গল্প- তেঁতুল by সালাহ উদ্দিন শুভ্র

মায়ের ছবিটার ওপর একটা টিকটিকি চার পায়ে আর লেজে অবোধ্য কৌশলে ধীর হয়ে আছে। তার মুখের কিছু সামনেই রং আর অবয়ব ধরা যায় না এমন একটা পোকা। টিকটিকির চোয়ালে যার জীবনের শেষ পরিণতি। অথচ এই মুহূর্তে পোকাটা তা বুঝতে পারছে না। সেই পোকা তখন তার জীবনের কোনো ক্ষণ নিয়ে হয়তো ব্যস্ত।
পোকা গিলেই টিকটিকিটা সরে যায়। ভেসে ওঠে মায়ের হাসিটা। কি এক জীবন বোধের হাসি। যেন টলটলে জলাশয়, তাতে অসংখ্য শাদা হাঁসের সন্তরণ। মায়ের হাসির শব্দেও যেন ওই খলবলে আওয়াজটা পাওয়া যেত। হাসিরেণুরা ছিটিয়ে পড়তো চারপাশে। হাসির দুপাশে ভোরের ঘষা আকাশ, তাতে রাতের ক্লান্তি অথবা বিষণ্নতা। কপালের টিপটা যেন দিগন্তে জেগে ওঠা ভোরের সেই শিশু সূর্য_কতো কমনীয়তা আর কতো তেজ তার ভেতরে ভরা। মা কখনোই তেজ প্রকাশ করেননি। আলো ছড়িয়েছেন শুধু। এই পৃথিবীটাই তার কাছে ভালোবাসার জন্য। পৃথিবীটা যেন তার আঁচলস্পর্শী। ভালোবাসতেন তিনি সবকিছুই। ঘরের একটা শুকনো কি ভেজা তেনা থেকে শুরু করে তার সন্তানদের, তার জীবনসঙ্গীকে। মায়ের অাঁচলের ছোঁয়ায় সব কিছুই সন্তান হয়ে উঠতে পারতো তবে। মায়ের ঠিকই মনে পড়তো গ্রামের কোন খালা কি কোন বুয়াকে। সময় পেলেই তাদের গল্প করতেন। গ্রামে চলে যেতেন তাদের সঙ্গ পাবার আশায়। খোঁয়াড়ে তার ছোটবেলায় পালা মুরগি আর বাচ্চাগুলোকে ভুলতে পারেননি মা। বাল্যের সখিদের সাথে বেতুইন অমলকি খাওয়ার স্বাদ তার জিহ্বায় কি শেষ পর্যন্ত জেগে ছিল। মায়ের মৃতু্য তবে অনেক কষ্টের ছিল, ভাবে সে। মৃতু্য শয্যায় মায়ের মুখ থেকে একে একে কতো মুখচ্ছবি, গন্ধ, দৃশ্য, চিত্র ঝুপ ঝুপ করে বাতির মতো নিভে গেছে নিশ্চয়ই। মাকে নিয়ে গেছে এক নিঃসীম অন্ধকারে। সেই অন্ধকারে যাওয়ার আগে মায়ের মুখে কী যেন আকুতি ফুটে উঠেছিল। কিসের আকুতি। নিজের সন্তানকে ছেড়ে যাচ্ছেন বলে। নাকি সালেহা খালাকে পরের ঈদে একটা শাড়ি দেয়ার কথা ভেবেছিলেন, শেষ মুহূর্তে তা-ই মনে পড়ে গিয়েছিল মায়ের। হয়তো সদ্য বাড়িতে রুয়ে আসা তিতাকরলা গাছটায় যেন নিয়মিত পানি দেয় জমিলা বুয়া, পেঁচিয়ে বেড়ে ওঠার জন্যে যেন একটা কাঠি দেয় তার গোড়ায়, তা-ই বলে যেতে চেয়েছেন। কে জানে, মৃতু্যক্ষণে নিরাবলম্বন মা হয়তো ওই কচি করলা গাছেই বেঁচে উঠতে চেয়েছিলেন, কিংবা বেঁচে ফিরতে অাঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন কিছু একটা। সেই কিছু একটা হয়তো তিতাকরলা গাছের গোড়ায় পোঁতা কাঠির মতোই কিছু একটা। তার সব সময়ই মনে হয় মায়ের মৃতু্যটা খুবই কষ্টের ছিল। বাবার মৃতু্যও