বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. ওসমান ফারুক-বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। সংকট নিরসনে সংলাপ অনুষ্ঠানের তাগিদ সব দিক থেকে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেশের রাজনীতির সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক।


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব ও মোশাররফ বাবলু
কালের কণ্ঠ : সাড়ে তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। সরকারের এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. ওসমান ফারুক : বাংলাদেশে কোনো সরকার শতভাগ সফল বা শতভাগ ব্যর্থ- এটা বলা মুশকিল। এটি সমস্যাসংকুল একটি দেশ। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করতে হবে নির্বাচনী অঙ্গীকার বিবেচনায় এনে। নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, কিভাবে সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করেছে- এসব বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। প্রথমেই বলে রাখি, এ সরকার একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এসেছে। বিএনপি তো এখনো মনে করে ২০০৮ সালের নির্বাচন একটি পাতানো নির্বাচন ছিল। বিএনপির ধারণা, ২০০৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। তৎকালীন সেনাসমর্থিত সরকারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার ভিত্তিতে শেখ হাসিনা নির্বাচনী বৈতরণী পার হন। শুরুতে খালেদা জিয়া এই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে যান। এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলো এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করল। খালেদা জিয়া চেষ্টা করেছেন একটি অশুভ শক্তির হাত থেকে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে। পর্যাপ্ত আসন না পেলেও ৩২-৩৩ শতাংশ ভোট বিএনপি পেয়েছে। আসন সংখ্যা দিয়ে বিএনপির মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। গণতন্ত্রের জন্য শুরুতেই বিএনপি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে গিয়েছিলেন। যেভাবেই নির্বাচন হোক না কেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকারকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ইশতেহার ছিল, সেটা খুবই সুখপাঠ্য। চমৎকার শোনায়। ইশতেহারটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী মেনিফেস্টো উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়াটা দোষের নয়। সেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী ওয়াদার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এই সাড়ে তিন বছরে খুব কমই বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সরকার।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে আমি মনে করি, সম্পূর্ণ অব্যবস্থাপনার স্বাক্ষর রেখেছে বর্তমান সরকার। বর্তমান অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প পরিচালক ছিলেন। এডিবির পরিচালক ছিলেন। অর্থসচিব ছিলেন, ইআরডি সচিব ছিলেন। কিন্তু তাঁর সময়ে এসেই অর্থনীতি একটি বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। ভাববেন না, আমি ভাবাবেগে বলছি বা নিছক সমালোচনার খাতিরে সমালোচনা করছি। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন- সবার সমীক্ষা দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সবাই গত সাড়ে তিন বছরের অর্থনৈতিক অবস্থার সমালোচনা করেছে। একটু ব্যাখা করি। ২০০৬ সালে সামষ্টিক অর্থনীতির যে স্বাস্থ্য ছিল, ক্রমেই তার অবনতি হয়েছে। ২০০৬ সালে যখন আমরা ক্ষমতা থেকে যাই তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৭ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ছিল ৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ শতাংশ। সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচক এ দেশের জন্য ভালো অবস্থায় ছিল। এরপর থেকে ক্রমেই কমে আসছে। কমে আসা মানে হচ্ছে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই বছর ৬.