েই সরকার গঠন করা যাবে। তত্ত্বাধায়ক সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও জনপ্রতিনিধিদের কথা বলা হয়েছে।
অনেকেই বলেছেন, রায়টি সাংঘর্ষিক?
এটা যারা বলছেন তারা রায় না পড়েই বলছেন। এ রায়ে কোন সংঘর্ষ নেই। যা বলা হয়েছে তা সুস্পষ্ট।
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি- এর কারণ কি?
তিনি তার মতো করে বলবেন এটাই স্বাভাবিক। এর বেশিটুকু জানতে চাইলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দুই মেয়াদে রাখা যেতে পারে বলে যে মত দিয়েছি তা রায়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এই জন্য আমি সবাইকে রায়টি পড়তে বলবো।
রায় হওয়ার আগেই তো আওয়ামী লীগ সংসদে আইন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নির্বাচিত সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার কথা বলেছে। সেখানে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের ক্ষমতায় থাকার কথাও বলেছে। আপনার ছোট মন্ত্রিপরিষদের বিষয়টি মানলে কি ঘুরে-ফিরে বিষয়টি এমন হলো না যে আওয়ামী লীগ যে কাজটি করেছে সেটাই ঠিক?
তা নয়, কারণ রায় তাদেরকে মেনে সামনের দিকে এগোতে হবে। আর এ কারণেই তারা যেভাবে সংশোধনী এনে এখানকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে সেটা হবে না। কারণ, আমি ছোট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করার কথা ছাড়াও এ-ও বলেছি ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। ওই কারণে তারা চাইলেও সবাই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে পারবেন না। সংসদ ভাঙতে হবে। তারা পূর্ণাঙ্গ রায় হওয়ার আগেই সংশোধনী করে যে নতুন বিধান করেছেন- এখন তাতে সংশোধনী আনতে হবে।
ছোট মন্ত্রিপরিষদের প্রধান কে হবেন সেটা তো বলেননি? সঙ্কট তো থেকেই গেল?
এটা সংসদ সদস্যরা আলোচনা করে ঠিক করে নেবেন। এটা আমাদের বলা ঠিক হতো না।
এ রায় দেয়ার পর আপনার অনুভূতি কেমন?
এ রায় দেয়ার পর ভাল লাগছে। কারণ, এতদিন সময় গেলেও একদিনের মধ্যে রায়টি দেয়া সম্ভব হয়েছে- এটা একটা বড় ব্যাপার। সবাই চেষ্টা করেছি বলেই সম্ভব হয়েছে। না হলে এ রায় দিতে আরও এক মাস লাগতো।
আপনার মতে আপনার দেয়া দু’টি অপশনের মধ্যে কোনটি ভাল?
আমি মনে করি প্রথম অপশনটিই বেশি ভাল। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় না গিয়ে একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে যাওয়াই ভাল। তবে এখন সংসদ সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন তারা কি করবেন। ছোট আকারে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে কেবল রুটিন কাজ করা আর নির্বাচন কমিশনের হাতে সবকিছু- এটা ইংল্যান্ড ও ভারতে হয়। এটা করাই ভাল।
নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও ক্ষমতাশালী করার পক্ষে মত দিয়েছেন- এখানে কি তেমনভাবে নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারবে?
রায়ে বলে দেয়া হয়েছে কেমন করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সবাই যদি নির্বাচন কমিশনের কথার বাইরে না যান তাহলে কোন সমস্যা হবে না।
অনেকেই বলছেন, এই রায়ে কোন সমাধান নেই- রয়েছে দোটানা ও অনিশ্চয়তা?
