চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আসছে পাটনীতি by ফারজানা লাবনী

পাটনীতি চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। ১৩টি ধারায় ৬৩টি উপধারা নিয়ে প্রণীত খসড়া নীতিমালা গত ১৯ অক্টোবর পাট মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠক পাঠানো হয়। তবে মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে আরো কিছু বিষয় সংযোজন-বিয়োজনের জন্য বলা হয়েছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন শেষে খসড়া নীতিমালাটি আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।


খসড়া পাটনীতিতে পাটজাত পণ্যকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। চাহিদার ভিত্তিতে বন্ধ পাটকল চালুর উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর নতুন নীতি বাস্তবায়নে পাটমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৩৬ সদস্যের 'জাতীয় পাট খাত সমন্বয় কমিটি' গঠন করা হবে।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাটনীতি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের পাট শিল্পে বিরাজমান অনেক সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব হবে।' সামগ্রিকভাবে উৎপাদনে গতিশীলতা আসবে বলেও মন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, 'পাটপণ্য বহুমুখীকরণে নতুনভাবে কাজ শুরু হবে পাটনীতি অনুসারে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে সরকারি-বেসরকারি পাটের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন করবে।'
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আশরাফুল মকবুল কালের কণ্ঠকে বলেন, গত মন্ত্রিসভার বৈঠকে খসড়া পাটনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ সময় ২০০২ সালের পাটনীতির সঙ্গে বর্তমান প্রণয়ন করা পাটনীতির পার্থক্য জানতে চাওয়া হয়। আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। সচিব আশা প্রকাশ করে বলেন, অতিসত্বর পাটনীতি চূড়ান্ত হবে। তিনি জানান, ২০০২ সালে ঘোষিত পাটনীতি আধুনিক ও যুগোপযোগী করে বর্তমান পাটনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পাটের কদর এখন বিশ্বব্যাপী। চাহিদা রয়েছে নানা ডিজাইনের আধুনিক ও যুগোপযোগী পাটপণ্যের। বাংলাদেশে পাটের গুণগত মান ভালো হলেও তা এখন বাজার হারাতে চলেছে। পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে পাটের বস্তা বা ব্যাগ, যা এখন আন্তর্জাতিক বাজারে অচল। আশরাফুল মকবুল সাফ জানান, 'শুধু কাঁচা পাট রপ্তানি করে টিকে থাকা যাবে না। নতুন প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করতে যাচ্ছে পাটনীতি ২০১১।'
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নীতি বাস্তবায়নে থাকছে পাটমন্ত্রীর সভাপতিত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ৩৬ সদস্যের 'জাতীয় পাট খাত সমন্বয় কমিটি' কমিটি। প্রতি তিন মাস পর পর সভা করে পাট খাতের সমগ্র পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে কমিটি। এ বিষয়ে পাটনীতিতে সুস্পষ্ট ধারা থাকছে।
পাটনীতিতে যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন, উন্নত বীজের ব্যবহার, দেশে-বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ, কৃষকপর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়েও থাকছে সুনির্দিষ্ট ধারা। পাটনীতিতে এ খাতের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সেসব সমাধানে নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে, সনাতন পদ্ধতিতে পাট চাষ, উচ্চ ফলনশীল ও মানসম্পন্ন বীজের অভাব, পাট চাষে প্রযুক্তির ব্যবহারে জ্ঞানের অভাব, পাট পচনে এলাকা বিশেষে উপযুক্ত পানির অভাব, ন্যায্য মূল্যে সার ও কীটনাশক সরবরাহের অপ্রতুলতা, পাট মৌসুমে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব, চাষিপর্যায়ে তথ্যের অভাব, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পাট ক্রয়ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং পাট ব্যবসায়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। এ ছাড়া আরো যেসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে আছে, চাষিরা পাটের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন, কৃষকপর্যায়ে পাট গুদামজাতকরণের সুযোগ খুবই সীমিত। পাটনীতিতে দক্ষ জনবলের অভাবকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ ছাড়া পাটকলগুলোর অব্যাহত লোকসান ও দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ঋণ ও ঋণের ওপর সুদের বোঝা, বিরাষ্ট্রীয়কৃত পাটকলগুলো থেকে পাওনা অর্থ অপরিশোধিত থাকা, সহজশর্তে ঋণের অভাব, প্রচলিত ও বহুমুখী পাটপণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে বাধা, রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতাজনিত সমস্যার সমাধানেও থাকছে পদক্ষেপ।
জানা গেছে, পাট খাতে বিরাজমান সমস্যার সমাধানে খসড়া পাট নীতিতে ৫৮টি উপধারা আছে। খসড়া পাটনীতিতে আমদানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক দেশের সিড সার্টিফিকেশন এজেন্সি কর্তৃক প্রত্যায়িত বীজ আমদানি নিশ্চিত করার বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। খসড়া পাটনীতিতে পাটজাত পণ্যকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে।
খসড়া নীতির দুই নম্বর ধারার ১১ উপধারায় সরকারি ও বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য পাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। তিন ধারার পাঁচ উপধারায় বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ ধারার দুই উপধারায় রয়েছে সরকারি মিলের যন্ত্রপাতি সুষমকরণ, আধুনিকীকরণ ও প্রতিস্থাপনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের কথা। ছয় ধারায় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান বন্ধ পাটকলগুলো চালু ও সামগ্রিকভাবে পাট শিল্পে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হয়েছে।
খসড়া পাটনীতিতে প্রশিক্ষণ ও গবেষণার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারকে (জেডিপিসি) একটি পূর্ণাঙ্গ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। 'ওয়ান স্টপ' সার্ভিস পদ্ধতি চালু করা হবে বলে পাটনীতিতে উল্লেখ আছে।

No comments

Powered by Blogger.