স্মরণ- স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন by শাহ্নাজ রব

হীদ মির্জা লেন চাটগাঁয়ের মেহদিবাগ এলাকার ছোট একটা গলি। ১৯৬৭-৬৯ সালের শৈশবের সেই সময়টা বেশি মনে রাখার মতো। তখন আমি সেন্ট মেরিজের কেজি টুতে পড়ি। তখন কিন্তু গলিটার নাম শহীদ মির্জা লেন ছিল না। এখানেই ১৯৭১-এ আমার বাবা হারিয়ে গেছেন।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিলের তপ্ত দুপুরে সেই যে পাকিস্তানি সেনারা আমার বাবাকে এক ঘণ্টার কথা বলে ধরে নিয়ে গেল, সেই এক ঘণ্টা আর ফুরাল না। তারপর আমাদের নিয়ে আমার মায়ের সংগ্রামী জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে চাটগাঁয়।
তখন শহীদ মির্জা লেনটা এই রকম বাড়িঘরে ঠাসাঠাসি ছিল না। প্রায় ২৫ বছর পর শুধুই স্মৃতিচারণার জন্য শহীদ মির্জা লেনে যাওয়ার সময় করতে পারলাম। এতদিন পর চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না। চেনা বাড়িগুলোর মধ্যে প্রথমই বাঁ দিকে পড়ল বাদল ভাইদের বাড়ি। তারপর একটু এগোলে ২৩ নম্বর বাড়িটা, যার নিচতলায় আমরা থাকতাম; রাস্তা থেকে দেখা যায়। উঁকি দিয়ে দেখলাম সেই গ্রিল, সেই জানালা, সেই ঘরটা, যেটা আমাদের দুই বোনের ছিল। আর আমার বাবার লেখার টেবিল ছিল ওই ঘরে। নেমে গিয়ে দেখে আসার সাহস হলো না।
আরেকটু এগোলে বাঁ দিকে সেই বাড়িটা, যেখানে আমার স্কুলের অবাঙালি বন্ধু নাজনীন, শাহীন—ওরা থাকত। ওরা দুজন আমার সিনিয়র ছিল, ওদের ছোট ভাইটা আমার ক্লাসে পড়ত। তার নাম বেমালুম ভুলে গেছি, সম্ভবত মোয়াজ্জেম আলী বা মোহাম্মদ আলী। আরেকটু এগোলে প্রিয়দা রঞ্জন সেনগুপ্তের (সংগীত ভবনের প্রতিষ্ঠাতা) বাংলো ধাঁচের বাড়ি, সামনে অনেকটা খালি জায়গা। সেখানে এখন পাঁচ-ছয়তলা বাড়ি। গলির শেষ প্রান্তে মুসা সাহেবের বাসায় ভাড়া থাকতেন আমার ছোট খালা। ছোট খালাদের নিচতলায় থাকত ডেফনি, নরমা ও ফিলিপ। ওরা ছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আর দোতলায় ছিল জারাহ, সুরাইরা। ওদের মা ছিলেন বার্মিজ, বাবা পাকিস্তানি। জারাহ-সুরাইয়াদের মা প্রায়ই মজার মজার কাবাব আর পরোটা খাওয়াতেন।
ডেফনি-নরমাদের ফ্ল্যাটে পরবর্তী সময়ে এসেছিলেন মির্জা সাহেব, যাঁকে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিল এবং তাঁর নামেই গলিটার নামকরণ করা হয়েছিল শহীদ মির্জা লেন। ছোট খালাদের সঙ্গে তাঁর বেশ ভালো সম্পর্ক থাকায় দু-একবার তাঁকে দেখেছিও। তাঁর কথা বেশি মনে আছে এ জন্য, একাত্তরের ২৬ মার্চ তাঁর ফ্ল্যাটে কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম। ওই কথা মনে হলে এখন হাসিও পায়, মনও খারাপ হয়। ঘটনাটা এ রকম: আমরা সত্তরেই শহীদ মির্জা লেনের বাড়ি ছেড়ে মেহদিবাগেই আমাদের নিজেদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। ২৫ মার্চের ভয়ংকর রাত্রির পর আমরা চলে এলাম খালার বাসায়, যাতে পরামর্শ করে সবাই একসঙ্গে কোথাও চলে যেতে পারি। ২৬ মার্চ দুপুরের দিকে গোলাগুলি একটু থামায় খালা আমাদের সবাইকে গোসল করে নিতে