১০০০ টাকার সোডিয়াম বাতি ৩৪০০ করে কিনছে ডিসিসি by অমিতোষ পাল

ক হাজার টাকার সোডিয়াম বাতি তিন হাজার ৪০০ টাকা দরে কেনার সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। ব্রিটেনে তৈরি বলে চীনের তৈরি সাত হাজার নিম্নমানের বাতি গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব বাতির কোনো গ্যারান্টি নেই। যেকোনো মুহূর্তে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ডিসিসিকে তখন বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এসব বাতি কিনতে একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে।


ডিসিসির বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জাফর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাতি সরবরাহকারীরা দরপত্রের সঙ্গে নমুনা হিসেবে কিকো নামের সোডিয়াম বাতি জমা দেয়। এটা দেখার পর আমার মনে হয়েছে, এর মান জাপানি, জার্মান বা ইউরোপীয় মানের নয়। এটি রাস্তায় লাগালে যেকোনো সময় নষ্ট হয়ে যাবে।' তিনি বলেন, 'বাতি কেনার দায়িত্ব যেহেতু আমার নয়, কাজেই এর চেয়ে বেশি বলা আমার উচিত নয়।'
ঢাকা মহানগরীর রাস্তায় ব্যবহারের জন্য গত ১৩ অক্টোবর ৯০ ওয়াটের সাত হাজার সোডিয়াম বাতি কেনার দরপত্র আহ্বান করে ডিসিসির ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগ। এ জন্য ব্যয় ধরা হয় দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৩০ অক্টোবর দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত মাত্র দুটি দরপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে সেগুনবাগিচার মেসার্স কিকো লিমিটেড প্রতিটি সোডিয়াম বাতির দর দেয় তিন হাজার ৪০০ টাকা। আর বনশ্রীর সান পাওয়ার লিমিটেড দর দেয় চার হাজার টাকা। নিম্ন দরদাতা হিসেবে কিকো লিমিটেডকেই মনোনীত করে ভাণ্ডার বিভাগ। কিন্তু দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির এক সদস্য দেখতে পান, নমুনা হিসেবে কিকো লিমিটেডের জমা দেওয়া বাতিগুলো নিম্নমানের। সেগুলো চীনে তৈরি বলে তিনি নিশ্চিত হন; যদিও গায়ে লেখা 'মেড ইন ইউকে'। দরপত্রে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় দেশ ব্রিটেন, জার্মানি থেকে বাতি সরবরাহের কথা উল্লেখ করা ছিল। ওই সব দেশে এ ধরনের একটি বাতির দাম অন্তত ৩০ মার্কিন ডলার। আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও আমদানি খরচ মিলিয়ে একেকটির দাম প্রায় চার হাজার টাকা হওয়ার কথা।
ওই সদস্য এ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কিকো লিমিটেডের পক্ষ থেকে বলা হয়, নমুনা হিসেবে জমা দেওয়া বাতিগুলো অনেক দিন গুদামঘরে পড়ে ছিল। এ জন্য চেহারা মলিন হয়ে গেছে। বিষয়টি পরে ডিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তিনিও বাজার পর্যবেক্ষণ করে ওই বাতিকে নিম্নমানের বাতি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ ধরনের একটি বাতির দাম সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর পরও ডিসিসির ভাণ্ডার বিভাগ ওই বাতি কেনার ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেয়।
ডিসিসিতে সোডিয়াম বাতি সরবরাহকারী একজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, যে মানের সোডিয়াম বাতি ডিসিসি চেয়েছিল, ওই মানের বাতি সরবরাহ করতে হলে প্রতিটির নূ্যনতম দাম পড়বে তিন হাজার ৯০০ টাকা। তিন হাজার ৪০০ টাকা দরে কেউ সরবরাহ করতে চাইলে বুঝতে হবে বাতির মানে সমস্যা আছে।
ডিসিসির বিদ্যুৎ বিভাগের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, চীনে অনেক কম্পানি আছে, অর্ডার দিলে ৫০০ টাকায়ও সোডিয়াম বাতি বানিয়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হতে চলেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'হালিম নামের একজন ঠিকাদার এসে আমাকে বলে গেছেন, চার হাজার টাকার নিচে বাতি সরবরাহ করতে পারব না বলে আমি দরপত্রে অংশই নিইনি।'
কিকো লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. আদনান কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, 'আমরা নমুনা হিসেবে যেটা দিয়েছিলাম, সেটা ব্রিটেনেই তৈরি। কিন্তু অনেক দিন ওয়ার্কশপে পড়ে ছিল। সেই জন্য আমরা বলেছি, ডিসিসির পছন্দ না হলে আমরা নতুন নমুনা জমা দেব।' এত কম দামে সোডিয়াম বাতি সরবরাহ সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাল্বের ব্যবসা করে আসছি। আমরা অল্প লাভে বাতি সরবরাহ করতে পারব, অন্যরা তা পারবে না।'
ডিসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা মো. শাহেন রেজা বলেন, 'অনেক সময় একটা বাতি কিনলে যে দাম পড়ে, বেশি সংখ্যায় কিনলে দাম অনেক কমে যায়। যদি একটি বাতির দাম ৩০ ডলার হয়, সাত হাজার কিনলে সেটা ২০ ডলারেও নেমে আসতে পারে। আমি আপনাকে শুধু এটুকু নিশ্চিত করতে পারি, সোডিয়াম বাতি কেনা নিয়ে কোনো অনিয়ম হবে না।'
জানা গেছে, ডিসিসি আগে ফিলিপস ও সিমেন্স কম্পানির সোডিয়াম বাতি ব্যবহার করত। এসব বাতির প্রতিটির বর্তমান দাম চার হাজার টাকার বেশি। এগুলো দুই থেকে তিন বছর নির্বিঘ্নে ব্যবহার করা যায়। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এক বছরের গ্যারান্টিও দেওয়া হয়। ফলে এক বছরের মধ্যে নষ্ট হলে কম্পানি বাতি ফেরত নেয়। কিন্তু কিকো লিমিটেডের জমা দেওয়া নমুনা বাতিগুলোর কোনো গ্যারান্টি বা ওয়ারেন্টি নেই। কাজেই এ বাতি যে নিম্নমানের, তাতে সন্দেহ নেই।
বিদ্যুৎ বিভাগের আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'কিকো বাতি রাজপথে লাগালে আমাদের বিপদ বাড়বে। দেখা যাবে, ঘন ঘন অভিযোগ আসতে শুরু করেছে_এখানকার রাস্তার বাতি নষ্ট, ওখানকার রাস্তার বাতি নষ্ট। তখন পরিস্থিতি শামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে।'

No comments

Powered by Blogger.