কি কষ্টের ছিল। বাবা একেবারেই পুরুষ ছিলেন। সংসারের হাল বেয়ে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। কতো ঢেউ, কতো ঝড় দাঁতে কেটেছেন। রক্তক্ষরণের বেদনা বাবার ছিল। তাই চাইতেন সন্তান যেন সুখে থাকতে পারে, পুরুষ হয়। বাবা গ্রামে যেতেন। কারণ সেখানে সহজেই পুরুষ হওয়া যেত। শহুরে পোশাক ছেড়ে সেই পুরুষ, হাল বাওয়া বন্ধুর সাথে জমিয়ে গল্প বলতেন। আবার শহরে ফিরে এলে বাবাকে পুরুষ সাজতেই হত, উপায় নেই। পুরুষ ছাড়া শহরে কে পারে দৌড়াতে। বাবার দৌড়ও একদিন শেষ হয়ে এলো। চলমান রাস্তার শেষে দাড়ি হয়ে উঠলো তার নিশ্চল শরীর আর বিছানা। সেই বিছানায় শুয়ে বাবা নিশ্চয়ই তাকিয়েছেন পথের দিকে। কি ভেবেছেন তিনি, জীবনে কখনো জারুল কৃষ্ণচূড়া দেখা হয়নি, সময় হয়নি মজা করে বৃষ্টিতে ভেজার। পুকুরের জল উথাল পাথাল হয়ে উঠতো যার পাখার ঝাপটানিতে, সে বাবাই ক্রমশ নিথর-নিস্তরঙ্গ চাদরে শয়ান। শেষদিকে কেমন কুঁকড়ে গিয়েছিল তার পুরুষ বাবা। মায়ের পাশে সেই ছবিটা দেখে কখনো কেউ ভাবতেই পারবে না এই দৃশ্য।
ভাত খেতে খেতেই মা-বাবার ছবির দিকে চোখ চলে যায় তার। ছবি বরাবর নিচে চেয়ারে বসা তার বউ। একেবারে গৃহলী। সংসারের প্রতি তার বিশ্বাস, ভালোবাসা অমূল্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোথায় যেন তার বউটা মা হয়ে ওঠেনি। সেই গন্ধটা নেই। অাঁচল থাকলেও তার পরিপাট্যই প্রধান। একমাত্র কাজের মেয়েটার প্রতি তার ভালোবাসার কমতি নেই। কিন্তু এটুকুই। খালি হাতে বা গোমড়া মুখে কেউ বাসা থেকে যায় না। উচ্চশিতি তার বউয়ের পৃথিবীতে মানুষ কম। গ্রাম নেই-খালাবুয়া নেই-জলপাই-বেতুন নেই। মাটি নেই, কাদা নেই। বুকে ঘামের গন্ধ নেই। এটা সে বেশ বুঝতে পারে। তার বউ ঘর থেকে বেরিয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু তার সাথে সাথে সে উন্মূল হয়েছে-বাস্তুহারা হয়েছে, আগাছা হয়ে সে বেড়ে উঠছে এই শহরে। তার বউ কিছুতেই যেন আর মা হয়ে উঠতে পারছে না। নাকি সে ভুল ভাবছে। তার বউ বসন্ত-বর্ষা এসব ভালোবাসে। কিন্তু তারতো ঝড়জলে আম কুড়ানো হয়নি কখনোই। পুকুর দাপানো দুপুর তার জীবনে আসেনি। আরেকটা সন্তান তো তার জন্যে নেই যে সবুজ পাতায়-শাখা প্রশাখায়-কচি ডাল আর পুষ্পে বিকশিত হয়। কোথাওতো এতটুকু মাটি তার জন্যে নেই যে জায়গাটা সে মমতায় ছোপাতে পারে। তার জন্যে, তার জন্যে শুধু ইটবালিসিমেন্ট।
: কাল কিন্তু বাবুকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
: বাইরে কোথায় নিয়ে যেতে চাও।
: তুমিতো ওই এক শিশু পার্কই চিনো। কাল চলো আশপাশে কোন গ্রামে যাই। যেখানে কেউ আমাদের চেনে না।
