নীরব বিদায়

শোয়েব আখতার যদি হতেন কোনো উপন্যাসের চরিত্র, শেষটা পড়ে চোখ জলে ভিজত। যদি হতেন সেলুলয়েডের ভ্যাগাবন্ড নায়ক, সেখানেও শেষ দৃশ্যে মিশে থাকত সহানুভূতি। শোয়েব এর কোনোটিই না হয়ে হলেন ক্রিকেটার, আবেগময় চরিত্র যেখানে বড়জোর করুণা পেতে পারে। ক্রিকেটে আবেগের স্থান মাঠ, স্কোর বোর্ড এমনকি ড্রেসিংরুমেরও বাইরে।
শোয়েব আখতার ক্রিকেটের নায়ক না খলনায়ক, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তাঁর ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এতই বর্ণময় যে সেখান থেকে খারাপটুকু বাদ দিয়ে ভালোটুকু তুলে আনা কঠিন। আবার শুধু খারাপটুকু তুলে এনে ভালোটুকুও ফেলে রাখা যায় না। শোয়েব ছিলেন পিন্ডি এক্সপ্রেস। তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি। বোলিং প্রান্তে তাঁকে দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যেতেন অনেক ব্যাটসম্যান। বল হাতে টগবগিয়ে ছুটে আসছেন...আগুনের গোলায় উড়িয়ে দিলেন স্টাম্প...পাখার মতো দুহাত প্রসারিত করে আকাশে ওড়ার ভঙ্গিতে উদ্যাপন—সোনালি দিনের শোয়েব যেন পাকিস্তান ক্রিকেটেরই ট্রেডমার্ক!
শেষবেলায় সেই শোয়েবই কত না অপাঙেক্তয়! ঝাঁকড়া চুল কমতে কমতে উঁকি দেয় উদীয়মান টাক। উইকেট পেলে পাখির মতো ওড়ার উদ্যাপন শেষ দিকে কমে এসেছিল। উড়তে দম লাগে। লম্বা রানআপ, তারপর আগের সেই বিধ্বংসী অ্যাকশনের খোলসে নির্বিষ ডেলিভারি—উড়বেন কী, শোয়েবের সব শক্তি তো ওখানেই শেষ! মাত্র ৩৫-এ গতিহীন পিন্ডি এক্সপ্রেস। মফস্বল শহরের রেলস্টেশনে অবহেলায় ফেলে রাখা জং ধরা একটা কম্পার্টমেন্ট যেন!
শোয়েবের পতন হঠাৎ করে নয়। একটু একটু করে নিজেকে শেষ করে দিয়ে নিজেই হয়ে গেছেন ‘ক্রিকেটের ব্যাডবয়’। বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ থেকে শুরু করে মাদক কেলেঙ্কারি, সতীর্থকে পেটানো, সর্বশেষ বিশ্বকাপের নিউজিল্যান্ড ম্যাচে দুবার রস টেলরের ক্যাচ ফেলায় উইকেটকিপার কামরান আকমলকে লক্ষ্য করে শূন্যে লাথি—নিজেকে আর শোধরাতে পারলেন না। এবার বিশ্বকাপেও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সবচেয়ে বেশি জরিমানা গোনা খেলোয়াড়টি তিনি। শৃঙ্খলা ভাঙ্গার কারনেই বিশ্বকাপের শেষ দিকে দলে একা হয়ে পড়েছিলেন। বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনিও বেজে উঠল। বিশ্বকাপ চলার মাঝপথেই শোয়েব জানালেন, এই বিশ্বকাপের পরই তাঁর শেষ।
বিশ্বকাপের পর পর্যন্ত যেতে হয়নি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাল্লেকেলের ম্যাচটাই হয়ে গেল তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সাবেক ক্রিকেটারেরা জনমত গড়ে তুলেও বিশ্বকাপে আর কোনো ম্যাচ খেলাতে পারেননি শোয়েবকে। আর শেষ টেস্ট তো খেলে ফেলেছিলেন ২০০৭ সালের ডিসেম্বরেই, ভারতের বিপক্ষে বেঙ্গালুরুতে। ৪৬ টেস্টে ১৭৮ আর ১৬৩ ওয়ানডেতে ২৪৭ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করা আর যা-ই হোক, শুরুর সম্ভাবনার সঙ্গে মেলে না।
১৪ বছর আগে শোয়েবও নিশ্চয়ই ভাবেননি ক্যারিয়ারের শেষ দৃশ্যে ট্র্যাজেডির নায়ক হবেন, আগমনধ্বনি সারা বিশ্ব শুনলেও বিদায়টা হবে নীরবে। ১৯৯৭ সালে নিজ শহর রাওয়ালপিন্ডিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। কত না সম্ভাবনা, কত না রোমাঞ্চে ভরা ছিল সেই দিনগুলো! শোয়েবের আজও মনে পড়ে, ‘টেস্ট খেলার পোশাকটা যে দিন প্রথম পেলাম...আমার বুকে বিশাল একটা তারকাচিহ্ন, কখনো ভোলার নয় মূহূর্তটা। ওই পোশাক পরেই ঘুমাতে গেলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না, যখন ঘুম থেকে উঠব তখনো আমার গায়ে ওই পোশাকটাই থাকবে। তিন দিন ধরে একই পোশাক পরে ছিলাম।’
পাকিস্তানের জলপাই রঙের পোশাক আর কখনোই উঠবে না শোয়েবের গায়ে। বড়জোর মূল্যবান স্মৃতিস্মারক হতে পারে সেগুলো। কিন্তু পিন্ডি এক্সপ্রেসের বর্ণময় ক্যারিয়ার বিবর্ণ এই জার্সিগুলো ঠিক কতটা ধরে রাখতে পারবে? অবসর ঘোষণার সময় শোয়েব কিন্তু মেনেই নিয়েছেন, তাঁর একটা জনম শেষ হয়ে গেল এখানেই, ‘যেন আমার প্রথম মৃত্যু হলো আজ।’
শোয়েব বলেই প্রশ্নটা আসছে—মৃত্যু, নাকি ‘স্লো পয়জনিং’য়ে আত্মহত্যা!

No comments

Powered by Blogger.