আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম-দর্শনের স্বরূপ' by ড. সৌমিত্র শেখর

বিশ শতকের সূচনাতে আমাদের সমাজে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও সর্ব ক্ষেত্রে তার বিস্তার ঘটে নি। এ সময় সাহিত্য রচনা ও প্রকাশের দিক থেকে যেমন, পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তেমনি সমপ্রদায়ের ঊধের্্ব চিন্তাকারী ব্যক্তিত্বের খোঁজ খুব কমই পাওয়া গেছে।

দেখা গেছে হিন্দু বা মুসলিম বা ব্রাহ্ম মতে চরম অবস্থানকারীরা পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন বা প্রকাশ করেছেন। সে কারণে সব ধর্মের লেখকদের একই পত্রিকার পাতায় একত্রীকরণ সম্ভব হয় নি তাঁদের পক্ষে। আবার কোনো কোনো পত্রিকা স্বীয় ধর্মমতের প্রাধান্য প্রদর্শনের জন্য অন্য ধর্মমতকে আক্রমণ বা তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে। এর ফলে সমাজে সমন্বয়ের পরিবর্তে আক্রমণাত্মক মানসিকতা ও রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
শাসক ইংরেজগোষ্ঠী এ ধরনের অবস্থাকে তাদের জন্য অহিতকর মনে করেনি। এ দেশীয়দের ধর্ম-বিষয়ে বহিরঙ্গীয়ভাবে অথবা ধর্মীয়-মনোগত চিন্তাচেতনায় হস্তক্ষেপ করা থেকে তারা প্রকাশ্যে বিরত ছিল। এ দেশীয়দের আন্তঃধর্মীয় কলহেও তারা বজায় রেখেছে নিরাপদ দূরত্ব। প্রাগ্রসর ও শিক্ষিত বঙ্গীয় সমাজের কর্ণধারগণও প্রথম দিকে সামপ্রদায়িক কলহ বা পক্ষপাত ইত্যাদি ব্যাপার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন বলে মনে হয় না। দেখা যায়, বঙ্গীয় সমাজে যাঁরা অসামপ্রদায়িক ও প্রাগ্রসর বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের সম্পাদিত পত্রিকার প্রকাশিত লেখাগুলোতে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মগোষ্ঠীর সংস্কারচিন্তা বা সে-সম্পর্কে ভাবনাই প্রকাশ পেয়েছে, অন্য ধর্মের বা বহুধর্মের নয়। অথবা ঐ সময় প্রকাশিত কোনো পত্রিকার সব সংখ্যার হিসেব ধরলে লেখকদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের লেখকই প্রায় সবাই, অন্য ধর্মের লেখক নেই বললেই চলে। অর্থাৎ লেখক-নির্বাচনে কর্তৃপক্ষ সমন্বয়বাদী দৃষ্টি প্রয়োগ করেন নি বা বলা চলে সেই অসামপ্রদায়িক চেতনা পুরাপুরি কাজ করে নি সেখানে। বাংলা প্রথম যুগের পত্রিকা 'সমাচার দর্পণ'-এর (১৮১৮) বিষয় ও ধর্মীয় পক্ষপাতহীনতা সম্পর্কে ব্রজেন্দ নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন:
"সমাচার দর্পণ' যে সে-যুগের শ্রেষ্ঠ সংবাদপত্র ছিল, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। দেশী ও বিলাতি সংবাদ, নানাবিষয়ক প্রবন্ধ, ইংরেজী ও বাংলা সাময়িক পত্রের সার সঙ্কলন, সামাজিক আচার-ব্যবহারের বর্ণনা প্রভৃতি জ্ঞাতব্য তথ্যে উহা পূর্ণ থাকিত এবং মিশনারী-চালিত হইলেও উহাতে পরধম্মর্ের কুৎসা অথবা খ্রীষ্টধম্মর্ের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে আলোচনা স্থান পাইতই না বলিলে অন্যায় হয় না।"১
গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'বাঙ্গাল গেজেটি' (১৮১৮) অথবা ঈশ্বরচন্দ গুপ্ত সম্পাদিত 'সম্বাদ প্রভাকর' (১৮৩১) ইত্যাদি পত্রিকাও নির্দিষ্ট সমপ্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত এবং অন্য সমপ্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করেছেন বলে জানা যায় না। তবে বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত 'সমাচার চন্দি কা' (১৮২২) রক্ষণশীল হিন্দুদের মত-প্রকাশক পত্রিকা হিসেবে প্রথম থেকেই পরিচিত হয়েছিল। এই পত্রিকার উদ্দেশ্যই ছিল ব্রাহ্মমতের বিরুদ্ধাচরণ। শুধু তাই নয়, তারা সরাসরি সতীদাহ নিবারণ এবং ইংরেজি শিক্ষা-বিস্তারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রক্ষণশীল ভূমিকা নিয়েছিলেন। ব্রজেন্দ নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন: 'গোঁড়া হিন্দু-সমপ্রদায়ের মুখপাত্র হিসাবে সমাচার চন্দি কার প্রাধান্য বিশেষ রূপে বাড়িয়াছিল।'২ তবে এই পত্রিকার ভূমিকা পরবর্তীকালে তিরস্কৃতও হয়েছিল। নির্দিষ্ট ধর্ম-মতের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করে অন্যের ধর্ম বা মতকে আক্রমণ করা হিংসাত্মক মনোভঙ্গির পরিচায়ক, সভ্যতা ও প্রগতিবিরুদ্ধ। এ ধরনের কাজে পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধর্ম-সমপ্রদায়ভুক্ত সম্পাদক এবং প্রকাশক জড়িয়েছিলেন। তাঁরা নিজ নিজ ধর্ম ও সমাজের পক্ষাবলম্বনের নামে অন্যের ধর্ম ও মতকে বিদ্রূপ এবং ক্ষেত্র-বিশেষে আঘাত করেছেন। হিন্দু-সম্পাদিত পত্রিকায় যেমন হিন্দুত্ব প্রচার ও রক্ষণশীলতা ধারণ করেছে তেমনি কিছু মুসলিম-সম্পাদিত পত্রিকায় নিজস্ব ধর্ম ও সমাজের পক্ষাবলম্বন করেছে অন্ধভাবে। মুসলিমদের অনেকেই বাংলা ভাষাকে নিজেদের ভাষাই মনে করেন নি। আনিসুজ্জামান লিখেছেন:
'আরবী-ফারসী-উদর্ুর সমাদর যে এঁদের কাছে ছিল না, তা নয়। উদর্ুকে কেউ কেউ মাতৃভাষার তুল্য করতে চেয়েছিলেন, জাতীয় ভাষায় মর্যাদা অনেকে দিতে চান আরবীকে। ফারসী সাহিত্য দীর্ঘকাল ধরে আমাদের সাময়িকপত্রের আলোচ্য বিষয়ে একাধিপত্য করে। পত্রিকার নামকরণের জন্যে আরবী-ফারসী ভাষার আশ্রয় নেওয়া সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়।'৩
মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন সম্পাদিত 'আখবারে এসলামীয়া' (১৮৮৪) বা মো. রেয়াজুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত 'ইসলাম প্রচারক' (১৮৯১) ইত্যাদি পত্রিকায় হিন্দু লেখক নেই। অন্য দিকে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত 'সবুজপত্র' (১৯১৪) বা চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত 'নারায়ণ' (১৯১৪) পত্রিকার মত গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘ দিন প্রকাশিত পত্রিকায় সব মিলিয়ে মুসলিম লেখকের সংখ্যা ছয়ের বেশি নয়।
সে দিক থেকে মোজাম্মেল হক সম্পাদিত মাসিক 'মোস্লেম ভারত' (১৯২০) সাময়িকপত্র ছিল ব্যতিক্রম। এই পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক উভয়েই ছিলেন মুসলিম, মুসলিম সমপ্রদায়ের প্রতি তাঁদের আন্তরিক দরদও ছিল। কিন্তু পত্রিকাটিকে তাঁরা ইসলাম-প্রচারের মুখপত্র করেন নি বা এর লেখককুল নির্বাচিত হয় নি শুধুই মুসলিম সমপ্রদায় থেকে। 