এটা ঠিক নয়। এখানে দোটানার কিছুই নেই, অনিশ্চয়তারও কিছুই নেই। দু’টি অপশনের একটি ধরে সমাধানে আসতে হবে। এ রায় নিয়ে আমি ভীষণ আশাবাদী। আমি শেষ আট পৃষ্ঠায় সব বলেছি। এটা সবাইকে পড়তে বলবো।
যেখানে দুই দল আলোচনায়ই বসতে রাজি না, সেখানে সংসদে বসে আইন করে আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা ঠিক করার জন্য তারা একমত হবেন- এটা কি ভাবা যায়? তারা এক ইস্যুতে একমত- এমন কোন নজির অতীতে নেই। আপনি কি মনে করেন?
সমাধানে তো তাদেরকে আসতেই হবে। সময় একটু কম অথবা বেশি লাগবে। একমত না হওয়ার তো কোন বিকল্প নেই।
এ রায় দিয়ে আপনি সন্তুষ্ট?
হ্যাঁ, এ রায় দিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি বিশ্বাস করি, এর চেয়ে ভাল আর কোন রায় হতে পারে না এ বিষয়ে। এর জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি। আমি হচ্ছি ভাঙা কুলা। পঞ্চম সংশোধনী থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ সংশোধনী পর্যন্ত সবগুলোর রায়ই আমাকে দিতে হয়েছে। অন্য বিচারকরা কেমন রায় দিয়েছেন, রায় আমি কেমন দিয়েছি- এটা বিচার করবে জনগণ। আমার রায় আমি দেশ ও জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি। আমি নিজের রায় নিয়ে ওই ভাবে বলতে চাইনি। তবে রায়ে আমি নিজের রায় সম্পর্কে না বললেও তিনজন বিচারকের রায়ের প্রশংসা করেছি। ভাল বলেছি।
রায় প্রকাশের আগে দফায় দফায় বৈঠকের কারণ কি, বিশেষ কোন ঘটনা ছিল কি?
আমি পূর্ণাঙ্গ রায় জমা দেয়ার পর অন্য বিচারপতিরা রায় লিখেছেন। তাদের রায় আমার কাছে যাওয়ার পর যে সংশোধন করেছি, তার প্রেক্ষিতে অন্য বিচারপতিদেরও রায়টি পড়া দরকার ছিল। তারা পড়ে সংশোধন করতে সময় লেগেছে। রায়ের মূল ঘোষণা কি হবে তা-ও ঠিক করা হয়েছে। হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ের আলোকে যে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল রায়ে তা দেয়া হয়েছে।
এদিকে অবসরে যাওয়ার পর এবিএম খায়রুল হক রায় লিখতে পারেন কিনা, আইনিভাবে এটা বৈধ কিনা- এ নিয়েও নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। তবে এ তর্ক-বিতর্কের সঙ্গে তিনি একমত নন। বলেন, প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর রায় লিখতে কোন আইনি বাধা নেই। কারণ আপিলেট ডিভিশনের অনেক রায়ই বিচারপতিরা অবসরে গিয়ে লিখেছেন। যদি ওই নিয়মই হতো যে বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর আর রায় লিখতে পারবেন না তাহলে অনেক রায়ই বাতিল হয়ে যেতো। কিন্তু তা হওয়ার নয়। এটা লিখতেই হবে। অবসরে যাওয়ার পর স্ব স্ব বিচারপতি তার রায়গুলো লিখে শেষ করে যাবেন। এটা আগে থেকে হয়ে এসেছে। যারা এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা ভুল বলেন। তিনি আরও বলেন, দায়িত্ববোধ থেকেই রায়টি লিখেছি। রায় লেখার জন্য সরকারি কোন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়নি। অনেক কষ্টে রায় টাইপ করানো হয়েছে। এর পেছনে অনেক কষ্টের ইতিহাস রয়েছে। যেখানে রায় লেখার জন্য সম্মানী পাওয়া উচিত- সেখানে এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে নতুন বিতর্ক তৈরি করতে চান অনেকে।
