নারী- সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি by শিরীন আখতার

০১০ সাল শেষ হয়ে এলো। সবাই হিসাব-নিকাশের খাতা খুলছে। বিভিন্ন ইসু্যতে লাভ-ক্ষতির হিসাব করছে বিভিন্ন জন। বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নীতি নির্ধারণ, রাজনীতি, শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ ও শ্রমের মূল্যায়ন সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে পুরুষের সুবিধার্থে সকল নিয়মকানুন গড়ে উঠেছে। এসব প্রয়োগ করতে গিয়ে নারীর ওপর নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় বাল্যবিবাহ. যৌতুক, বহুবিবাহ, অবহেলা, কুসংস্কার প্রভৃতি।
নারীর উন্নয়নের পথে বাঁধা নারীর প্রতি সহিংস আচরণ যা নারীর ক্ষমতায়নে শুধু প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে না, বরং সমাজকে করে পশ্চাদমুখী। ২০০৮ সালের এই ডিসেম্বর মাসেই আজকের মহাজোট সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলো। নারীর সম-মর্যাদা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন একটি অসামপ্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তিভূমি রচনা করা, প্রয়োজন সমাজের শোষণ- নিপীড়নের জাল ছিন্ন করা। বিজয়ের এই মাস ডিসেম্বর । ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জন করেছি আমরা এই বিজয়। কিন্তু আজও এই নারীদের, সেই শহীদদের যন্ত্রণা মুছাতে পারিনি আমরা। নির্যাতনের নানারূপে এই নারীরা আজও ক্ষত-বিক্ষত। নারীদের অধিকারহারা, মর্যাদাহারা এবং সম্ভ্রমহারা করার সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে একটি আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়বার জন্যই প্রয়োজন আইনগত হাতিয়ার।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেছিলেন ১৯৯৭ সালে। কিন্তু ২০০৪ এ বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ক্ষমতায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একজন নারী হয়ে জানতেই পারলেন না নারী উন্নয়ন নীতি বদল হয়ে গেল। সামপ্রদায়িকতার ছোবল, জঙ্গিবাদের কষাঘাতে মৌলবাদের দাপটে ক্ষত-বিক্ষত হল জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি।
শুধু নারী উন্নয়ন নীতিই নয়, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষায় জাতি বুক বেঁধে ছিল তা নস্যাৎ করবার জন্য '৭৫ এর ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছিল জাতীয় চার নেতাকে। একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি এই শক্তি। তারাই ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ২০০১-এর পরে জনগণ সেই শক্তির বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছে। রুখে দাঁড়িয়েছে। ২০০৮ এর নির্বাচনে এই গোষ্ঠীকে ভোটযুদ্ধে পরাজিত করে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় করেছে। আজকের যে সরকার ক্ষমতায় তাদের কাছে নারী সমাজের আকাঙ্ক্ষা এক ধাপ এগিয়ে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বিগত সরকারের সময়ে ১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ও ১৯৯৮ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সরাসরি ভোটে নারীদের অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে মাইলফলক স্থাপন করেছিলেন। বর্তমান মহাজোট সরকার আমলেও তিনি নারীর ক্ষমতায়নের অনেকগুলো পথ উন্মুক্ত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন নারীদের এবং নারীদের দিয়েছেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ। সরকারের শুরুতে নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ পুর্নবহাল এবং তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও করেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে দুই বছর অতিবাহিত হলেও নারী উন্নয়ন নীতি অনুমোদন হয়নি আর এ কারণেই আজকে প্রয়োজন এর পক্ষে কথা বলা। সরকারের হাতে আছে মাত্র তিন বছর। অঙ্গীকার পূরণের জন্যে নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। যার মধ্যে আছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা, সামপ্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গঠন, পানি, বিদু্যৎ, গ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানাবিধ জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করা। জনগণের অর্ধেক অংশ নারী আর এসব চ্যালেঞ্জ পূরণে যদি নারীকে সমপৃক্ত ও সক্ষম করতে চাই তাহলে নারীর হাতে যে হাতিয়ার তুলে দিতে হবে তা হলো নারী উন্নয়ন নীতি। সে কারণেই সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে প্রয়োজন নারীদের সচেতন করার পাশাপাশি পুরুষদের সহযোগিতা এবং মানসিকতার পরিবর্তন। নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নসহ জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার, রাজনৈতিক সংগঠন, মন্ত্রী পরিষদ, প্রশাসন, সামাজিক সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নসহ সকল পর্যায়ে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবিতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে প্রচারণা আরো প্রসারিত করা দরকার।
নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ এখন অভূতপূর্ব মাত্রা পেয়েছে। বখাটেরা এখন প্রতিবাদকারীদের উপরও চড়াও হচ্ছে। এ বছরে ইভটিজিংধমর্ী নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে খুন হয়েছেন অন্তত চারজন। নাটোরের স্কুল শিক্ষক মিজানুর রহমান, ফরিদপুরের মধুখালীর চাঁপারাণী ভৌমিক, নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে বন্ধন মজুমদার প্রমুখকে হত্যা করেছে বখাটেরা। কেউ মাকে রক্ষা করতে যেয়ে, কেউ বোনকে রক্ষা করতে যেয়ে আবার কেউবা শুধু অন্যায়কে মোকাবেলা করতে যেয়ে মারা গেছেন। সরাসরি খুন হলেও এইরূপ মৃতু্যকে দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে আসামী পক্ষদের মাঝে। অতীতে নারী নির্যাতনে কেবল নারী মারা যেত, এখন আমরা দেখছি, নির্যাতিতদের সঙ্গে যারা সংহতি জানাচ্ছে, প্রতিবাদ করছে তারাও সন্ত্রাসীদের কোপানলে পড়ছে। আমরা মনে করি, সংগ্রামি এই মানুষদের জাতীয় বীরের মর্যাদায় তরুণ সমাজের কাছে তুলে ধরা দরকার। একে শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখার মানসিকতা বদলে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে না এড়িয়ে নির্যাতনকারীকে একজন অপরাধী বলে উপলব্ধিতে আনতে হবে। নারীর জন্য নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়তে আমাদের প্রত্যেককে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক সারিতে দাঁড়িয়ে নির্যাতনকে এখনই 'না' বলতে হবে।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে এখনি জাতীয়ভাবে নারী উন্নয়ন নীতি গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। চলতি সময়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নেমে আমরা সবাই এক ধরনের জাতীয় ঐকমত্য দেখছি। এই ঐকমত্যকে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের কাজে লাগানো গেলে ধীরে ধীরে নির্যাতক মনস্তত্ত্ব সমাজ থেকে নিমর্ূল হবে বলে আমরা মনে করি। কারণ নারীকে 'দুর্বল', 'অধিকারহীন', 'অশিক্ষিত', 'ক্ষমতাহীন' ইত্যাদি ভাবা এবং ইত্যাদি রূপে দেখার মাধ্যমেই সমাজে পুরুষদের মাঝে একধরনের আধিপত্যবাদী মানসিকতা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। যার চূড়ান্তরূপ আমরা এখন দেখছি। এটা একদিনে হয়নি এবং একদিনে তা বিদায়ও হবে না। রাষ্ট্র যখন সমাজে নারীকে 'সমমর্যাদা', 'সমঅধিকার' এবং 'সমক্ষমতা'র অধিকারী মানুষ হিসেবে কার্যকর স্বীকৃতি দেবে এবং পুরুষেরা যখন তা দেখতে অভ্যস্ত হবে তখনি কেবল নির্যাতনের ধারাবাহিকতা কমে আসবে বলে আমরা মনে করি। সুতরাং আমাদের উচিত হবে অবিলম্বে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা। এটা হবে প্রকৃত অর্থে নারী অধিকার কায়েমের শুরুর বিন্দু। একটি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক উদ্যোগই পারে মানুষের মানসিক গঠন ও মননগত পরিবর্তন করতে। আর এই সংগ্রাম চলতি সময়ের মূল রাজনৈতিক সংগ্রামের চেয়ে ভিন্নতর কিছু হবে না। জাতীয়ভাবে যারা নারী অধিকারের বিরুদ্ধে, প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মূলত: তারাই একাত্তরের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। ফলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলন, নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের সংগ্রাম এবং বখাটেপনার সর্বাত্মক প্রতিরোধ একই লড়াইয়ের তিনটি ভিন্ন কর্তব্য মাত্র। বিজয়ের মাসকে সামনে রেখে শোষণমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে আজকে আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ বাস্তবায়ন, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে পারিবারিক আইন প্রণয়ন, জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকান্ডে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার, রাজনৈতিক সংগঠন, মন্ত্রিপরিষদ, প্রশাসন, সামাজিক সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নসহ সকল পর্যায়ে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার নিশ্চিত করা, নারীর জন্য সমকাজে সমমজুরি, মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ উপযুক্ত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং নারীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সম্পর্কিত প্রচলিত আইন সংশোধন এবং নতুন আইন প্রণয়ন, ফতোয়া ও যৌন হয়রানি বিষয়ক হাইকোর্ট-এর রায়ের ভিত্তিতে শিক্ষাঙ্গন ও কর্মক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা।
============================
জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ শিরীন আখতার
রাজনীতিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.