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৬ থেকে এ পর্যন্ত অর্থাৎ অর্ধযুগেও সেই ২০০৬-এর অঙ্কে পৌঁছতে না পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো কোথায়? নিয়মিত বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একটি বিশাল ভর্তুকির বাজেট দেওয়া হচ্ছে। গার্মেন্ট শিল্পে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। ৭৫ হাজার পোলট্রি ফার্ম বন্ধ। শিল্প প্রবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু আগের মতো সেই হার নেই। আমদানি-রপ্তানির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, রপ্তানি বৃদ্ধির হার কমেছে। মূল্যস্ফীতি কমানো যায়নি। বিশেষ করে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ওপরের দিকে। মানুষের কর্মসংস্থান খুব একটা বেশি হয়নি। ভারতে ঘরে ঘরে চাকরি, বছরে কমপক্ষে ১০০ দিন কাজ- এমন একটা কর্মসৃজন পদ্ধতি আছে- আমি এটাকে ভালো মনে করি। মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকারে এটা ছিল। সেটা হয়নি। অর্থনীতির স্বাস্থ্য খারাপ। মাত্র একটা ক্ষেত্র, খাদ্য উৎপাদনে দেশটা বেশ ভালো অবস্থানে আছে। সে কারণে মানুষ হয়তো অভুক্ত নেই। সরকারের আরেকটা ব্যর্থতার জায়গা হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের ব্যাপারে মার্চ ২০১১ সাল পর্যন্ত সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। হঠাৎই কুইক রেন্টালে চলে গেল। কুইক রেন্টালের ব্যাপারে ইনডেমনিটি দেওয়া হলো। সরকারি ক্রয়ে যত রকমের ফাঁকফোকর আছে, দুর্নীতি আছে, তা করা হয়েছে। অনিয়ম করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়েছে ফার্নেস অয়েল। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে গেছে। প্রতিবছরের বিদ্যুৎ চাহিদা স্থায়ীভাবে মেটানোর জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল, সেটা এ সরকার করেনি। পুরো বিদ্যুৎ খাত নিয়ে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সবদিক বিবেচনা করলে সরকারে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাটাই বেশি ভারী।
কালের কণ্ঠ : মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল সুশাসন নিশ্চিত করা। সেটা কতটুকু করতে পেরেছে সরকার?
ড. ওসমান ফারুক : বিষয়টি তো দৃশ্যমান। সুশাসনের বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে ঘটে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কেমন, দুর্নীতি কেমন করে দমন করা হচ্ছে, মানবাধিকার কেমন করে রক্ষা করা হচ্ছে- এসবের ওপর সুশাসন নির্ভর করে। মানবাধিকারের বিষয়টি তো সবার কাছে স্পষ্ট। বাইরেও সবাই এক কথা বলে- এ দেশে মানবাধিকার ভীষণভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের আমলেও রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মানুষকে। সেটা একটা অস্বাভাবিক সরকার ছিল। এ সরকারও রিমান্ডে নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যত মামলা ছিল, সবই খারিজ হয়ে গেছে। বিএনপিরগুলো খারিজ হচ্ছে না। এটা অপশাসনের একটি লক্ষণ। এ সরকারের আমলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। মানবাধিকার ক্রমেই লঙ্ঘিত হচ্ছে। হত্যা-গুম-রাহাজানি বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এম ইলিয়াস আলীর খোঁজ মেলেনি। আমিনুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে। এসব কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কাজেই সুশাসনের বিষয়টিকে অলীক বিষয় বলেই মনে হচ্ছে। দুঃশাসনের যত রকম ফাঁকফোকর সবই এ সময় সৃষ্টি হয়েছে। ঈদের আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, বাড়িতে যাওয়ার সময় ঘরে তালা দিয়ে যাবেন। এ থেকে কী প্রমাণ হয়। সরকার সব ধরনের দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চায়। মানুষের ঘরে নিরাপত্তা নেই, রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা নেই, ক্রসফায়ার থেকে নিরাপত্তা নেই- তাহলে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? আমি তো মনে করি, সুশাসন সম্পূর্ণভাবে নির্বাসনে। সবচেয়ে দুঃখের ও চিন্তার কথা হলো, সরকারের অর্থমন্ত্রী বা সরকার স্বীকার করে না যে এ দেশে একটি অর্থনৈতিক সংকট চলছে। এ দেশে যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, এ দেশে যে দুঃশাসন চলছে, ড. ইউনূসকে নিয়ে যে ঘটনা চলছে, তাতে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। পদ্মা সেতু যে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে- এটাও সরকার স্বীকার করে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশের কথাই ধরি। একটা ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। আর আমাদের এখানে একজন মন্ত্রীর পদত্যাগ করতে ১১ মাস লাগল! এক মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে সন্দেহজনক টাকা পাওয়া গেল। সেই মন্ত্রীকে পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়া হলো না। এগুলো তো সুশাসনের লক্ষণ নয়।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী? আপনার কি মনে হয়, মন্ত্রীদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে বা হচ্ছে?