: কিভাবে যাবা।
: কেনো কোন বাসে চেপে।
: তুমি কখনো লোকাল বাসে চড়েছো।
: না, তবে দেখেছি আর দুয়েকবার যে চড়িনি তাতো নয়।
: হঁ্যা, দুয়েকবারতো চড়বাই। কাল চড়তে চাইতেছো কেন।
: আমাদের বাচ্চাটাকে এসব শেখানো দরকার না। দেখানো দরকার এসব। আমারও মনে হয়, আলাদা রকম একটা ছুটি কাটাতে।
: নিজেই দেখো নাই তো বাচ্চারে কি দেখাবা। তাছাড়া জায়গা ঠিক না করে আন্দাজে কই যাবো। তোমার জানাশোনার মধ্যে কোনো জায়গা আছে।
: না। আমি আসলে ভাবছিলাম বাচ্চাটার কথা। তুমিইতো বলো, আমিও চাই। তোমার ভরসাতেইতো আমি বাচ্চাকে এসব শেখাতে চাই।
: চাও, কিন্তু হয় না। কতো ভেবেছি, ওকে গ্রামে নিয়ে পড়াবো। অন্তত ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। কই হলো।
: হয়নি। হওয়া সম্ভব না।
: তুমি কি তোমার গ্রামের লোকজনকে চেনো। বলতে পারবে তোমাদের গ্রামে খেটে খায়, অন্যের বাড়িতে কাজ করে খায় এমন কারুর নাম। তাদের কোনো গল্প।
: না। আমি কি আর গ্রামে ছিলাম বলো। কিভাবে পারবো।
ভাত খেতে খেতে বউয়ের সাথে এই কথোপকথনে কোন কিছু তৈরি হয় না কেবল ভাত খাওয়ার ইচ্ছেটা মরে যাওয়া ব্যতীত। খাওয়া থেকে উঠে বউয়ের সাথে গোছানোর কাজ করে। সেই ফাঁকে চুলায় চায়ের পানি চাপায়। ভাবতে থাকে তার মায়েরই কথা। মা বলতেন_
: বুচ্ছস তেঁতুল অইতাছে শয়তাইন্যা ফল-দেখলেই লালচ লাগে-লালা গড়ায়া পড়ে। এই খায়া কি অয় ক, পেট ভরে না শইল্যে শক্তি অয়। তেঁতুল কয়-দেহো মানুষ তোমার মইদ্যে অহনও লালচ আছে-লোভ আছে। সামলায়া চলো।
তার বউ কি এই তেঁতুল মাহাত্ম্য জানে। কি করে শেখাবে তার সন্তানকে তেঁতুল থেকে সংযমের শিক্ষা। মনে আছে যখন তারা শহরে উঠে আসে গ্রাম থেকে। মা কোন কিছুই ফেলে আসেননি। ব্যাগে ভরে সবই নিয়ে এসেছিলেন। ফুল গাছ, মরিচ গাছ, ম্যাচ_সব। অথচ এই মা কতোবার টাকা অলংকার হারিয়েছেন। ভাবতে ভাবতে তার সামনে চুলার অাঁচে স্বচ্ছ চায়ের পানির নিচে বুদ্বুদ ওঠে। আবার মিলায়ে যায়। এই দৃশ্য কেন যেন তার চোখে লেগে থাকে। চা-সিগারেট-ঘুমানোর প্রস্তুতি। দৃশ্যটা চোখ থেকে মোছেই না। রাতের ঘন অন্ধকারে বুঝতে পারে কোন অর্থ সে তালাশ করে চলেছে এই দৃশ্যের। এই যে মায়ের মৃতু্য, তার বউ, সন্তান, মান-অভিমান-আলাপ-স্বপ্ন। সমস্তই মহাকালের একেকটি বুদ্বুদ। মিলায়, আবার তৈরি হয়, আবার মিলায়। তাপ বাড়তে থাকে। বাষ্প হয়ে পানি উবে যায়। রাতে ঘুমের স্বপ্নে সে গোসল করে এক পুকুরে, যেখানে পানি নেই। শুদু কাদা। সে ভুসভুসে কাদায় ডুব দেয়। লেপ্টে থাকা কাদা গায়েই গোসলের আমেজ নিয়ে উঠে