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ- তিনি দল-মতের ঊর্ধ্বে নন। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, সকল দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠেই তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় দিয়েছেন। রায়টি যাতে বিরোধী দলেরও কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এজন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন, এ রায়টি তারাও মানবেন। যদিও মানা না মানা তাদের নিজস্ব এখতিয়ার। তবে দেশের স্বার্থ ও ভাল চাইলে মানা দরকার। এছাড়া তার রায় কার্যকর করার জন্য কোন ধরনের আদালত অবমাননার মামলা হবে বলে ভাবছেন না তিনি। ধরেই নিচ্ছেন সরকার ও বিরোধী দল তার রায় কার্যকর করবে। আদালতের রায় মানতে সবাই বাধ্য। তার ধারণা, কোন দলই আদালত অবমাননা করবে না। এই কারণে তিনি মনে করছেন না যে, ওই রায় কার্যকর করার জন্য আবার কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।
এবিএম খায়রুল হক বলেন, এই রায়ে সমাধান অবশ্যই আছে। সঙ্কটও কেটে যাবে। আর সঙ্কট যাতে তৈরি না হয় কিংবা না বাড়তে পারে এই জন্যই বলা যেতে পারে অনেক কথা বলেছি। কারণ, সেখানে সমস্যা সমাধানের জন্য দু’টি উপায় বলে দেয়া হয়েছে। এক, ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। দুই, ছোট পরিসরে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা যেতে পারে। সেটা কেমন করে গঠন করা হবে তা সংসদেই ঠিক করতে হবে। যেহেতু অনির্বাচিতদের নিয়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে বারবার কথা উঠেছে, আপত্তি উঠেছে- এ কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কথা বলা হয়েছে। কারণ সরকারে জনগণের প্রতিনিধি থাকবেন না- এটা কেমন করে হয়? এ কারণে জনপ্রতিনিধির কথা বলেছি।
৪২ দিন সময় রাখার কারণ কি?
আমার কাছে মনে হয়েছে ৪২ দিন যুক্তিসঙ্গত সময়। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সব কর্মকাণ্ড সমাধা হতে পারে। এর পরও যদি সংসদ সদস্যরা মনে করেন তারা ৩০ দিন কিংবা ৬০ দিন সময় করবেন সেটাও তারা করতে পারেন। সেই সুযোগ রয়েছে। আর যদি তারা এভাবে না মানেন তাহলে তারা চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা আগামী দুই মেয়াদের নির্বাচনের জন্য বহাল রাখতে পারেন। এ প্রথা বাতিল এ কথাটি আমরা বলিনি। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতিদের না রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে যদি কোন কারণে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে তারা কোন সমাধানে পৌঁছতে না পারেন তাহলে তারা চাইলে আবার প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদেরও রাখতে পারবেন। সেটা নির্ভর করছে সংসদ সদস্যদের ওপর। একজন বিচারক হয়ে সংসদকে আমরা কোন নির্দেশ দিতে পারি না। আর পারি না বলেই আমাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ রাখার পাশাপাশি কি কি করা বাঞ্ছনীয় ও করা যেতে পারে তা বলেছি। আমি মনে করি ভবিষ্যতে সরকার যে প্রথাই করুক না কেন এর একটি করতে হবে। অনির্বাচিত সরকার বিশ্বের কোন দেশেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ সেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব নেই। এখানে জনগণের প্রতিনিধি নিয়েই সরকার গঠন করা যাবে। তত্ত্বাধায়ক সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও জনপ্রতিনিধিদের কথা বলা হয়েছে।
অনেকেই বলেছেন, রায়টি সাংঘর্ষিক?
এটা যারা বলছেন তারা রায় না পড়েই বলছেন। এ রায়ে কোন সংঘর্ষ নেই। যা বলা হয়েছে তা সুস্পষ্ট।
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি- এর কারণ কি?