ড. ওসমান ফারুক : দেখুন, আমি সব সময় বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্ম আস্তে আস্তে নেতৃত্ব নেবে। যখন এই মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তখন অনেক পুরনো ও অভিজ্ঞ মন্ত্রী বাদ পড়ে যান। সবাই প্রায় নতুন মুখ। একজন তো রসিকতা করে বলেছিলেন, এই মন্ত্রিসভা কচিকাঁচার মেলা। নতুন মুখ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করায় আমি দোষের কিছু দেখি না। কারণ তাঁদের তো গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু পরবর্তী সময় দেখা যাচ্ছে, এই মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাঁদের অনেকের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় না তাঁরা মন্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞাত। আমি মনে করি, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা সর্বকালের অদক্ষ ও অযোগ্য মন্ত্রিসভা হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে সবাইকে এক কাতারে ফেলা ঠিক হবে না। কয়েকজন তো অত্যন্ত যোগ্য মন্ত্রী রয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগই গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পারফরম্যান্স ও কথাবার্তা থেকে যোগ্যতা মাপা যায় না। অনেক মন্ত্রীর অতিকথনে তো তাঁদের নিজেদের লোকজনই বিরক্ত।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কি ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
ড. ওসমান ফারুক : শুরুতেই বলে রাখি, মুক্ত অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ খুব কঠিন। কিন্তু মুক্ত অর্থনীতিতে বাজার ঠিকমতো চলছে কি না, সেটা রেগুলেট করা যায়। বাজার ঠিকমতো না চললে, প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব। এখানে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কথা শুনি। ঘাটে-ঘাটে, রাস্তায়-রাস্তায় চাঁদাবাজির কথা শুনি। আমি মনে করি, বাজার ব্যবস্থাপনায় যে ধরনের মনিটরিং প্রয়োজন ছিল, সেটা সরকার করতে পারেনি। এই করতে না পারার একটি কারণ হচ্ছে দলীয়করণ। আমি মনে করি, সরকার ইচ্ছা করলে বাজারের অনেক অব্যবস্থা দূর করতে পারে। অপপ্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দলীয় কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আগেই বলেছি, খাদ্যবহির্ভূত জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। খাদ্যসামগ্রীর দাম এমনভাবে কমেছে, এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল্য ব্যবস্থাপনায় কোনো দক্ষতা দেখাতে পারেনি সরকার। মূল্য ব্যবস্থাপনা এমন একটা জিনিস, যেখানে দেখতে হয় ভোক্তাদের অতি উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে কি না। অন্যদিকে উৎপাদকদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে না। মূল্য ব্যবস্থাপনা জিনিসটা সরকার বোঝে বলে মনে হয় না। তারা একেক সময় একেক কথা বলে। কম খান, এক দিন বাজার কম করেন- এসব কথা বলে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মূল্য ব্যবস্থাপনার একটি তাত্তি্বক এবং ব্যবহারিক দিক রয়ে গেছে। আপনি কী মূল্য দিতে চান যাতে ভোক্তা এবং উৎপাদকের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়, সে ধরনের কোনো চিন্তাভাবনা সরকার করে বলে মনে হয় না। মুক্তবাজারে বিভিন্ন ধরনের সুবিধাভোগী থাকে। ব্যবসায় মুনাফা থাকবেই। দেখার বিষয় হচ্ছে, কিভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : এর পাশাপাশি শেয়ারবাজার নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। শেয়ারবাজার নিয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই।
ড. ওসমান ফারুক : শেয়ার একটা কম্যুডিটি। এটা বিক্রি হবে। শেয়ারবাজার ওঠানামা করতেই পারে। অনেক সময় ব্যাপক ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু এই ওঠানামার পেছনে বড় ধরনের কোনো কারসাজি আছে কি না, সেটাই হচ্ছে দেখার মূল বিষয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়েছিল। সেটারই পুনরাবৃত্তি ঘটল এ সরকারের আমলে। আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে অনেকবার এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারকে হুঁশিয়ার করেছি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেটা প্রকাশ করা হলো না। শেয়ারবাজার নিয়ে সরকার যা করেছে, সেটা সম্পূর্ণ অস্বচ্ছতা। যারা দোষী, শেয়ারবাজার লুণ্ঠনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কোনো বিচার হলো না। শেয়ারবাজার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। প্রায় দেড় কোটি মানুষ রাস্তায় বসে গেছে। আমি তো মনে করি, শেয়ারবাজারে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। এক দিকে যারা শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তাদের রক্ষা করা হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের সেই টাকা সাদা করার জন্য সরকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কী হবে? এখানেও সরকার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান ধারায় আপনার কি মনে হয় আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে?