আসে_তার লুঙ্গি গামছায় লেগে থাকে কাদা। সকালে আয়নায় নিজের মুখে বারবারই কাদা দেখে। পেষ্টের ঝাঁঝ গলায় চলে এলে একটি ঘটনা তার মনে পড়ে। তার বোনের শ্বশুর বাড়ির পাশেই এক লোককে তার দলের অন্যরা শাস্তিস্বরূপ ক্ষেতের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে লোদকাদা খাইয়েছিল। বোন সেই লোকের গোঙানি শুনেছে। নাহ, ছুটির দিনটা তার ভালো যাবে না। কী সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বউ বাচ্চাসহ নাস্তার টেবিলে বসে রুটি খেতে খেতে তার মনে হয় ওই কাদা মলা রুটিই সে খাচ্ছে। গলায় যেন বালি বালি পানসে কাদার স্বাদ, দলা পাকানো, গিলতে ভীষণ কষ্ট। ভাজা ডিম দিয়ে সে যা খাচ্ছে, কি বিস্ময়, তা কাদারুটি।
নাস্তা শেষে পত্রিকাটা হাতে নেয়। পত্রিকায় তার আগ্রহ কম, অভ্যস্ততার বশে পড়ে। তাও কোনো রাজনৈতিক খবর না, আশপাশের খবর। রাজনীতির ফলাফলটাই সে পড়ে থাকে। আজো ভেতরের পাতার খবর পড়ছিল। সেখানেই সংবাদটা দেখতে পায়। স্বাভাবিক, কিন্তু এই সকালের জন্যে খবরটা বিভ্রান্তিকর। যখন সে তার বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে তখন এই খবর দ্বিধা তৈরি করে বৈকি। সংবাদটা সে পড়ে না, শিরোনামেই চোখ আটকে থাকে দীর্ঘক্ষণ। বুঝে উঠতে পারে না কাল রাতের স্বপ্নের রেশ এখনো তার চোখে রয়ে গেছে কি-না। শিরোনামের কালো অক্ষরগুলো সে আসলে বাস্তবেই দেখে, স্বপ্নে নয়। একটা মেয়ে অভিমানে গলায় ফাঁসি দিয়েছে। এমন খবর তো নতুন নয়। তবু সে বিচলিত হয়। বের হওয়ার সিদ্ধান্ত বাদ দিতে চায়। পত্রিকা রেখে একটা সিগারেট ধরায়। ভুলে থাকতে চায় খবরটা। সিগারেটের ধোঁয়ায় মনোনিবেশ করে। সেই উধর্্বমুখী ধোঁয়া ছাদে মিলায়_ছাদে নীরব সিলিং ফ্যান। সেদিকে তাকিয়ে অন্য কিছু ভাববার চেষ্টা করে। তার মায়ের কথা, বাবার কথা। তার অন্য শহরে থাকা একমাত্র বোনটার কথা। সেই বোন কেমন আছে খুব ভালো করেই জানা তার। তবুও সে বৃথাই ভাবার চেষ্টা করে। বোন সংক্রান্ত চিন্তা, অথবা আর কোন চিন্তাই মাথায় দখল নিতে পারে না। বরঞ্চ তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়াগুলো ছাদের সিলিং ফ্যানে গিয়ে ফন্দি অাঁটে। হাত-পা সমেত মনুষ্য শরীরে গঠিত হতে থাকে। এরপর মেয়েটির অবয়বে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলতে থাকে। চমকে ওঠে সে। চিন্তাটা ভুলে যেতে তৈরি হয় বাইরে যাওয়ার জন্য। মোজা, শার্ট, বেল্ট পরতে পরতে সেই চিন্তা তার নাসারন্ধ্রে, হাতের তেলোয় জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঈদে জামা পায়নি বলেই আত্মহত্যা