ফিচার- বাবর আলীর ইশকুল by আবু হেনা

শ্চিম বাংলার মুর্শিবাদের ছোট্ট একটি গ্রামের ছেলে বাবর আলী। ওই গ্রামে পড়াশোনার জন্য ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল। তারপরও ১৬ বছর বয়সী বাবর আলী বাড়ির আঙিনায় গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের জন্য গড়ে তোলে অন্য রকম স্কুল। যে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওই খুদে বাবর আলী। শুনুন বিস্তারিত।
পড়ন্ত বিকেল। একটি বাড়ির বাহির উঠানে জড়ো হয়েছে জনাশতেক ছেলেমেয়ে। আরামে দাঁড়াও ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে তারা। খানিক বাদে সবাই সমস্বরে গেয়ে উঠল তাদের জাতীয় সংগীত। জাতীয় সংগীতের সুর ধ্বনিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে থাকে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সংখ্যা। এক শত, দুই শত করে একসময় ওই সংখ্যা পৌঁছে যায় প্রায় আট শতের কাছাকাছি। ভরে ওঠে আঙিনা। বাধ্য হয়েই আঙিনা ছেড়ে কেউবা দাঁড়িয়ে যায় পাশের শুকনো খালে কিংবা রাস্তার ওপর। তারপরও কারও চোখে-মুখেই যেন নেই কোনো বিরক্তির ছাপ। সামনে বেশ কয়েকজন শিক্ষকও সুর ধরেন জাতীয় সংগীতের। শিক্ষকেরাও সবাই ওই সব ছোট ছেলেমেয়ের বয়সী। একসময় শেষ হয়ে আসে জাতীয় সংগীত গাওয়ার পর্ব। শিক্ষকদের মাঝ থেকে ক্লাস শুরু করার ঘোষণা দেয় প্রধান শিক্ষক বাবর আলী। ওই খোলা আকাশের নিচেই শুরু হয়ে যায় ক্লাস। নিত্যদিন এভাবেই শুরু হয় বাবর আলীর বৈকালিক স্কুল।
মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বাবর আলী। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের টুকটাক ফরমায়েশি কাজ সেরেই তাকে ছুটে যেতে হয় অটোরিকশা স্ট্যান্ডের দিকে। এরপর অটোরিকশায় প্রায় ছয় মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার পর বেশ দূর হাঁটতে হয় তাকে। বেশ দূর হাঁটার পরেই রাজগোবিন্দ স্কুল। এই স্কুলেই পড়ালেখা করে বাবর আলী। এই স্কুলের সেরা ছাত্রদের মধ্যে সে একজন। মুর্শিদাবাদে এটিই অন্যতম ভালো স্কুল। তবে স্কুলটি সরকারি হওয়ায় পড়তে খুব বেশি ব্যয় হয় না। তারপরও বাবর আলীর পড়াশোনার জন্য তার পরিবারকে প্রতিবছর গুনতে হয় প্রায় এক হাজার ৮০০ রুপি।
‘বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় এ স্কুলে আসাটা আমার জন্য সম্ভব হতো না। কিন্তু পড়ালেখা আমার খুব ভালো লাগে, শিক্ষকেরাও খুব ভালো। তা ছাড়া মা-বাবাও বিশ্বাস করেন, আমি হয়তো ভালো কিছু করব। এ কারণেই বহুদূর পথ পেরিয়ে স্কুলে আসি।’ বলছিল বাবর আলী।
তখন বাবর আলী সবে নয় বছরে পা দিয়েছে। স্কুল থেকে ফিরেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলার জন্য দিত এক ছুট। কিন্তু বন্ধুরা বাবর আলীর সঙ্গে না খেলে পড়াশোনা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে তাকে। কারণ, বাবর আলীর বন্ধুরাসহ ওই গ্রামের সবাই ছিল দরিদ্র। আর গ্রাম থেকে স্কুল অনেক দূরে হওয়ায় তারা পড়ালেখাও করত না। তাই বাবর আলী গুছিয়ে বন্ধুদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিত।
