পরিবারে টানাপড়েন-কে হবেন মেয়র প্রার্থী-স্ত্রী বুবলী, না ভাই কামরুজ্জামান by পারভেজ খান ও সুমন বর্মণ

রসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর কেটেছে মাত্র ২৩ দিন। এখনো শোকার্ত নরসিংদীর মানুষ। হত্যা মামলার প্রধান আসামি বা নেপথ্য নায়করা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এজাহারভুক্ত ১৪ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র একজন। আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। এ অবস্থায়ই শুরু হয়েছে আরেক নাটকীয়তা। আর সেটা খোদ লোকমানের পরিবারের মধ্যেই।


নিহত মেয়রের শূন্য পদে কে বসবেন, অর্থাৎ কে হতে চান নরসিংদী পৌরসভার আগামী মেয়র প্রার্থী, তাই নিয়ে লোকমানের পরিবারের মধ্যেই শুরু হয়েছে টানাপড়েন। নিহত লোকমানের স্ত্রী নুশরাত বুবলী ও ছোট ভাই কামরুজ্জামান_দুজনই চাচ্ছেন এই শূন্য পদে প্রার্থী হতে, যদিও তাঁরা সরাসরি সে কথা এখনো প্রকাশ করছেন না। এ ব্যাপারে গতকাল বুধবার সকালে মেয়র ভবনে কামরুজ্জামান প্রায় দেড় শ লোক নিয়ে একটি বৈঠকও করেছেন। অন্যদিকে মেয়রের স্ত্রীর ভাষ্য, নরসিংদীবাসী চাচ্ছে, তিনি মেয়র হয়ে তাঁর স্বামীর স্বপ্নগুলো পূরণ করবেন।
রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নরসিংদীর কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, লোকমানের রেখে যাওয়া আসনে কে বসবেন, সেটা সময়ই বলে দেবে। সরকার নির্বাচন দেবে, না প্রশাসক দিয়ে চালাবে_সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু লোকমানের ছোট ভাই কামরুজ্জামান ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছেন। লোকমানের মৃত্যুতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত শোকসভায়ও তিনি আকার-ইঙ্গিতে নিজেকে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে জানান দিচ্ছেন। অন্যদিকে মেয়রের স্ত্রী নুশরাত বুবলীও অনেকের কাছে তাঁর এ ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। তাঁরা আরো বলেন, ভবিষ্যতে মেয়র পদে নির্বাচন করবেন বলে যাঁরা এত দিন আশা ব্যক্ত করে এগোচ্ছিলেন, লোকমান হত্যা মামলার আসামি হয়ে তাঁদের সবাই এখন পলাতক। তাঁদের মধ্যে আছেন মোবারক হোসেন মোবা, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ মতিন সরকার, নুরুল ইসলাম ও তারেক আহমেদ। এ ছাড়া বিএনপির হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য সামসুদ্দিন আহমেদ এছহাকের ছেলে হারুন-অর-রশিদও মেয়র পদে নির্বাচন করতে পারেন।
লোকমানের পারিবারিক একটি সূত্র জানায়, কে হবেন আগামী মেয়র, সেটা নিয়ে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই ইতিমধ্যে কিছুটা বিরোধ দেখা দিয়েছে। বুবলী ও কামরুজ্জামান দুজনই প্রার্থী হতে চান। মামলার তদন্ত নিয়ে পুলিশের পেছনে ছোটাছুটির পাশাপাশি ইতিমধ্যে কামরুজ্জামান নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করে দিয়েছেন। চেষ্টা করছেন জনমত সংগ্রহের। বিভিন্ন শোকসভায় গিয়ে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। তবে বুবলী এখনো সেভাবে মাঠে নামতে পারেননি। তাঁকে কৌশলে ঘরেই আটকে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার অজুহাতে তাঁকে খুব একটা বাইরে বের হতে দেওয়া হয় না। কামরুজ্জামান কোথাও গেলে বাড়ির গেটে বাইরে থেকে তালা আটকে তিনি চাবি নিয়ে যান। ফলে বাইরের কেউ এসে বুবলীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন না।
এ প্রতিবেদক কথা বলার জন্য গত সোমবার লোকমানের বাসায় গিয়ে দেখতে পান, বাড়িটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। বুবলী বারান্দায় এসে ওপর থেকে জানালেন, কামরুজ্জামান চাবি নিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পর কামরুজ্জামান এলে এ প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলেন। কামরুজ্জামান বলেন, নিরাপত্তার কারণেই এ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময়ই সব বলে দেবে। তবে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাঁকেও হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তিনি বিশ্বস্ত সূত্র থেকে এ খবর জানতে পেরেছেন। যাঁরা আগামীতে মেয়র নির্বাচন করতে চান, তাঁরাই তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করছেন। আর এসব কারণেই এই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা।
কামরুজ্জামান সরাসরি না বললেও তাঁর কথায়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তিনি নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন। লোকমানের স্ত্রী নুশরাত বুবলীর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি বলেন, 'ভাবি এখন অসুস্থ। তাঁর মানসিক অবস্থাও ভালো নয়। এ মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে না।'
লোকমানের বাসা থেকে ফিরে এসে নুশরাত বুবলীকে টেলিফোন করলে তিনি বলেন, 'দুঃখিত ভাই, কামরুজ্জামান চাবি নিয়ে বাইরে যাওয়ায় আপনার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।'