করেছে মেয়েটি। অস্থির হয়ে নিজের সন্তানের কাছে যায়। তাকে তৈরি করতে থাকে। আসলে এটাও একটা ভুলে থাকবার উছিলা। মরা মেয়েটাকে ভুলতে সে বেঁচে থাকাটাকেই অবলম্বন করতে চায়। নিজের হাতে নিজের সন্তানকে সাজানোর আনন্দ পেতে চায়। কিন্তু তার বাচ্চার চোখের দিকে তাকায় না, নিচু হয়ে থাকে। সে নিশ্চিতভাবেই জানে বাচ্চাটার চোখে সেই মেয়েটার হাসিমুখ ভাসে। অস্থির হয়ে ওঠে সে, দ্রুত বাসা থেকে বের হয় ট্যাক্সিক্যাব ডাকবে বলে।
শহরের আসা-যাওয়ার পথে শেষ বসন্তের বাতাস গলিয়ে তাদের গাড়ি এগিয়ে যায়। হা বসন্ত। শিমুল নাই পলাশ নাই খালি ধুলোমলিনতা। পুরো শহরেই ধুলোর ময়লা শাদা আস্তরণ। যেন শহরের গায়ে গায়ে বুনন চলছে মৃতের বসনের, ধীরে ধীরে। একদিন শহরটা ঢেকে যাবে শবের কাফনে। অসমাপ্ত বুননের নিচে সেই আয়োজনের বিরাম নেই। দেশ-শহর জুড়ে রক্ত বারুদ আগুন আর রোদে ঝিলিক দেয়া অস্ত্রের আঘাতে মানব মৃতু্যর মচ্ছব চলছে। সেই কাফন গায়ে জড়ানোর অপেক্ষাতেই আছে বোধহয় সভ্যতা। গাড়ির জানালায় বাতাস কাটা পড়ে; কিছু তার চুল এলোমেলো করে দেয়। বাকিটা চলে যায় ফেলে আসা পথে। বউ তার গান ধরে_
আসা যাওয়ার পথের ধারে
কেটেছে দিন
গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন
যাবার বেলায় দেবো কারে
যাবার বেলায়
দেবো কাছে বুকের কাছে বাজলো যে বীণ
এই আসা যাওয়ার সংসারের পথ তবে কি ওই অনন্তেই মিলায়, আর নইলে অপ্রাপ্তির পথে। আজকের দিনে বউ তার এই গান ধরলো কেন, তাকে আরো বিভ্রান্ত করে তুলতেই কি! আসলে মেয়েটির মৃতু্য অথবা নিজের অসহায়ত্ব, কিংবা মায়ের চলে যাওয়া তাকে অনেক ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। সেই সময়ে বউ কেন এই গান ধরে, নাকি সেও পড়েছে সকালের পত্রিকা। অথবা শহরের মৃতু্যগামিতা বিষয়ক আগের কোন আলোচনা তার মাথায় উঁকি দেয়- সে গেয়ে ওঠে এই গান। কে জানে! কিংবা এই যে পথ ধরে ছুটে যাচ্ছে তারা, ট্যাক্সিক্যাবে চড়ে। এমন অনেকেই যায়, অনেকেই অনেকবার এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করেছিল, এটাই নিয়ম। আত্মহত্যা করা মেয়েটির হাঁটা হবে না পৃথিবীর আর কোন পথে। আসলে হয়তো পত্রিকার খবরটাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে, তাকে আছর করেছে এই খবর। সে শুধু ভাবতে থাকে যাওয়ার বেলায় কোন বীণ বেজে ওঠে মৃতু্যমুখা মানুষের মনে। সেই গাছের ডালে ঝুলে পড়া মেয়েটি ঠিকরে বের হয়ে আসা চোখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কি এই আশায় তাকিয়ে ছিল যে কেউ আসবে দুহাতে তার ঈদের জামা নিয়ে। তার