আলোচনা- স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি by মোস্তফা হোসেইন

দিকনির্দেশনাহীন শিক্ষাব্যবস্থায় দেশ চলেছে প্রায় ৪০ বছর। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক নীতিমালা অনুসরণ করেই চলছিল শিক্ষাক্রম। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখে শিক্ষানীতি পরিবর্তনের প্রয়োজন থাকলেও উদ্যোগগুলো বাধাগ্রস্ত হয়েছে দেশ-চালকদেরই নীতি-নৈতিকতার দুর্বলতার কারণে। তবে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা নিয়ে নতুন কথাবার্তার কমতি হয়নি কখনো।
সেই আলোকে কমিশন গঠন, প্রতিবেদন তৈরি এবং তা পুস্তকাকারে সরকারপ্রধানের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর_এমন সচিত্র সংবাদও আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টই বাস্তবায়িত হয়নি। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে কোনোটাই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি ছিল না এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। যদিও ব্যতিক্রম হিসেবে কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদনের নাম উল্লেখ করা যায়। সময়ের নিরিখে কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদন অধিকতর গ্রহণযোগ্য হলেও সেটিও আলোর মুখ দেখতে পায়নি দেশে সামরিক সরকার আসার কারণে এবং সেই সূত্র ধরে মৌলবাদ প্রতিষ্ঠায় কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার কারণে। সে রিপোর্টও যদি কার্যকর হতো তাতেও সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হতো এত দিনে।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশের নাগরিক বিভাজন হয়েছিল প্রগতির পথে এবং পশ্চাদপন্থী_এই দুই ধারায়। ফলে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীগুলো সংগত কারণেই আরো পিছিয়ে পড়ে। এই বিভাজনের জন্য আমাদের সমাজব্যবস্থাই অনেকাংশে দায়ী। যেমন_বিত্তবানদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবনের শুরু এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-সুযোগের মধ্যে তৈরি হয়েছে একটি দেয়াল। এই দেয়াল এতই মজবুত ভিতের ওপর তৈরি যে বাকি জীবনেও শিক্ষার্থীদের পক্ষে তা ডিঙিয়ে বৃহত্তর দুনিয়ার আলো দেখার সুযোগ হয় না।
দেয়াল তুলে শিক্ষাকে পৃথক করার কাজে শুধু যে বিত্ত এবং প্রভাব নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তা-ই নয়, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ধর্মের প্রভাবও। ধর্মীয় প্রভাবের ক্ষেত্রে কারো কোনো অসদিচ্ছা না থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ধর্মীয় শিক্ষার নামে আমাদের সন্তানদের পিছিয়ে রাখার একটি ধারা বিদ্যমান রয়েছে। বিত্তের কারণে যেন কেউ শিক্ষা বৈষম্যের শিকার না হয়, এদিকটি দেখার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের সংবিধানও সেই নির্দেশ প্রদান করেছে। একইভাবে ধর্মীয় কিংবা সাম্প্রদায়িকতার কারণেও যেন শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি না হয়, সেটিও আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশ।
সংবিধানকে মানতে গেলে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন যেমন জরুরি ছিল তেমনি মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে হলেও এর পরিবর্তন ছিল অবশ্যম্ভাবী। ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা চালু থাকবে। পাশাপাশি মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে এসে কোনো শিক্ষার্থী যাতে যেকোনো বিষয়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে সমান তালে চলতে পারে, সে দিকটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। শুধু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করা কিংবা ধর্মীয় পরামর্শক হিসেবে কাজ করাই নয়, তারা যাতে বিজ্ঞাননির্ভর জীবনযাপনের সুযোগ পেতে পারে, সেভাবে তাদের তৈরি করার জন্যও মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজন অনেক আগ থেকেই অনুভূত হয়ে আসছিল।
আবার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত করাও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেসব দিক বিবেচনা করেই বর্তমান সরকারি দল ক্ষমতায় আসার আগে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর স্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করেছিল। আর সে আলোকেই সরকার জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০০৯ প্রণয়ন করেছে, যা গত ৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে।
শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়ার আগেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চালু হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পরীক্ষার ফল ঘোষণার বিষয়টিকে। আগে প্রচলিত ডিভিশন প্রথার পরিবর্তে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হওয়ার কারণে এখন থেকে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে আমাদের পরীক্ষার ফলও একই রকম হয়ে গেছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। অবকাঠামোগত সুবিধা বিস্তৃত করার পাশাপাশি শিক্ষাদান সুবিধাকেও পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষায়তনের এমপিওভুক্তিকরণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার আমলে এবং পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বন্ধ থাকা এমপিওভুক্তকরণ কার্যক্রম চালু করে দেশে শিক্ষকদের অনিশ্চিত চাকরি জীবনের অবসান ঘটানো হয়েছে। নকলমুক্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বছর শুরু হওয়ার আগেই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই পেঁৗছে দেওয়ার সাফল্যও এই নতুন শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যকেই নির্দেশ করে।
শিক্ষাব্যবস্থায় এই সুপরিবর্তনকে সব মহলই মেনে নিয়েছে। এমনকি বিগত জোট সরকারের আমলে গঠিত শিক্ষা কমিশনের প্রধান অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞাও এই শিক্ষানীতিকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেছেন। নতুন শিক্ষানীতির আলোকে গৃহীত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও নিম্ন-মাধ্যমিক স্তর ভাগ করার ব্যাপারটিও বিনা প্রতিবাদে সব মহলের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর বর্তমান শিক্ষানীতির আগ পর্যন্ত যতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্ট ছাড়া প্রতিটিই জনগণের প্রতিবাদের মুখে পরিত্যক্ত হয়েছে।
শিক্ষানীতি প্রণয়নকালে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়েছে। আলোচনা করা হয়েছে শিক্ষাবিদ, ওলামা-মাশায়েখদের সঙ্গেও। ফলে কেউ যদি এই শিক্ষানীতি বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে যান তাহলে মনে করতে হবে, প্রশ্ন উত্থাপক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজের স্বার্থ চিন্তা থেকেই তা করছেন। এ মুহূর্তে কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার ব্যাপারে সরকার বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে না হলেও আশা করা যেতে পারে, এই শিক্ষানীতি কার্যকর হলে কওমি শিক্ষাব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আসবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর ৬ অধ্যায়ে (মাদ্রাসা শিক্ষা) উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য শিরোনামে সূচনা অংশের কিছু বক্তব্য পড়ে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, 'মাদ্রাসা শিক্ষায় ইসলাম ধর্ম যথাযথভাবে শেখানো হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জীবনধারণসংক্রান্ত ও বিভিন্ন জাগতিক কাজকর্মে পারদর্শী হয়ে ওঠা এবং উৎকর্ষ সাধন করার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যথার্থ জ্ঞান লাভের ব্যবস্থা করা হবে। সাধারণ বা ইংরেজি মাধমে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা যেন সমানভাবে অংশ নিতে পারে, সেই লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা এভাবে ঢেলে সাজাতে হবে।'
সেই সূত্রে ইবতেদায়ি পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, সামাজিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান পড়ানো হবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা প্রদান করা হবে। দাখিল পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাধ্যতামূলক থাকবে ।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষায় জাগতিক বিষয়গুলোকে সংশ্লিষ্ট করার মাধ্যমে অগ্রসরমাণ নাগরিক গঠনের পথ প্রশস্ত হয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পথে ক্ষুদ্র কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ হয়তো বিঘি্নত হতে পারে।
এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী যাতে তাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট মহলকে এর সুফল সম্পর্কে জানাতে হবে। যত ক্ষুদ্র এবং পশ্চাৎপদ মানসিকতাই তারা ধারণ করুক না কেন, তাদেরও বোঝাতে হবে, বেঁচে থাকা মানুষই ধর্ম পালন করতে পারে। আর যিনি সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকেন, তিনিই পারেন অধিকতর ধর্মানুগ হতে। সুতরাং জাগতিক সমৃদ্ধিকে স্বাগত জানানোটা ধর্মবিদ্বেষী কোনো ব্যাপার নয়। তাই ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষার্জনও জরুরি। তা না হলে অগ্রগতি ব্যাহত হবে।
==================================
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মোস্তফা হোসেইন


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.