আলোচনা- ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে by এস আর অরণ্য

ময়কাল সম্ভবত শরতের প্রথম অথবা মাঝামাঝি হবে। ২০০৫ সালের শরতের কোনো এক প্রহরে সময় অনুমান ২১:৪০ ঘটিকার দিকে হঠাৎ করে শহরময় হৈচৈ পড়ে গেল। প্রাচীন জেলা শহরের পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির বিশাল বাড়ির বহিরাঙ্গনের প্রাচীরসংলগ্ন মূল রাস্তার ধারে মধ্যম সারির একজন উদীয়মান ধর্মীয় চেতনায় সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তি মনে হচ্ছে যেন হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা জানালেন, শ্মশ্রুমণ্ডিত অতিপরিচিত হাবিব-বিন-শমসের নামের ব্যক্তিটি হাত-পা ছড়িয়ে ওই বিখ্যাত ব্যক্তির মূল সড়কসংলগ্ন প্রাচীরে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন। তিনি তাঁর কাছে গিয়ে বসে থাকার হেতু জিজ্ঞেস করলেন এবং যথারীতি অতি কাছে গিয়ে তাঁকে কয়েকবার ডাকাডাকি করলেন। সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিতেই ওই ব্যক্তি রাস্তায় শোয়ার ভঙ্গিতে পড়ে গেলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তির বুঝতে অসুবিধা হলো না যে উদীয়মান তরুণ রাজনীতিকের কোনো সমস্যা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে গাড়িতে করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করলেন।
পরের দিন সারা দেশের জাতীয় এবং স্থানীয় দৈনিকে ফলাও করে এ-সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশন করা হলো। হবেই না কেন? তিনি তো একজন ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের বিভাগীয় সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরহেজগার, সম্ভাবনাময় অবিবাহিত একজন উদীয়মান তরুণ জননেতা হিসেবে এলাকায় বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। একজন তরুণ ক্ষমতাসীন দলের মধ্যম সারির নেতা, যাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে তাঁকে নিয়ে সংবাদপত্রে হইচই তো হবেই। বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্নভাবে এ বিষয়ে মুখরোচক কাহিনী ছেপে বসল। কোনো কোনো পত্রিকা লিখল, ক্ষমতাসীন মূল সংগঠনটির প্রভাবশালী নেতা_যাঁর বাড়িসংলগ্ন প্রাচীর থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেই ব্যক্তি নিজের পথকে নিষ্কণ্টক করতে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে তাঁকে হত্যা করে তাঁর লাশ এভাবে ফেলে রেখেছেন। অন্যদিকে কিছু পত্রিকা লিখল যে তাঁর মৃত্যুর পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী অপর একটি ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির। কিছু পত্রিকায় এ ধরনের সংবাদ ছাপা হলো যে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কারণে এবং জঙ্গিদের ব্যাপারে অনেক তথ্য জেনে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে হত্যা করা হতে পারে। কিছু পত্রিকা তাঁর হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রধান বিরোধী দলকে দায়ী করে বসল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলেই তাঁর প্রকৃত হত্যাকারী কে?
উদীয়মান তরুণ রাজনীতিকের মৃতদেহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করা হলো। কোথাও কোনো রকমের আঘাতের চিহ্ন নেই। কেবল বাঁ কানের ওপরে চিকন একটি আঘাতের চিহ্ন দেখা গেল, যেখান থেকে সামান্য রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বাসই হতে চায় না যে এত অল্প আঘাতেই কোনো মানুষের মৃত্যু হতে পারে। পরনের সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামায় কোনো ধরনের ভাঁজ হওয়া অথবা ময়লা লাগার চিহ্ন দেখা গেল না। মৃতের পায়ের স্যান্ডেলের কোনো হদিস পাওয়া গেল না, তবে পাঞ্জাবির ডান পাশের পকেটে অত্যাধুনিক মডেলের তাঁর ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোনসেট পাওয়া গেল। হত্যাকারীরা হয়তো অজ্ঞাতসারে অথবা তাড়াহুড়ো করে মনের ভুলে তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেটটি না নিয়েই মৃতদেহটি বসার ভঙ্গিতে রেখে সটকে পড়েছে। মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনাস্থলটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করেও হত্যাকারীদের রেখে যাওয়া কোনো আলামত পাওয়া গেল না।
প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষী না থাকায় এবং ভিকটিম শহরের অতিপরিচিত উদীয়মান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় থানা পুলিশ মামলাটি নিয়ে বেশ চাপের মধ্যে পড়ে গেল। ভিকটিমের মোবাইল ফোনে মিসকল এবং রিসিভড কল যাচাই-বাছাই করে হত্যাকারীদের খোঁজার চেষ্টা করা হলো। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হলো। পত্রপত্রিকায় তাঁর হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য খুনিদের ব্যাপারেও যেসব বক্তব্য ছাপা হয়েছিল, তা-ও বিশ্লেষণ করা হলো। এ মামলাটির রহস্য উদ্ঘাটনে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রচণ্ড চাপ ছিল। সব কিছু মিলিয়েই তদন্ত কর্মকর্তাসহ তদারককারী অফিসারের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই রহস্য উদ্ঘাটনের কোনো সূত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। ভিকটিমের মোবাইল ফোনের রিসিভড কল থেকে কয়েকটি কল চিহ্নিত করে তা যাচাই-বাছাই করা হলো। অবশেষে একটি কলকে রহস্যময় বলে মনে হলো। কিন্তু সমস্যা হলো, কলটি যাচাই করে দেখা গেল, এটি করেছেন একজন মহিলা। মোবাইল ফোনের ঠিকানা খুঁজে দেখা গেল, তাতে সঠিক ঠিকানা লিপিবদ্ধ হয়নি। ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো নারীর সঙ্গে ভিকটিমের কোনো সম্পর্ক আছে কি না বা আত্মীয় বা পরিচিত কোনো নারীর সঙ্গে তিনি কখনো মোবাইল ফোনে কথা বলতেন কি না তা-ও অনুসন্ধান করার চেষ্টা চালানো হলো। পরিবারের সদস্যরা জানান, যেহেতু ভিকটিম একজন অবিবাহিত এবং অত্যন্ত পরহেজগার ব্যক্তি ছিলেন, কাজেই তিনি এসব বিষয়ে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। ভিকটিমের ছোট ভাই জানান, তাঁর ভাই কোনো একসময় অসুস্থ হলে একজন ভদ্রমহিলা ক্লিনিকে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। তা-ও অনেক আগের ঘটনা। ভিকটিমের ভাই মেয়েটির বাবা একজন সাবেক এমপি বলে জানালেও কোনো ঠিকানা বা পরিচয় জানাতে পারলেন না।
ভিকটিমের ছোট ভাইয়ের বক্তব্যে আশার ঝিলিক দেখা গেলেও কোনো ধরনের নাম ও ঠিকানা জানতে না পারায় আশ্বস্ত হওয়া গেল না। তার পরও এমপি সাহেবের মেয়ে_এ সূত্র ধরে ভিকটিমের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের রিসিভড কলের তালিকা যাচাই করে মেয়েটিকে খোঁজার চেষ্টা চলতে লাগল। চার-পাঁচ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একজন সাবেক এমপির একটি মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেল, যাঁর ওই শহরে বিয়ে হয়েছে। এই সামান্য সূত্র ধরে ওই মহিলাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলো এবং তাঁকে প্রথম জিজ্ঞাসাবাদেই পরিষ্কার হলো যে ভিকটিমের সঙ্গে তাঁর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। ওই মহিলাকে থানায় এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, ভিকটিম এবং মহিলা একত্রে ঢাকায় গিয়ে গুলিস্তান এলাকার একটি হোটেলে ওঠেন। ওই হোটেলে একই রুমে তাঁরা দুই দিন রাতযাপন করেন। হোটেলের মালিক এবং ম্যানেজার ভিকটিমের আগের পরিচিত। মহিলা আরো জানান যে তাঁর সঙ্গে ভিকটিমের প্রেমঘটিত এবং শারীরিক সম্পর্ক ছিল। তাঁদের সম্পর্কের বিষয়টি ওই মহিলার স্বামী এবং বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও জানতেন। এমনকি ভিকটিমের রাজনৈতিক অনুসারী অনেক নেতা-কর্মীও বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। মহিলার স্বামী ১২-১৩ বছর ধরে বিদেশে অবস্থান করায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই চার-পাঁচ বছর আগে ভিকটিমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং পরবর্র্তী সময় ওই পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রেম এবং শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যেহেতু ভিকটিম স্থানীয়ভাবে খুব প্রভাবশালী ছিলেন, তাই মহিলার সংসার বাঁচানোর জন্য এবং তাঁকে (মহিলা) সুপথে আনার জন্য কৌশলে ভিকটিমকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে অনুমিত হলো।
ভিকটিমের ঢাকায় যাওয়া, তথায় হোটেলে অবস্থান, তাঁর সঙ্গীয় মহিলার মোবাইল ফোনে কল, ডিটেইলস ওই ভদ্র মহিলার বাবার মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড_সব কিছু পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে ভিকটিমের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই মহিলার পরিবার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। মহিলার বাবা একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, দুবারের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্যের কারণে মামলা তদন্তে আর অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ভিকটিম নিজে একটি ইসলামী দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হওয়ায় দলের হাইকমান্ড থেকেও তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে নারীঘটিত বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নেওয়া হয়নি। ইসলামী দলটির হাইকমান্ড মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য নানাবিধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ওই দলটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের শরিক দল হওয়ায় তাদের মধ্যে সহজেই এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা সহজ হয়ে যায়। ফলে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি উদ্ঘাটনের আগেই মামলার তদন্ত কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধানে প্রভাব খাটিয়ে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। এভাবেই একটি ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। রাজনীতি এবং ক্ষমতা বড় বিচিত্র বিষয়। রাজনীতি চিরস্থায়ী করতে এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অনেক অসৎ প্রকৃতির রাজনীতিবিদ ঠিক এভাবেই হাজার হাজার হত্যাকাণ্ডসহ অবিচারের প্রতিকার নানা কৌশলে ধামাচাপা দেয়। হয়তো এভাবেই ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হতে হতে একদিন জাতির বিবেক জাগ্রত হবে। কালের বিবর্তনে ক্ষমতার প্রভাব আর কৌশলী রাজনীতির মারপ্যাঁচ থেকে সাধারণ জনগণ পরিত্রাণ পাবে। আর তখন আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পথ কণ্টকমুক্ত হবে।
=========================
চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ এস আর অরণ্য
একজন পুলিশ কর্মকর্তা


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.