ড. ওসমান ফারুক : এ মুহূর্তে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রটি অত্যন্ত হতাশাজনক। আমি মনে করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো বর্তমান সরকারের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এত বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নিকট অতীতে কোনো দল তো ক্ষমতায় আসেনি। বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতা ও সম্প্রীতিমূলক অবস্থান তৈরি করা। সেটা হয়নি। সংসদে বিরোধী দলের নেত্রীকে গালাগাল করা হয়। জিয়াউর রহমানকে রাজাকার বলা হয়। আরো অনেক ঘটনা আছে সংসদের ভেতরে ও বাইরে। তখন কিন্তু সুস্থ রাজনীতির পরিবেশ ব্যাহত হয়। রাজনীতি সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়েছে সংবিধানে জোড়াতালি দেওয়া একটা সংশোধনী আনার পর। হাইকোর্টের একটি রায়, যেটা এখনো লেখা হয়নি, প্রকাশিত হয়নি- তার খণ্ডিত একটি অংশের ওপর ভিত্তি করে- সেটারও একটি পূর্ণ ব্যাখ্যা না দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। শুধু বিরোধী দল নয়, দেশে-বিদেশে অনেকের কাছেই এটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই সংশোধনীর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই দেশে কেউ যেন আর অন্যায়ভাবে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে জন্য এই সংশোধনী আনা হয়েছে। আমি বলব, এই দেশে কোনো সরকার যখন সরকারে থাকে, তাদের যেন ভোটে ক্ষমতাচ্যুত না করা যায়, সে জন্যই সংশোধনী আনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, সংসদ থাকবে- এটা তো সম্ভব নয়। এখন আবার বলা হচ্ছে পাঁচজন-পাঁচজন কী একটা!