তিনি তার মতো করে বলবেন এটাই স্বাভাবিক। এর বেশিটুকু জানতে চাইলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দুই মেয়াদে রাখা যেতে পারে বলে যে মত দিয়েছি তা রায়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এই জন্য আমি সবাইকে রায়টি পড়তে বলবো।
রায় হওয়ার আগেই তো আওয়ামী লীগ সংসদে আইন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নির্বাচিত সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার কথা বলেছে। সেখানে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের ক্ষমতায় থাকার কথাও বলেছে। আপনার ছোট মন্ত্রিপরিষদের বিষয়টি মানলে কি ঘুরে-ফিরে বিষয়টি এমন হলো না যে আওয়ামী লীগ যে কাজটি করেছে সেটাই ঠিক?
তা নয়, কারণ রায় তাদেরকে মেনে সামনের দিকে এগোতে হবে। আর এ কারণেই তারা যেভাবে সংশোধনী এনে এখানকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে সেটা হবে না। কারণ, আমি ছোট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করার কথা ছাড়াও এ-ও বলেছি ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। ওই কারণে তারা চাইলেও সবাই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে পারবেন না। সংসদ ভাঙতে হবে। তারা পূর্ণাঙ্গ রায় হওয়ার আগেই সংশোধনী করে যে নতুন বিধান করেছেন- এখন তাতে সংশোধনী আনতে হবে।
ছোট মন্ত্রিপরিষদের প্রধান কে হবেন সেটা তো বলেননি? সঙ্কট তো থেকেই গেল?
এটা সংসদ সদস্যরা আলোচনা করে ঠিক করে নেবেন। এটা আমাদের বলা ঠিক হতো না।
এ রায় দেয়ার পর আপনার অনুভূতি কেমন?
এ রায় দেয়ার পর ভাল লাগছে। কারণ, এতদিন সময় গেলেও একদিনের মধ্যে রায়টি দেয়া সম্ভব হয়েছে- এটা একটা বড় ব্যাপার। সবাই চেষ্টা করেছি বলেই সম্ভব হয়েছে। না হলে এ রায় দিতে আরও এক মাস লাগতো।
আপনার মতে আপনার দেয়া দু’টি অপশনের মধ্যে কোনটি ভাল?
আমি মনে করি প্রথম অপশনটিই বেশি ভাল। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় না গিয়ে একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে যাওয়াই ভাল। তবে এখন সংসদ সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন তারা কি করবেন। ছোট আকারে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে কেবল রুটিন কাজ করা আর নির্বাচন কমিশনের হাতে সবকিছু- এটা ইংল্যান্ড ও ভারতে হয়। এটা করাই ভাল।
নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও ক্ষমতাশালী করার পক্ষে মত দিয়েছেন- এখানে কি তেমনভাবে নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারবে?
রায়ে বলে দেয়া হয়েছে কেমন করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সবাই যদি নির্বাচন কমিশনের কথার বাইরে না যান তাহলে কোন সমস্যা হবে না।
অনেকেই বলছেন, এই রায়ে কোন সমাধান নেই- রয়েছে দোটানা ও অনিশ্চয়তা?
এটা ঠিক নয়। এখানে দোটানার কিছুই নেই, অনিশ্চয়তারও কিছুই নেই। দু’টি অপশনের একটি ধরে সমাধানে আসতে হবে। এ রায় নিয়ে আমি ভীষণ আশাবাদী। আমি শেষ আট পৃষ্ঠায় সব বলেছি। এটা সবাইকে পড়তে বলবো।
যেখানে দুই দল আলোচনায়ই বসতে রাজি না, সেখানে সংসদে বসে আইন করে আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা ঠিক করার জন্য তারা একমত হবেন- এটা কি ভাবা যায়? তারা এক ইস্যুতে একমত- এমন কোন নজির অতীতে নেই। আপনি কি মনে করেন?
সমাধানে তো তাদেরকে আসতেই হবে। সময় একটু কম অথবা বেশি লাগবে। একমত না হওয়ার তো কোন বিকল্প নেই।
এ রায় দিয়ে আপনি সন্তুষ্ট?