বছর খানেক আগের কথা। বাবর আলীর সঙ্গে পরিচয় হয় একই গ্রামের মেয়ে চুমকি হাজরার। ১৪ বছর বয়সী এ মেয়েটি তার দাদির সঙ্গে ছোট্ট একটি খড়ের চালায় থাকে। বাবা প্রতিবন্ধী হওয়ায় সকালে স্কুলে যাওয়ার বদলে মানুষের বাসা ঝাড়পোছ করতে যায় সেবিকা হতে চাওয়া এ মেয়েটি। এই কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে চুমকি হাজরাদের পরিবার। চুমকি হাজরার বিষয়টি শোনার পর থেকে তার জন্য কিছু করতে হবে চিন্তাটি বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে বাবর আলীর মনে। এ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে, এ গ্রামের আরও শত শত ছেলেমেয়ে অর্থাভাবে পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত। এবার এসব ছেলেমেয়ের জন্য কিছু একটা করতে হবে—ভাবনাটি পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসে বাবর আলীর মাথায়। সিদ্ধান্ত নিল, প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় নিজেই ওই সব ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাবে বাবর আলী। চুমকি হাজরাসহ অনেককে জানিয়েও দিল তার সিদ্ধান্তের কথা। প্রতিদিন বিকেল চারটায় স্কুল থেকে ফিরে মুখে একটু কিছু মুখে দিয়েই বাহির আঙিনায় শুরু করে দিল নিজের বানানো স্কুলে চুমকি হাজরাদের পড়ানোর কাজ। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবর আলী।
বাবর আলীর স্কুলের কথা একে-দুয়ে পাড়া, পাড়া থেকে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। এখন বাবর আলীর স্কুলে শুধু দু-একজন ছাত্রছাত্রী নয়, পুরো স্কুলের আঙিনা ভরে গেছে প্রায় ৮০০ ছাত্রছাত্রী দিয়ে। সবাই ঠাসাঠাসি করে বসে। কে সামনের সারিতে বসবে, তা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। চুমকি হাজরা এখনো আগের মতোই অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। তবে পুরো বিকেলটাই সে পড়ালেখা করে বাবর আলীর স্কুলে। বাবর আলীর স্কুলের সেরা শিক্ষার্থী এখন চুমকি হাজরা। চুমকির মনের ভেতর পুষে রাখা সেবিকা হওয়ার স্বপ্নটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। স্কুলের সবাই চুমকিকে নিয়ে বেশ আশাবাদী।
‘শুরুতে খেলাচ্ছলে বন্ধুদের নিয়ে পড়ানো শুরু করেছিলাম। কিন্তু একসময় ভাবলাম, এই দরিদ্র ছেলেমেয়েরা কখনোই পড়াশোনা করতে পারবে না। এটা তো হতে পারে না। তাদের পড়ালেখার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। আর স্কুলটি না হলে তা সম্ভব হতো না।’ বলছিল চুমকি হাজরার স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবর আলী।
স্কুলের ৮০০ শিক্ষার্থীকে সব বিষয় পড়ানোটা ঠিক সামলাতে পারছিল না বাবর আলী। বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাকে। তাই বাধ্য হয়ে স্কুলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ১০ জন শিক্ষকও নিয়োগ দিয়েছে বাবর আলী। তারাও বাবর আলীর মতো কোনো না কোনো স্কুল-কলেজের ছাত্র। তবে মজার ব্যাপার হলো, বাবর আলী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বই, খাতা বা টিফিনের জন্য কোনো অর্থ নেয় না। একদম অবৈতনিক। অন্যান্য শিক্ষকও বাবর আলীর মতোই নিস্বার্থভাবে শিক্ষাদান করছে। আর এখন পুরো স্কুলের ব্যয় চলছে স্থানীয় দাতাদের অর্থায়নে। গ্রামের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ স্বীকৃতিও দিয়েছে বাবর আলীর এই স্কুলটাকে।
১৬ বছর বয়সী বাবর আলী এখন বিকেলে স্কুলে পড়ানোর কাজ করে রাতে নিজের পড়ায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কারণ তাকেও যে অনেক বড় হতে হবে। অনেকেই অবশ্য বলছে, বাবর আলীই বিশ্বের সবচেয়ে খুদে প্রধান শিক্ষক হতে পারে। তবে এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই বাবর আলীর।
========================
এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ ওয়েবসাইট অবলম্বনে আবু হেনা


এই ফিচার'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.