অর্থনীতি- ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয় by ড. আর এম দেবনাথ

ডিসেম্বর ১৩ তারিখের একটি দৈনিকে দেখলাম একটি বেসরকারি ব্যাংক ২০০৯ সালে ৪০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। এই অবলোপনের বিপরীতে সংশিস্নষ্ট ব্যাংকটি আদায় করেছে মাত্র ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ২০০৯ সালের অবলোপনকৃত ঋণসহ ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত অবলোপনকৃত ঋণের অংক দাঁড়িয়েছে ২১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
অসন্তোষ প্রকাশ করার আরো কয়েকটি কারণের কথা সংশিস্নষ্ট প্রতিবেদনটিতে উলেস্নখ করা হয়েছে। আমি সে সব কারণের দিকে যাব না। আমি ঋণ অবলোপন এবং সুদ মাফ ইত্যাদি বিষয়েই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ করতে চাই। দেখা যাচ্ছে একটি বেসরকারি ব্যাংক এক বছরেই ৪০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। এই হারে অবলোপন হচ্ছে ধরে নিলে ৩০টি বেসরকারি ব্যাংকের সর্বমোট অবলোপন হবে ১২০০ কোটি টাকা এবং তা এক বছরে। প্রকৃতপক্ষে ২০০৯ সালে সকল বেসরকারি ব্যাংক এবং সকল সরকারি ব্যাংক মিলে কত টাকার ঋণ অবলোপন করেছে তার তথ্য আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই। সর্বশেষ এই তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে পেতে অনেক সময় লাগবে। তবে একটি বেসরকারি ব্যাংকের যে তথ্য এখানে উলেস্নখ করেছি তা সমস্যার আকার বুঝতে যথেষ্ট।
একথা অনেকেই হয়ত জানেন না যে ব্যাংকগুলো নিয়মিতভাবে 'খারাপ ঋণ'কে অবলোপন করে। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম। একটি ঋণের টাকা ফেরত না এলে প্রথমে ঋণটি 'সাব স্ট্যান্ডার্ড' হয়। তারপর হয় 'ডাউটফুল' এবং সবশেষে হয় 'ব্যাড এন্ড লস'। সেটের ক্যাটাগরিতে ঢুকলে ব্যাংকগুলোকে তা অবলোপন বা 'রাইট অফ' করতে হয় এবং এর বিপরীতে পুরো 'প্রভিশন' রাখতে হয় মুনাফা থেকে। এতে মুনাফার পরিমাণ কমে। অবলোপন হলে ঐ টাকা আদায়ের জন্য মামলা চালিয়ে যেতে হয়। এই হচ্ছে অবলোপনের ঘটনা। অবলোপন মানে ঠকার দাবি ছেড়ে দেয়া নয়। তবে অবলোপনকৃত ঋণের টাকা মামলা করে ব্যাংক ফেরত পায় বা পাচ্ছে এমন ঘটনা বিরল। অবলোপনকৃত ঋণের টাকা শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশে গচ্চাই। কারণ এ সংক্রান্ত মামলা আদালতে ঝুলছে লাখে লাখে।
অবলোপন বা 'রাইট অফ' এমনিতেই শুরু হয়ে যায় না। এর কতগুলো স্তর আছে। প্রথমে একটি ঋণ খারাপ হয়। ঋণগ্রহীতা সময়মত ঋণের টাকা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে দেন না। না দিয়ে গ্রহীতা ঋণখেলাপি হন। তিনি তখন নানা অজুহাতে ব্যাংকে হাজির হন সুদ মাফ করাতে। একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক একজন ঋণগ্রহীতা ২০০০ সালে ৫ কোটি টাকার একটা ঋণ নিয়েছেন। দুই বছর পর থেকেই তিনি ঋণের টাকা আর নিয়মিত পরিশোধ করছেন না। কারণ হাজার হাজার। সুদে-আসলে সেই টাকা ১৫ কোটিতে দাঁড়াল। আসলের ওপর সুদ দাঁড়াল ১০ কোটি। ধরা যাক এর মধ্যে তিন কোটি টাকার সুদ হিসাবে নেয়া হয়েছে অর্থাৎ এর একাউন্টিং হয়েছে। একে বলা হয় 'আরোপিত' সুদ। আর বাকি ৭ কোটি টাকার সুদ হচ্ছে 'অনারোপিত' অর্থাৎ এই সুদের টাকা ব্যাংক তার লাভের হিসাবে নেয়নি। এবার আসল সুদ মওকুফের আবেদন। গ্রাহক বললেন, অনারোপিত সুদ মওকুফ করুন। ব্যাংক তখন দেখল ভদ্রলোকের জামানত পর্যাপ্ত আছে কী না। দেখা গেল সেটা নেই। যে জামানত বা সিকিউরিটি আছে তার দাম এক কোটি টাকাও হবে না। তার ওপর আবার আসছে তদবিরের চাপ। ব্যাংক তখন ১০০ ভাগ অনারোপিত সুদ মওকুফ করে ঋণটি রিসিডিউলিং করে দিল_ যাকে বলে পুন:তফসিল। ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেয়া হল। আবার ভদ্রলোক টাকা দিতে ব্যর্থ হল। আবার পুনঃতফসিল করা হল। একবার, দু'বার, তিনবারঃ চলল এই প্রক্রিয়া। সুদ মওকুফ হচ্ছে। একপর্যায়ে গিয়ে যখন আর এই প্রক্রিয়া চলল না তখন ঋণটি হল 'ব্যাড এ্যান্ড লস' অর্থাৎ কু-ঋণ। এখানে আসলেই এই ঋণটি করতে হবে অবলোপন বা 'রাইট অফ'। মামলা হবে কোর্টে। ঋণগ্রাহক আদালতে যাবেন। করবেন রিট। মামলা চলবে অনন্তকাল। অন্যদিকে ব্যাংক মামলা করবে অর্থঋণ আদালতে। সেখানে রায় পাওয়া যাবে ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি বিক্রি করার। কিন্তু টেন্ডারের সময় কোন ক্রেতা পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলে সম্পত্তির মূল্য হবে ঋণের টাকার এক-চতুর্থাংশ অথবা আরো আরো কম। অতএব? অতএব ব্যাংকের টাকা যাবে গচ্চা।