হ্যাঁ, এ রায় দিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি বিশ্বাস করি, এর চেয়ে ভাল আর কোন রায় হতে পারে না এ বিষয়ে। এর জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি। আমি হচ্ছি ভাঙা কুলা। পঞ্চম সংশোধনী থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ সংশোধনী পর্যন্ত সবগুলোর রায়ই আমাকে দিতে হয়েছে। অন্য বিচারকরা কেমন রায় দিয়েছেন, রায় আমি কেমন দিয়েছি- এটা বিচার করবে জনগণ। আমার রায় আমি দেশ ও জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি। আমি নিজের রায় নিয়ে ওই ভাবে বলতে চাইনি। তবে রায়ে আমি নিজের রায় সম্পর্কে না বললেও তিনজন বিচারকের রায়ের প্রশংসা করেছি। ভাল বলেছি।
রায় প্রকাশের আগে দফায় দফায় বৈঠকের কারণ কি, বিশেষ কোন ঘটনা ছিল কি?
আমি পূর্ণাঙ্গ রায় জমা দেয়ার পর অন্য বিচারপতিরা রায় লিখেছেন। তাদের রায় আমার কাছে যাওয়ার পর যে সংশোধন করেছি, তার প্রেক্ষিতে অন্য বিচারপতিদেরও রায়টি পড়া দরকার ছিল। তারা পড়ে সংশোধন করতে সময় লেগেছে। রায়ের মূল ঘোষণা কি হবে তা-ও ঠিক করা হয়েছে। হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ের আলোকে যে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল রায়ে তা দেয়া হয়েছে।
এদিকে অবসরে যাওয়ার পর এবিএম খায়রুল হক রায় লিখতে পারেন কিনা, আইনিভাবে এটা বৈধ কিনা- এ নিয়েও নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। তবে এ তর্ক-বিতর্কের সঙ্গে তিনি একমত নন। বলেন, প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর রায় লিখতে কোন আইনি বাধা নেই। কারণ আপিলেট ডিভিশনের অনেক রায়ই বিচারপতিরা অবসরে গিয়ে লিখেছেন। যদি ওই নিয়মই হতো যে বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর আর রায় লিখতে পারবেন না তাহলে অনেক রায়ই বাতিল হয়ে যেতো। কিন্তু তা হওয়ার নয়। এটা লিখতেই হবে। অবসরে যাওয়ার পর স্ব স্ব বিচারপতি তার রায়গুলো লিখে শেষ করে যাবেন। এটা আগে থেকে হয়ে এসেছে। যারা এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা ভুল বলেন। তিনি আরও বলেন, দায়িত্ববোধ থেকেই রায়টি লিখেছি। রায় লেখার জন্য সরকারি কোন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়নি। অনেক কষ্টে রায় টাইপ করানো হয়েছে। এর পেছনে অনেক কষ্টের ইতিহাস রয়েছে। যেখানে রায় লেখার জন্য সম্মানী পাওয়া উচিত- সেখানে এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে নতুন বিতর্ক তৈরি করতে চান অনেকে।
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ- তিনি দল-মতের ঊর্ধ্বে নন। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, সকল দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠেই তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় দিয়েছেন। রায়টি যাতে বিরোধী দলেরও কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এজন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন, এ রায়টি তারাও মানবেন। যদিও মানা না মানা তাদের নিজস্ব এখতিয়ার। তবে দেশের স্বার্থ ও ভাল চাইলে মানা দরকার। এছাড়া তার রায় কার্যকর করার জন্য কোন ধরনের আদালত অবমাননার মামলা হবে বলে ভাবছেন না তিনি। ধরেই নিচ্ছেন সরকার ও বিরোধী দল তার রায় কার্যকর করবে। আদালতের রায় মানতে সবাই বাধ্য। তার ধারণা, কোন দলই আদালত অবমাননা করবে না। এই কারণে তিনি মনে করছেন না যে, ওই রায় কার্যকর করার জন্য আবার কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।
No comments