আলোচনা- মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

জ থেকে ৬২ বছর আগে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বজনীন মানবাধিক সনদ ঘোষণা করা হয়। সাত-আট দশকে 'মানবাধিকার' শব্দটি সভা-সমিতিতে তেমনভাবে উচ্চারিত বা আলোচিত না হলেও বর্তমানে প্রতিটি দেশে মানবাধিকারের প্রশ্নটি গভীরভাবে আলোচিত হচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা দেখে মানুষ উদ্বেলিত হয়ে চিন্তা করে, কিভাবে বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
মানবাধিকার সনদের প্রস্তাবনায় বলা হয়, 'চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে মানুষকে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করা না হয়_মানবাধিকারসমূহকে অবশ্যই আইনের শাসন দ্বারা সংরক্ষিত করা উচিত।' ১৯৭১ সালে ওই প্রস্তাবনায় যে আশঙ্কার কথা বলা হয় সেই নিদারুণ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ অনন্যোপায় হয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যুদ্ধধ্বনি হিসেবে উচ্চারিত হয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করার এক বছরের মধ্যেই সংবিধান রচনা করি। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার এবং ১১ অনুচ্ছেদে মৌলিক মানবাধিকারের শব্দদ্বয় উল্লেখ করি এবং তৃতীয় বিভাগে মৌলিক অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ দিই। ৪৪ অনুচ্ছেদে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকারকে নিশ্চয়তা দান করা হয়। পাশ্চাত্য দেশের একটা অহমিকা আছে যে মানবাধিকার ধারণা তাদের চিন্তার ফসল, বিশেষ করে তা ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্ম-ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও আচরণ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ দাবির কোনো ভিত্তি নেই। ১৯৪৮ সালের আগেই বাংলাদেশের লোক তাঁদের ঐতিহ্য-সাহিত্য থেকে মানবাধিকারের ধারণা পেয়ে এসেছে। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কাছ থেকে আমরা ভাগ্যহত অসহায় মানুষ, নিপীড়িত ও অবহেলিত নারী এবং বঞ্চিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট কৃষক-শ্রমিকদের অধিকারের কথা শুনে এসেছি। নজরুল চিরন্তন বিদ্রোহের কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি সেই দিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না। নারী-পুরুষ বৈষম্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে যেখানে যা কিছু ভালো কাজ হয়েছে তার অধৈক করেছে নারী। লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে লালন প্রশ্ন করেছেন, স্বর্গে গিয়ে পুণ্যবান পুরুষ কিছু পেলে, পুণ্যবান নারী কী পাবেন? সমতার কথা বলতে গিয়ে তিনিই না বলেন, গরুর নানা রং কিন্তু দুধের রং সর্বত্র সাদা। আমাদের সংবিধানে শুধু নাগরিকের জন্য নয়, যেকোনো মানুষ_সে শরণার্থী বা সাময়িকভাবে অবস্থানরত হোক না কেন; সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৪৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশ্রয় লাভের অধিকারী। এখানে বিশেষভাবে ৩১ অনুচ্ছেদের বিধান উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মতো সাময়িকভাবে অবস্থানরত যেকোনো ব্যক্তির জন্যও আইনের আশ্রয়লাভ, আইনানুযায়ী এবং কেবল আইনানুসারী ব্যবহার লাভ একটি অবিচ্ছেদ্য অধিকার। আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবহার করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিকার পাওয়ার কথা সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা দপ্তরের কাছে। আদালতের কথা আসে শেষ আশ্রয় হিসেবে। আদালতের নাগাল পাওয়া সহজ নয় এবং তা ব্যয়বহুল। আমাদের প্রশাসনের দক্ষতার অভাব রয়েছে। এনকাউন্টার এবং ক্রসফায়ারে আমরা যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছি, তা অত্যন্ত লজ্জাকর। আমাদের অন্যায় এত বৃদ্ধি পায় যে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বাধ্য হয়ে দায়মুক্তির আইন পাস করে একটা অনপনেয় কলঙ্ক এঁকে দিই দেশের কপালে। মানবাধিকার সংরক্ষণে আমাদের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রশাসনকে, বিশেষভাবে আইনশৃঙ্খলা বিভাগকে আরো দক্ষ ও তৎপর হতে হবে। সুখের বিষয়, অতিবিলম্বে হলেও দেশে একটা মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে। আমরা সেই কমিশনের সাফল্য কামনা করি। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা আমরা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি। শাস্তিদান নিশ্চিত করার জন্য অকাট্য প্রমাণ সংগ্রহের কারণে বিচার বিলম্বিত না হওয়াই ভালো। অনেক দেরি হয়েছে। এ এমন এক অপরাধ, যার সৎকার অনুষ্ঠান যথাশিগগির সম্ভব সম্পন্ন করা হোক। আমরা আক্রোশবশত কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করব না। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ হচ্ছে, তাদের প্রতি স্নেহের পাত্র হিসেবে কোনো অনুকম্পাও প্রকাশ করব না।
============================
মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.