এই যে এত বড় করে সুদ মওকুফ এবং অবলোপনের প্রক্রিয়াটা বর্ণনা করলাম তার কারণ কী? কারণ আর কিছুই না, এটা বোঝানো যে সুদ মওকুফ করানো এবং অবলোপন করানোটা একশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের কাছে একটা বড় ব্যবসা হিসাবে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক থেকে ব্যবসার নামে ঋণ নেয়া, সেই ব্যবসাকে রুগ্ন দেখানো, তারপর সুদ মওকুফ করানো, তারপর ঋণকে অবলোপন করানো এই প্রক্রিয়ায় একশ্রেণীর ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য লোক, প্রভাবশালী লোক, রাজনীতিবিদ, বড় বড় আমলা, সামরিক-বেসামরিক লোক কোটি কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট করে নিচ্ছে। লোকে বলে শেয়ারের ব্যবসা ভাল ব্যবসা। দিনে দিনে টাকা দ্বিগুণ হয়। জমির ব্যবসা ভাল ব্যবসা। এর দাম বাড়ে। ফ্ল্যাটের দাম বাড়ে সোনার দাম। এগুলো এখন বড় ব্যবসার জায়গা। কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সে টাকা ফেরত না দেয়া, ঋণ মওকুফ করা, ঋণের টাকা অবলোপন করাটাও এখন এক বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এবং এসব হচ্ছে নিয়ম-নীতির অধীনে। বেআইনী কিছু নয়। নিয়মের মধ্যে ফেলেই এই ব্যবসাটি চলছে। সংশিস্নষ্ট ব্যাংকার, ব্যাংকের মালিক, মালিকের প্রতিনিধি, সিবিএ নেতা, ব্যাংক-ফড়িয়া-দালালরা কামাই করে নিচ্ছে শত-শত কোটি টাকা। প্রতিটি ব্যাংক প্রতিবছর ডজন ডজন কোটি টাকা সুদ মওকুফ করছে। কোটি কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের হিসাব নিলে ঐ টাকার পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত এই পাঁচ বছরের মধ্যেই সমস্ত ব্যাংক মিলে ১৫৩০০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে এবং এসব টাকার বিপরীতে হাজার হাজার মামলা আদালতে ঝুলছে। পাঁচ বছরে সুদ মওকুফ হয়েছে কত? তার হিসাব পাওয়া খুবই কঠিন।
এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলো বছর বছর হারাচ্ছে। সুদ মওকুফ, ঋণ অবলোপন, সুদ রেয়াত ইত্যাদি খাতে, এর জন্য দায়ী কারা? কারো কী বিচার-আচার হয়েছে? মনে হয় না। দ্বিতীয় প্রশ্ন এই মওকুফের সুবিধা, ঋণ অবলোপনের সুবিধা কারা পাচ্ছে? এরা কী সমাজের গরীব শ্রেণীর লোক, এরা কী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক, এরা কী কৃষক বা সাধারণ মানুষ? না এরা কেউ এই শ্রেণীর লোক নন। যারা ব্যাংকের টাকা নানাভাবে মারছে, অতীতে মেরেছে, বর্তমানেও মারছে তারা সবাই প্রভাবশালী লোক। এদেরই পাওয়া যায় বড় বড় অর্থাৎ 'লং টকে'। এই সমস্যার সমাধান কী? বর্তমানে অবস্থা এমনি হয়েছে যে কেউ যদি ব্যাংকে আসল টাকাটাই ফেরত দেয় তাহলে তিনিই হচ্ছেন ব্যাংকের প্রথম শ্রেণীর কাস্টমার। সুদের টাকা দিলে তো কথাই নেই।
এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী? মুক্তির অনেক পথ আছে। তবে মুক্তি চাই এই বোধটি সর্বাগ্রে জাগ্রত হতে হবে। যদি তা হয় তাহলে সর্বাগ্রে একটি কাজ করা যায়। রিসিডিউলিং-এর কাজটি আরো কঠিন করা দরকার। অর্থাৎ ঋণ পুন:তফসিলীকরণের সংখ্যা সীমিত করা দরকার। ব্যক্তিগতভাবে একজন আরেকজনকে টাকা দিলে যেমন মাফের প্রশ্ন কম, আদায় করাই মুখ্য, এমনি একটা পরিবেশ ব্যাংকগুলোতে সৃষ্টি করা দরকার। সর্বোপরি আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ' ঋণখেলাপ'-কে 'ক্রিমিনাল অফেন্স' হিসাবে বিবেচনা করা দরকার। ঋণ খেলাপের মামলা হওয়া উচিত 'দেউলিয়া আইনে'। এসব হলে ঋণ শৃঙ্খলা কিছুটা পুনরুদ্ধার হতে পারে এবং তা হওয়া উচিত। শত হোক ব্যাংকের টাকা সরকারের টাকা নয়। এসব টাকা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের সঞ্চয়ের টাকা। এর নয়-ছয় কোনভাবেই কাম্য নয়।
=========================
একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. আর এম দেবনাথ
অর্থনীতিবিদ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.