বুকের ভেতরে বেঁচে ওঠার যে বীণ বেজেছিল তাতে সাড়া দেয়নি কোন হাত_তাল লয়ে কম্পিত হয়নি কোন হূদয়। সবার অগোচরে তার গমন। হয়তো কেবল অাঁচড় বসিয়ে গেছে তার মা-বাবার স্মৃতিপটে, মরে সে দখল করেছে পত্রিকার দুই বাই দুই ইঞ্চি জায়গা। কাঁধ হতে ঝুলে থাকা এই দুহাতে সেওতো মেয়েটির জন্য ঈদের জামা কিনে নিয়ে যেতে পারতো। অথচ সে তখন এই শহরে কাগজে ছাপা টাকায় অথবা পত্রিকায় সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আজকের এই ছুটির দিনে, একটা মেয়ের আত্মহত্যা সম্পর্কিত খবরের তীব্র প্রতিক্রিয়ায়, তার নিজের ওপর নিজের ঘেন্না ধরে যায়। তবে কি এই দুই হাত শুধু টাকা গুনে যাবে, বাজার করে যাবে, বউ আর সন্তানকে সোহাগ করে যাবে। এই দুহাতের ছোঁয়ায় বেঁচে উঠবে না কোন জীবন, কোন বৃক্ষ। অসহায়ত্ব গ্রাস করে তাকে। নিজের হাতে চুলে বিলি কাটে। হয়তো হাতগুলোকে সার্থক করে তুলতেই সে তা করে।
পার্কে বউ-বাচ্চাকে ঘুরতে পাঠিয়ে নিজে পায়চারি করে। চৈত্র আসছে। চৈত্র কি ভীষণ, বেঁচে থাকবার আকুতিকে প্রচণ্ড করে তোলে। চৈত্রের কি তবে পুরুষ স্বভাব আছে। সন্তানটি তার নাগরদোলায় চড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে পাশেই একটি বেঞ্চিতে বসে সিগারেট ধরায়। চোখে পড়ে চানাচুরের ঝাল নুন তেলমাখা পত্রিকার টুকরা। ফলাফল প্রকাশ বা খেলোয়াড়দের উলস্নাসের ছবি। হঠাৎ তার মনে হয়, এই টুকরার তো আরো অংশ আছে। সব অংশ মিলিয়ে যে পত্রিকা হয় তাতেও কি ছাপা আছে ওই মেয়েটির মৃতু্য সংবাদ। কিংবা অন্য কোন মানুষ মরার বা মারার খবর। নাহলে কি আর আজকের যুগে সে পত্রিকা হয়ে উঠতে পারে। পত্রিকার কালো কালো অক্ষরগুলোকে তার কাছে শুকিয়ে আসা জমাট কালো রক্ত মনে হয়। ঝিম ধরা মাথায় সেই কালোয় শুধু সংখ্যা ভেসে ওঠে পত্রিকার পাতায়। মৃতের সংখ্যা অসংখ্য-অগুনতি। প্রথম পাতা ভরে গিয়ে দ্বিতীয় পাতায়ও। খালি সংখ্যা। নাগরদোলা ঘুরতে থাকে- ক্যাঁএএএউঁ ক্যাঁএএএউঁ। পত্রিকা জুড়ে শুধু যত মানুষ মরেছে তার সংখ্যা। তীক্ষ্ন হয় ক্যাঁএএএউঁ। অস্থির হয়ে পাতা ওল্টায় সে। পুরো পত্রিকা জুড়েই খালি সংখ্যা আর সংখ্যা। সাংবাদিকের পক্ষে অন্য কোন সংবাদ ছাপানোই সম্ভব হচ্ছে না। সংখ্যার কি ভয়াবহ রূপ। পাতা ওল্টানোর গতি দ্রুত হয়। ক্যাএএএউঁ শব্দ বৃত্ত রচনা করে। সে দেখতে পায় মৃতের সংখ্যা কেমন যেন গোল গোল ছোট বৃত্ত হয়ে যায়। এতোবড় পত্রিকার পুরোটা জুড়েই সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালো বৃত্ত। ক্যাঁএএএএউঁ এর সাথে এবার কচি কণ্ঠের চিৎকার মিশে যায়। আর পত্রিকার শিরোনামে সে দেখতে পায়, সম্পাদকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আজ শুধু মৃতদের একটি করে চোখের মণি ছাপানো হয়েছে, অন্য কোন খবর ছাপানো সম্ভব হয়নি বলে আমরা দুঃখিত।