বললেন। মিতাকে ঢুকতে না দিয়ে আমি কেবল ঢুকছি গোসল করতে, তক্ষুনি শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড গোলাগুলি। দৌড়ে বেরিয়ে এলাম বাথরুম থেকে খালি গায়ে। কাপড় পরার সময় নেই, টাওয়েল জড়িয়েই একেবারে নিচে। মির্জা আঙ্কেলের একতলার বাসায় কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার যে কী লজ্জা লাগছিল টাওয়েল জড়ানো অবস্থায়! মিতার চোখেমুখে খুশি। ভাবটা এমন, আমাকে গোসল করতে না দিয়ে নিজে ঢুকল। এবার বোঝো মজা। অনেক দিন মিতা আমাকে এটা নিয়ে খ্যাপাত। সেই শেষ দেখা মির্জা আঙ্কেলের সঙ্গে।
মনে পড়ে শফির কথা। ও ছিল মিস্ত্রি, খুব সম্ভব রাজমিস্ত্রির জোগালি বা ওরকম কিছু। ও আমাদের আম্মাকে আম্মা ডাকত। আম্মা ওকে দিয়ে টুকিটাকি বাইরের কাজগুলো করাতেন—বিনিময়ে একটু বকশিশ, একটু খাওয়ানো। সেই শফি থাকত এই শহীদ মির্জা লেনে। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’ করত সারাক্ষণ। শুনেছিলাম, শফিকেও শহীদ মির্জা লেনের একটা লাইট পোস্টের সঙ্গে বেঁধে প্রচণ্ড নির্যাতন করে মারা হয়েছিল। কোনটি সেই লাইট পোস্ট? সবগুলোর দিকেই চেয়ে মনে হয়েছে, এটাই বোধহয় সেই লাইট পোস্ট, যেটাতে শফিকে বাঁধা হয়েছিল। কেমন লেগেছিল তখন শফির? মার কথা মনে হয়েছিল? বিপদের সময় কেন যে সবার মায়ের কথাই মনে পড়ে।
শহীদ মির্জা লেনের এ বাসায়ই আমার দাদা (বাবার মামা) স্বনামধন্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ১০-১২ দিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। তখন বুঝিনি, তিনি কত বড় মাপের মানুষ; শুধু বুঝেছিলাম, তিনি খুবই মজার মানুষ। তিনি উপুড় হয়ে শুয়ে আমাদের তিন ভাইবোনকে বলতেন পিঠ থেকে পা পর্যন্ত হেঁটে যেতে। আমরা তা-ই করতাম। কত লোক যে তাঁকে দেখতে আমাদের বাসায় এসেছিল তখন, বলার নয়। আমরা তাঁকে নিয়ে পতেঙ্গা সি-বিচ, কাপ্তাই, কাপ্তাই লেকে রিভার ক্রুজ—কত কিছুই না করেছিলাম।
ভেবেছিলাম, গলিতে ঢোকার পর আমি বোধহয় কেঁদেই ফেলব। ওই বাড়িতে থাকার সময় আমাদের পরিবারের যারা ছিলেন, তাঁরা কেউই আজ কাছে নেই। বাবা গিয়েছিলেন একাত্তরে, মা ১৯৯৮-এ। মিতা আর সাজ্জাদ—আমার ছোট বোন আর ভাই এখন আমেরিকায়। কেবল সবার ছোট বোন শান্তা দেশে; ওর তো তখন জন্মই হয়নি। কিন্তু না, আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি এল না। শুধু মনে হলো, এখনই যদি সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসত, কেমন হতো! কোনোভাবে আমি যদি চলে যেতে পারতাম সেই সময়ে। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ঘটনা ঘটে কত সময় নিয়ে, কিন্তু স্মৃতিচারণা করতে লাগে কয়েক সেকেন্ড। আল্লাহকে ধন্যবাদ, তিনি আমাদের স্মৃতিচারণার ক্ষমতা দিয়েছেন। আবার দিয়েছেন বিস্মৃতিও। তা না হলে এত শোক, এত কষ্ট, এত দুঃখ কীভাবে চাপা দিতাম আমরা!
=========================
ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ শাহ্নাজ রব


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.