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন- এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
ড. ওসমান ফারুক : বিএনপির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন- যে নামেই ডাকা হোক, এতে কিছু এসে যায় না। কথা একটাই। সেটা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ হতে হবে। নির্বাচন কমিশনকেও নিরপেক্ষ হতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সেদিন বক্তব্য দিলেন, দেশের জনগণ সংবিধানের এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে। তাঁর তো এই রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি বলতে পারতেন, সংবিধানের বিধান অনুযায়ী আমি নির্বাচন পরিচালনা করব। কিন্তু 'দেশের জনগণ মেনে নিয়েছে'- এটা বলে তিনি তো একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করে ফেললেন। নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। প্রশাসনে ও পুলিশে দলীয়করণ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সময় যদি এমন একটা সরকার থাকে, যেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং সেই সরকার করা হবে সংসদে যাঁরা আছেন তাঁদের নিয়ে- তাহলে তো সেই সরকার নির্দলীয় সরকার হলো না। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার এবং প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে হবে। তা না হলে নির্বাচন করেও কোনো লাভ নেই।
কালের কণ্ঠ : ইদানীং তৃতীয় শক্তি বলে একটা কথা শোনা যাচ্ছে। আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসন্ন- এমন কথাও অনেককেই বলতে শোনা যায়? এই তৃতীয় শক্তি কিংবা নতুন ওয়ান-ইলেভেন সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
ড. ওসমান ফারুক : কোনটা যে তৃতীয় শক্তি আর কোনটা যে চতুর্থ শক্তি, সেটা বোধ হয় আমাদের জানা আছে। আমি মনে করি, গণতান্ত্রিক যে ধারা রয়েছে, সেটা ব্যাহত হওয়া উচিত নয়। সেই ধারা তখনই ব্যাহত হবে, যখন বড় রাজনৈতিক দলগুলো মূল ইস্যুতে কোনো সমঝোতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ যে পথে যাচ্ছে, তাতে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার কোনো বাণী তারা উচ্চারণ করেনি। সমঝোতার কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি। ভেতরে-বাইরে সমঝোতার কোনো পরিবেশ এখন পর্যন্ত নেই। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব সরকারি দলের। রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, তথাকথিত তৃতীয় শক্তি যদি আসে, রাজনীতি যদি ব্যাহত হয়, তাহলে কোনো রাজনৈতিক দলই রেহাই পাবে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি সমঝোতায় আসতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সেই সমঝোতার সূত্র হতে পারে সংলাপ- এমন কথা বলছেন অনেকেই। আপনার কী মত?
ড. ওসমান ফারুক : সংলাপ তো হতেই হবে। নানাভাবে সংলাপ শুরু করা যেতে পারে। সংলাপ যদি হতে হয়, 'ইট হ্যাজ টু বি ভেরি স্ট্রাকচারড'। মিনিমাম একটা ফ্রেমওয়ার্ক থাকবে আমরা কী অ্যাচিভ করতে চাই। আমাদের সংলাপের উদ্দেশ্য কী, বর্তমান সমস্যা কী- এটা স্পষ্ট হতে হবে। এজেন্ডার চেয়ে বড় কথা একটা ফ্রেমওয়ার্ক দরকার। সেই ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে সিরিয়াস আলাপ হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে আলাপ হবে। এর বাইরেও স্বচ্ছতার সঙ্গে আলাপ হতে পারে। আলাপটা আন্তরিকতার সঙ্গে শুরু করতে হবে। এর দায়িত্বটা কিন্তু সরকারের। কেননা সরকার ঘোড়ার ওপর বসে আছে। 'আমরা যা দিচ্ছি, তা-ই নাও'- বিরোধী দলের সঙ্গে এভাবে আচরণ করা ঠিক নয়। এভাবে তো আর সংলাপ করা যাবে না। সংলাপের আগে আমাদের একটা শর্ত আছে। সংলাপ শুরুর আগে সরকারকে নীতিগতভাবে স্বীকার করতে হবে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তারা প্রস্তুত এবং এ কারণে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে সরকার প্রস্তুত। এ প্রতিশ্রুতি না দিলে তো কোনো সংলাপ কাজে আসবে না। হয়তো বসা হবে। আলোচনা হবে, ঝগড়া-বিতণ্ডাও হতে পারে, কিন্তু কোনো ফল হবে না।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে? সেই দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন কোথায়?