শ্বাসটান উঠে যাওয়ার অবস্থা হয় তার। চোখের সামনে সর্বগ্রাসী এক কালো গহ্বর দেখতে পায় যার কিনারায় সে ঝুঁকে আছে। হঠাৎ আব্বু ডাকে টলে ওঠে। নাগরদোলায় যতো উলস্নাস নিয়ে চড়েছিল, নামার সময় ততটাই শূন্যতার বোধ বাচ্চাটার সেই উলস্নাসকে ভয়ে পরিণত করেছে। বাবার বুক এখন তার আশ্রয়। বাবাও যেন এক ঝলক বাতাস চাইছিলেন। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে তার বুক থেকে সেই বাতাসটুকু টেনে নিলেন। কান্নার বেগটাকে দমন করলেন। নিজের দুই হাতের তালু, আঙ্গুলের ডগা-ভাঁজ, কররেখার খাঁজে জমে থাকা সমস্ত মমতা দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় সে সন্তানটাকে। তার মুখে ঘাম-লালার গন্ধে জীবন আছে। বিকাশ আছে। বাচ্চাটা যেন সেই কচি করলার লতা। তার গোড়ার কাঠিটা হয়ে উঠতে চায় সে। আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে বেড়ে উঠবে বাচ্চাটা। শাদা ফুলে হেসে উঠবে পরাগায়নের রোমাঞ্চে। মেয়েটির মৃতু্য তবে শুধু পত্রিকারই সংবাদ। ওই মেয়েটির মৃতু্য তবে তার জীবনের জন্য অপ্রাসঙ্গিক মৃতু্য।
===========================
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা  গল্প- বট মানে গরুর ভুঁড়ি  গল্প- কিশলয়ের জন্মমৃত্যু  গল্প- মাকড়সা  দুর্নীতি প্রতিরোধে আশার আলো  জাগো যুববন্ধুরা, মুক্তির সংগ্রামে  ঢাকা নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন প্রয়োজন  মারিও বার্গাস য়োসার নোবেল ভাষণ- পঠন ও কাহিনীর নান্দীপাঠ  লন্ডন পুলিশ জলকামানও নিল না  রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধাপরাধী বিচারের দায়বদ্ধতা  পোশাক শিল্পে অস্থিরতার উৎস-সন্ধান সূত্র  বাতাসের শব্দ  গোলাপি গল্প  বজ্র অটুঁনি অথবাঃ  উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট  আনল বয়ে কোন বারতা!  ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা  বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে  উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব  বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি  অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা  খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ সালাহ উদ্দিন শুভ্র


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.