অসুস্থ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ অবস্থায় কোনো স্ত্রীই সুস্থ থাকতে পারে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে তিনি কারো সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে পারবেন না। বুবলী বলেন, 'আমি অসুস্থ নই।'
গতকাল টেলিফোনে কথা হয় কামরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানান, বন্ধুবান্ধব ও বড় ভাই লোকমানের সহযোগী আর ঘনিষ্ঠ দলীয় কর্মীদের নিয়ে গতকাল তিনি তাঁর বাসায় বসেছিলেন ঘটনাপরবর্তী করণীয় নিয়ে। ওই বৈঠকে আগামী মেয়র নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। আর নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন কি না, সেটা সিদ্ধান্ত নেবেন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করার পর। এ ব্যাপারে পারিবারিকভাবে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে তিনি জানান।
কামরুজ্জামান এ কথা বললেও গতকালের বৈঠকে উপস্থিত স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগকর্মী বলেন, তাঁদের আলোচনার মূল বিষয়ই ছিল আগামী মেয়র নির্বাচন। কামরুজ্জামান এ নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তবে এখনই প্রচারণায় মাঠে নামলে বা এ ব্যাপারে মুখ খুললে সাধারণ মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না ভেবে তাঁরা ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে নরসিংদীর বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সমন্বয়ে তাঁরা একটি প্লাটফরম করবেন, যার প্রধান হবেন কামরুজ্জামান। এ প্লাটফরমে এলাকায় মানববন্ধন, শোকসভাসহ লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। তাঁরা নির্দিষ্ট করে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবেন না। পুলিশের তদন্তে যাদের জড়িত থাকার অভিযোগ আসবে, তাদেরই অভিযুক্ত হিসেবে মেনে নেওয়া হবে।
ওই আওয়ামী লীগকর্মী আরো জানান, ওই বৈঠকে কামরুজ্জামানকে মনে হয়েছে তিনি কিছুটা আপসের মনোভাবে চলে গেছেন। তাঁর নিজের নির্বাচন সামনে রেখে অভিযুক্ত ঘাতকদের আর সেভাবে ঘাঁটাতে চান না তিনি, যাতে করে তারা ছাড় পেয়ে নির্বাচনে কামরুজ্জামানের বিরোধিতা না করে। তবে বৈঠকে অনেকেই এ বিষয়টি সহজভাবে মেনে নেননি। বরং কামরুজ্জামানকে আরো গভীরভাবে ভাবতে বলেছেন। এতে করে নরসিংদীবাসীই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে এবং সেটা কামরুজ্জামানের বিপক্ষে চলে যেতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
আগামী নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে লোকমানের স্ত্রী নুশরাত বুবলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তবে হুমকি পেয়ে ঘরে বসে থাকার মেয়ে আমি নই। আমার স্বামী এই নরসিংদীর মানুষকে ভালোবেসে জীবন দিয়ে গেলেন। সেই ব্যক্তির স্ত্রী হয়ে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমি লোকমানের স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী ছিলাম। তার সেই রেখে যাওয়া স্বপ্ন পূরণ করতে আমি নরসিংদীর সাধারণ মানুষের পাশে ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।'
বুবলী আরো বলেন, কামরুজ্জামান নির্বাচন করবে, না তিনি করবেন সেটা বলার বা ভাবার সময় এখনো আসেনি। সান্ত্বনা দিতে এসে এলাকার অনেকেই তাঁকে আগামীতে মেয়র পদে নির্বাচন করতে বলছেন। আর তাঁর নিজেরও এতে আপত্তি নেই। তবে যে নরসিংদীর মানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়ে এসেছেন, যে নরসিংদীবাসীর জন্য তাঁর স্বামী জীবন দিলেন, সেই নরসিংদীর সাধারণ মানুষই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে পারিবারিকভাবেও এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। সেই সময় এখনো আসেনি। এখন তিনি চাচ্ছেন তাঁর স্বামীর ঘাতকদের গ্রেপ্তার। সময় বয়ে যাচ্ছে, অথচ আসল ঘাতকরা কেউই গ্রেপ্তার হচ্ছে না। এজাহারের ১৪ আসামির ১৩ জনই পলাতক। ধরা হচ্ছে চুনোপুঁটিদের। ভাড়াটে খুনিদের, যারা ওদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সবার আগে তিনি তাদের গ্রেপ্তার দাবি করেন।
বুবলী আরো বলেন, 'পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আমাকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করা হতে পারে। তবে আমি নিজে কারো কাছ থেকে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব পাইনি। সময়ই সব কিছু বলে দেবে। এখন আমি শুধু ভাবছি আমার অবুঝ দুই সন্তানের ভাগ্য কোন দিকে গড়াবে। ভাবছি, কবে আমার স্বামীর ঘাতকরা গ্রেপ্তার হবে। আর কেউ যদি নির্বাচনের দোহাই দিয়ে ঘাতকদের ছাড় দেওয়ার ইচ্ছা দেখিয়ে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা বা কৌশল অবলম্বন করে, তবে শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আমি তাদের ছাড় দেব না।' তিনি জোরালো ভাষায় আরো বলেন, 'লোকমানের রক্ত নিয়ে কাউকে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না আর নরসিংদীবাসীও তা হতে দেবে না।'

No comments

Powered by Blogger.