ড. ওসমান ফারুক : আগে সংসদ ধরে রাখার প্রসঙ্গে আসি। সংসদের কার্যকলাপের ওপর একটা রিপোর্ট বেরিয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছে, সংসদ অধিবেশনে প্রতি মিনিটের জন্য খরচ হয় ৪২ হাজার টাকা। এর পরও এই সংসদে কোরামের অভাব থাকে। উপরন্তু এই সংসদে কোনো কিছুই তো আলোচনা হয় না। সংসদকে বিরোধী দল অকার্যকর করে রাখেনি। চুক্তি থেকে শুরু করে কোনো কিছুই তো আলোচনা হয় না সংসদে। সংসদ এমনিতেই অকার্যকর। সেখানে ৭০০ বারেরও বেশি প্রধানমন্ত্রীর স্তুতি হয়েছে, ৬০০ বারেরও বেশি বিরোধী দলের নেত্রীকে গালি দেওয়া হয়েছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৭ শতাংশ সময় গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। কাজেই সংসদ যে খুব একটা কার্যকর সংসদ, তা নয়। এর পরও সংসদ কার্যকর করার দায়িত্ব কিন্তু সংসদ নেতার। সংসদে তিনি কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা নন। পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব রয়েছে স্পিকারেরও। এ দায়িত্ব তাঁরা দুইজনের একজনও পালনি করেননি।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের জোট সম্প্রসারিত হয়েছে। এই জোট দেশের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করেন আপনি?
ড. ওসমান ফারুক : একটা রাজনৈতিক দল শুধু সংসদের ভেতরেই সক্রিয় থাকে না। সংসদের ভেতরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে। আজকে দেশের যে পরিস্থিতি, আজকে বলতে এই সরকারের আমলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ, বীতশ্রদ্ধ। দেশের মানুষ সরকারের বিপক্ষে চলে গেছে। একটি রাজনৈতিক দলের মূল কর্তব্য হচ্ছে দেশের সমস্যা মানুষের সামনে তুলে ধরা। জনমত গঠন করা। আমাদের এখানে বলে রাস্তায় বক্তৃতা করা। বিদেশে এটাকেই বলে মবিলাইজিং পাবলিক ওপিনিয়ন। আমরাও যে পল্টনে বক্তৃতা করছি, মিছিল করছি- আমরা পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ করতে চাইছি। জনমত সংগঠিত করতে চাইছি। আমাদের আন্দোলন মোটেও সরকার উৎখাতের আন্দোলন নয়। সরকার আমাদের সব গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। সেখানে আমরা সংসদে গিয়ে কী করব? সরকার গণতান্ত্রিক হলে সংসদে গিয়ে কথা বলা যেত। এ সরকারের কাছে আমাদের লেভেল অব কমফোর্ট নেই। সে জন্যই আমরা বলছি, এ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যাবে না।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এ বিচার প্রক্রিয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ড. ওসমান ফারুক : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তামাদি হওয়ার নয়। কিন্তু এটাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। আসামিপক্ষের এক আইনজীবীকে তো আসতেই দেওয়া হয়নি। অনেক সাক্ষীকে নাকি জেরা করা যাবে না। কাগজে পড়েছি, অনেককে নাকি সেইফ হাউসে রেখে প্রশিক্ষণ দিয়ে সাক্ষী দেওয়া হচ্ছে। পুরো জিনিসটা একটা অস্বচ্ছ জায়গায় চলে যাচ্ছে, এমন সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ আছে। এতে ভয় হচ্ছে, সত্যিকার যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের হয়তো বিচার হবে না। আবার যুদ্ধাপরাধী না হয়েও রাজনৈতিক কারণে অনেকের বিচার হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কা রয়ে গেছে। আমি এখনো আশা করি, সরকার সব ত্রুটি সংশোধন করে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।
কালের কণ্ঠ : এ সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় পদ্মা সেতু। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী আবুল হোসেন পদত্যাগ করলেন। পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তা বাতিল নিয়ে যে ঘটনাপ্রবাহ- এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
