রাত পোহালেই ফাইনাল

ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড। ক্ষণগণনা চলছে, যা শেষ হবে আগামীকাল শনিবার বাংলাদেশ সময় বেলা তিনটায়। ঠিক তখনই মঞ্চে দুই দল। ভারত-শ্রীলঙ্কা। শুরু হবে দ্বিতীয়বার বিশ্ব-শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় তোলার শেষ লড়াই। ক্রিকেট-বিশ্বকে মোহাবিষ্ট করার জন্য এর চেয়ে বড় উপলক্ষ আর কী হতে পারে!
প্রস্তুত মুম্বাই। শচীন টেন্ডুলকারের শহর ছাপিয়ে যার পরিচয় এখন বিশ্ব ক্রিকেটের সাময়িক রাজধানীর। সব পথ এসে মিলছে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। শ্রীলঙ্কা পরশু পৌঁছাল বলিউডের শহরে। ভারতীয় দল কাল। মঞ্চের দুই চরিত্রকে পেয়ে মুম্বাইও যেন বদলে গেছে। তার পরও ভারতের রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিল্পীসমাজের আগমন তো আছেই। কালকের ফাইনাল দেখার জন্য সবাই এখন মুম্বাইমুখী।
মুম্বাইয়ের অবস্থা এখন কী—সেটি বোধ হয় আর বলার দরকার নেই। ফাইনালের ৪৮ ঘণ্টা আগে ওয়াংখেড়ে দাঁড়িয়েই উত্তরসূরিদের প্রেরণা দিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক কথা বলছেন মুত্তিয়া মুরালিধরনের সঙ্গে। ১৬ বছর আগে শ্রীলঙ্কার সেই বিজয়ের আরেক সেনানী ছিলেন মুরালি নিজেও। কাল এই মাঠ থেকেই ক্রিকেটকে যখন মুরালি বিদায় জানাবেন, শ্রীলঙ্কানদের তো বটেই, আবেগ ছুঁয়ে যাবে সবাইকে। বিশ্বকাপের ফাইনালে শুধু রোমাঞ্চই থাকছে না। আবেগের স্রোতও ভেসে আসছে থেকে থেকে।
একটা ব্যাপার বেশ চমকপ্রদ। এবার বিশ্বকাপটা শেষমেশ যেন এশিয়া কাপেরই সংস্করণ! ঠিক যেন এশিয়া কাপের ফাইনাল হচ্ছে! ভারত-শ্রীলঙ্কার দুই দলই এশিয়ার প্রতিনিধি। বিশ্বকাপটা এশিয়ায় হচ্ছে—তখনই যেন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার বদলে এবার ছড়ি ঘোরাবে এশিয়ার দলগুলোই। হলোও তা-ই। সেমিফাইনালে চার দলের তিনটিই এশিয়ার। নিউজিল্যান্ডের আরেকটি চৌকাঠ থেকে বিদায় নিশ্চিত করে দিল, ফাইনালটিও হবে অল এশিয়ান। আর এটাও তো নিশ্চিত, দেড় দশক পর শিরোপা থাকছে এশিয়াতেই।
এশিয়ার দেশগুলোর দাপট এবার এমনই ছিল যে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ফেবারিটেরও সেমিফাইনালের চৌকাঠে পা রাখার আগেই ধরেছে দেশের বিমান। বাংলাদেশকে বাদ দিলে এশিয়ার বাকি তিন দল ছিল স্বমহিমায়। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ কাদের গলায় বিজয়মালা পরায়, তার জন্য অপেক্ষাটা থাকুক।
তবে উৎসব শুরুর জন্য তো আর কেউ সময়-ঘণ্টা বেঁধে দেয় না। সেই উৎসব শুরু হয়ে গেছে। কান পেতে শুনুন, বিজয়ের ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে মুম্বাই, মোহালি, আহমেদাবাদ, কলকাতা থেকে...আসছে কলম্বো, ক্যান্ডি থেকেও।
নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানকে ভারত—দুটি সেমিফাইনালে নিজ নিজ দলের জয় দেশে দুই দেশের সমর্থকেরা রাস্তায় আতশবাজি পুড়িয়েছেন, রঙের উৎসবও চলেছে। সেই উৎসব চলবে কাল পুরো ম্যাচে। শেষ পর্যন্ত এক দলের উৎসব থেমে যাবে। অন্য দলের উৎসব চলতে থাকবে আরও কিছুদিন। সেই উৎসব অলক্ষে শামিল অন্যতম স্বাগতিক বাংলাদেশও। বাংলাদেশের ঘরে ঘরেও তো একটাই আলোচনা—বিশ্বকাপ। এখানেও চলছে অধীর অপেক্ষা।
তবে ব্যক্তি হিসেবে অপেক্ষাটা একজনের সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। নিজের শহরে বিশ্বকাপ হাতে তুলতে পারলে ক্যারিয়ারে আর কোনো অতৃপ্তি থাকবে না। একে তো ফাইনাল, তার ওপর এই ম্যাচে টেন্ডুলকার তাঁর শততম সেঞ্চুরি পেলে একেবারে সোনায় সোহাগা। এই ফাইনাল তাই শুধু শুধুই একটা ফাইনাল নয়। তার চেয়েও বেশি কিছু!
হ্যাঁ, তার চেয়ে বেশি। কিন্তু দুই দল অত কিছু ভাবতে রাজি নয়। পেশাদার দল হিসেবে নিজেদের মিশন শেষ করার আগেই উচ্ছ্বাসে গা ভাসাচ্ছে না। পরশু পাকিস্তানের বিপক্ষে মহাযুদ্ধ জেতার পরও ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি একেবারেই আবেগ প্রশ্রয় দেননি। এখনো যে শিরোপা জেতা বাকি রয়ে গেছে!
‘আমাদের চারপাশে অনেক কিছু ঘটছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের মনোযোগ যাতে সরে না যায়। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্বটা ভালোভাবে জানি। এবং সেদিকেই আমাদের মনোযোগ রাখতে হবে’—বলেছেন ধোনি।
সতীর্থদের যতই পেশাদারের শেকলে আবেগ বেঁধে রাখতে বলুন, সাধারণ্যের বয়েই গেছে তা মানতে। সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে হারানোর পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এতই উচ্ছ্বসিত যে, ওতেই তাদের বিশ্বকাপ জেতা হয়ে গেছে বলে কোনো কোনো কাগজেও লেখা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা অতটা উচ্ছ্বাসে হয়তো এখনো মাতেনি। ভারতকে ভারতের মাঠে হারিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তোলার মাহেন্দ্রক্ষণই অপেক্ষায় রেখেছে সে দেশের সংবাদমাধ্যমকে। কিন্তু আমজনতার তর আসলে আর সইছে না। বিশেষ করে উপমহাদেশের। শ্রীলঙ্কাকে সে অর্থে উপমহাদেশের অংশ বলা যায় না। তবে চেন্নাই থেকে পক প্রণালি পেরোলেই শ্রীলঙ্কা। সেদিক থেকে দ্বীপরাষ্ট্রটি উপমহাদেশের অংশও বটে।
যে যেভাবেই দেখুন, রাত পোহালেই ক্রিকেট-বিশ্ব গাইবে একটাই গান—‘জয় হোক বিশ্বকাপ ক্রিকেটের!’

No comments

Powered by Blogger.