শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা-আপত্তি সত্ত্বেও ভিডিআইকে দায়িত্ব দিতে নির্দেশনা by আশরাফুল হক রাজীব

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদেরের আপত্তি উপেক্ষা করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব কানাডীয় কম্পানি ভিজ্যুয়াল ডিফেন্স ইনকরপোরেশনের (ভিডিআই) হাতেই তুলে দেওয়া হচ্ছে। গতকাল বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পেঁৗছেছে।


নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ ধরনের নির্দেশনা পেয়ে বিমানমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহারের জন্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী জি এম কাদের বলেন, 'এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।'
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আলী হোসেন অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির পক্ষ থেকে গতকাল
বিমান ও পর্যটনমন্ত্রীকে কানাডীয় কম্পানির প্রস্তাব অনুমোদনের কথা জানান। কমিটিতে প্রকল্পটি পিপিপির আওতায় বাস্তবায়নে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ভিডিআই কর্তৃক তাদের নিজস্ব অর্থায়নে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে একটি কম্প্রিহেনসিভ সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম স্থাপনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদনের কথাও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে চিঠি পাওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জি এম কাদের। এরপর তিনি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আতাহারুল ইসলামকে ভিডিআইয়ের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহারের লিখিত নির্দেশ দেন। সচিব বিদেশে অবস্থান করায় এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, ভিডিআইয়ের প্রস্তাবে অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠার পর বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সব সদস্যের কাছে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে প্রস্তাবটি পাস না করার অনুরোধ জানানো হয়। এরপর ভিডিআই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেয়। প্রস্তাব প্রত্যাহার-সংক্রান্ত চিঠিতে ভিডিআই বাংলাদেশি মিডিয়ার চরম সমালোচনা করে। ভিডিআইয়ের পক্ষ থেকে সর্বশেষ চিঠিতে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলার হুমকিও দেওয়া হয়।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে গত ২৭ অক্টোবর কানাডীয় কম্পানির দেওয়া প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে তোলা হয়। কম্পানিটি নিরাপত্তার জন্য ২৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। এর মাশুল তারা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায়ের পরিকল্পনা পেশ করে। কানাডীয় কম্পানিকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হলে বিমানবন্দর পার হতে প্রতি যাত্রীকে ৩৫ ডলার করে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এই ৩৫ ডলারের মধ্যে বাংলাদেশ পাবে মাত্র ১৫ ডলার। অবশিষ্ট ২০ ডলার নিয়ে যাবে ভিডিআই। নিরাপত্তার জন্য কম্পানিটি বিনিয়োগ করবে ২৮০ কোটি টাকা। এর বিনিময়ে তারা ২৫ বছর যাত্রীপ্রতি ২০ ডলার হাতিয়ে নেবে। সে হিসাবে প্রথম বছরেই তারা বিনিয়োগের টাকা তুলে অতিরিক্ত লাভ করবে ৬৫৪ কোটি টাকা। কারণ গত বছর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পার হয়ে বিদেশে গেছেন ৪১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৮৫ জন। এই হিসাবে প্রতিবছর টোল আদায় হবে প্রায় এক হাজার ৯৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ১৫ শতাংশ হিসেবে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা পাবে বাংলাদেশ। অবশিষ্ট ৯৩৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা যাবে ভিডিআইয়ের পকেটে। যেভাবে যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে, তাতে ভিডিআইয়ের আয়ের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
সরকারের ভেতর ছাড়াও বিমান ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের (অংশীদার) মধ্যে ভিডিআইয়ের প্রস্তাব নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব) বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রশ্নে একমত হলেও যাত্রীপ্রতি ৩৫ ডলার নিরাপত্তা অর্থ আদায়ের বিরোধিতা করেছে। আটাবের সভাপতি এম এ মোহাইমেন সালেহ বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানো দরকার। তবে নিরাপত্তা বাবদ যে টাকা আদায়ের কথা বলা হচ্ছে, তা অনেক বেশি। বিশ্বের কোথাও এত বেশি ফি নেই।
বেসামরিক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ পাক্ষিক মনিটর সম্পাদক কাজী ওয়াহেদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানো দরকার। এ জন্য ভিডিআইয়ের পুরো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রস্তাবে যাত্রীদের থেকে নিরাপত্তা অর্থ আদায়ের পরিমাণ বেশি হতে পারে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই হার কমানো উচিত।

No comments

Powered by Blogger.