ড. ওসমান ফারুক : পদ্মা সেতুর সূচনা ২০০৫ সালে আমাদের সময়ে। তখন আমরা জাইকার অর্থায়নে একটা প্রাক সমীক্ষা করেছিলাম। এটা একনেকে পাস হলো ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এরপর তো বর্তমান সরকার এলো। পদ্মা সেতু না হওয়াটা আমাদের জন্য খুব ক্ষতিকর- বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার মানুষের জন্য। আমি মনে করি, এটা সরকারের আরেকটা অব্যবস্থাপনা। একটি অপেশাদার ব্যবস্থাপনা। আর এই অব্যবস্থাপনা কিংবা অপেশাদার ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে শুধু একজন লোককে নিরাপদে রাখার জন্য। তিনি এখনো নিরাপদেই আছেন। প্রথম যখন বিশ্বব্যাংক সরকারকে চিঠি দেয়, তখনই সরকারের উচিত ছিল বিষয়টি শক্তভাবে দেখা। সরকারের তখনই বলা উচিত ছিল, কোনো বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে আমরা বসে সেটা আলাপ করে ঠিক করে নেব। বিশ্বব্যাংক কী বলতে চায়, সেটা শোনা উচিত ছিল। সরকার করল উল্টোটা। প্রকাশ্যে বিশ্বব্যাংকে দোষারোপ করা শুরু করে দিল। বিশ্বব্যাংক যদি অন্যায় কিছু করে থাকে, যদি অন্যায্য আচরণ করে থাকে- সেটা প্রতিকারের ব্যবস্থা ছিল। সেখানে তো আমাদের প্রতিনিধি আছেন। তিনি সেটা বোর্ডে তুলতে পারতেন। ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে, মূল সমস্যা পাশ কাটিয়ে চারপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করা হলো। নিজেদের মতো করে সেলফ ডিফেন্সিভ একটা অবস্থানে চলে যাওয়া হলো। আমি বিশ্বব্যাংকে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, ঋণচুক্তি বাতিল করার আগ পর্যন্ত নেগোসিয়েশন করা উচিত ছিল। এসব বিষয় নেগোসিয়েট করতে হয় সরল বিশ্বাসে। সরকার করল কী? বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যখন ঋণচুক্তি বাতিল হয়নি, তখন আবার মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটা নেগোসিয়েশন শুরু করে দিল। এটাও তো একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা ঠিকমতো দেখতে পারে না। এটা তো বিশ্বব্যাংকের অনুদান। এই অনুদানের জন্য বিশ্বের অনেক দেশ তাকিয়ে থাকে। আবার দেখুন, একটি বিষয়ে কত রকমের কথা। এক মন্ত্রী বলছেন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে যায়নি, তখনই আবার চাঁদা ওঠানো শুরু হয়ে গেল। মালয়েশিয়ার সঙ্গে কথা বলা শুরু হয়ে গেল। এখন দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, তদন্ত করবে। আবুল হোসেন সাহেবকে এখন সরিয়ে দেওয়া হলো। যদি বিশ্বব্যাংক অন্যায় করে থাকে, তাহলে তারা যে চিঠিগুলো দিয়েছে সেগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? বিষয়টি খোলাসা করে জনগণকে জানানো হয়নি। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী আমি জানতে চাই, বিশ্বব্যাংক আমাকে কেন চোর বলল। কিছুই প্রকাশ করা হচ্ছে না। কী দুর্বলতা? আবার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, সেলফ রিলায়েন্স একটা গর্বের ব্যাপার। কিন্তু সেটা কতটুকু সম্ভব। বাস্তবতা তো মানতে হবে। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে সরকারের কথা ও কাজ, সব কিছুতেই অপেশাদারিত্ব স্পষ্ট।
কালের কণ্ঠ : আগামী দেড় বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
ড. ওসমান ফারুক : দেড় বছর সরকারের জন্য গোছানোর সময়। আমিও তো একটা সরকারে ছিলাম। শেষ সময়ে চাপ অন্যরকম চলে আসে। ঘর গোছানোর চাপ। নির্বাচনের জন্য সাংগঠনিক দিকে যেতে হয়। রুটিন কাজের বাইরে এই দেড় বছরে কিছু করা সম্ভব হয় না। এ সরকার তো কিছু কিছু কাজ জটিল করে ফেলেছে। এই দেড় বছরে সরকার খুব বেশি একটা কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিকভাবে সরকার বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ?
ড. ওসমান ফারুক : আপনাদেরও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.