'মোস্লেম ভারত'-এ হিন্দু-মুসলিম মিলন-সাধনা অর্থাৎ সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকার নামকরণেও আরবি ও বঙ্গ-অভিধানভুক্ত শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে। পত্রিকার সব সংখ্যার শিরোনাম-পৃষ্ঠায়ই মুদ্রিত হয়েছে রবীন্দ নাথ ঠাকুরের এই বাণী: 'মানব-সংসারে জ্ঞানালোকের দিয়ালি-উৎসব চলিতেছে। প্রত্যেক জাতি আপনার আলোটিকে বড় করিয়া জ্বালাইলে তবে সকলে মিলিয়া এই উৎসব সমাধা হইবে।'৪ এ পত্রিকার বিষয়-বিশেস্ন্লষণ করলে বিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলা সাময়িকপত্রে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ সাহিত্য ও দর্শনচর্চার স্বরূপ উঠে আসে। সৃষ্টিশীল রচনার পাশাপাশি ভাষা-সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি-সমাজচিন্তা এই পত্রিকায় গুরুত্ব পেয়েছে। বাদ যায় নি মুসলিম ধর্ম-দর্শনচিন্তাও। যে-কোনো ধর্ম-দর্শনচিন্তার ক্ষেত্রে যেমন একদেশদর্শী আলোচনা হয়ে থাকে এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতীয়মান করতে আলোচকগণের প্রায় জীবনপাতের উপক্রম হয়, এই পত্রিকায় তেমনটি দেখা যায় না। বরং এই পত্রিকায় মুসলিম ধর্ম-দর্শনচিন্তা সমন্বয়ের পথ-সন্ধান করেছে। যে সমন্বয় ওই কালে পরাধীন ভারতে সমগ্র জাতির জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। এ কারণে 'মোস্লেম ভারত'-এ প্রকাশিত মুসলিম ধর্ম-দর্শনচিন্তা বিশেষভাবে আলোচনার বিষয়।
সুফিবাদ মুসলিম ধর্ম-দর্শনভুক্ত। পত্রিকার ১ম বর্ষ ১ম খণ্ড ১ম সংখ্যার (বৈশাখ ১৩২৭) প্রথম প্রবন্ধেই সুফিবাদী ধর্মদর্শনের ব্যাখ্যা আছে। অধ্যাপক অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ রচিত 'ফকীরের ধমর্্ম' শিরোনামের এই প্রবন্ধে প্রথমেই ধর্ম শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অন্বেষণ করা হয়েছে। লেখক উলেস্নখ করেছেন: ভাগবতের একজন বিশিষ্ট টীকাকারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী 'ধর্ম' শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিমাপ অর্থাৎ যে ধর (ব্রহ্ম)-বস্তুকে যা দিয়ে মাপা যায় তাই ধর্ম। দুধ ও কাপড় মাপতে যেমন বাটি ও গজের প্রয়োজন, তেমনি ধর বস্তুকে মাপতে যা প্রয়োজন তা হল ধর্ম। বিজয়ধ্বজের মতে, ধর্মের স্বরূপ ব্যক্তিবিশেষে ভিন্নরূপে পরিগণিত হয়। ধর্মানুষ্ঠান পালন করতে হলে সবার আগে ত্যাগের মাধ্যমে চরিত্র গঠন প্রয়োজন। কারণ ফকিরি ধর্ম ত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত। লেখক উলেস্নখ করেছেন, যিনি সংসারের সুখ দুনিয়ার সম্পদ এবং দেহের সুখকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নীল পশমি কাপড় পরিধান করেন তিনি-ই ফকির। ফকিরদের বাণী হচ্ছে 'অল ফকরু ফখরী'_ দারিদ্র্যই আমার গৌরব, ত্যাগকেই আমি ভালোবাসি। তাঁদের মতে, দারিদ্র্যকে ভালোবাসলে মানুষকে ভালোবাসা যায় এবং সৃষ্টিকর্তায় ডুবে থাকা যায়। তাই ফকিরেরা দারিদ্র্যকে ভালোবাসেন। ফকিরদের সৃষ্টিকর্তার কাছে একমাত্র প্রার্থনা_ আমাকে তোমার ভক্তি করতে দাও_ প্রাণ ভরে তোমায় ডাকতে দাও। আমি যে দারিদ্র্য পেয়েছি তা তো তোমার স্বর্গের এবং পূর্ণের। ধর্ম-প্রসঙ্গে দৃঢ়বিশ্বাসী সুফিরা মনে করেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহিরাবরণে মানুষ যতই উন্নত হউক না কেন ভক্তি ব্যতিরেকে সৃষ্টিকর্তার সুখলাভ অসম্ভব এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে যে ব্যবধান ভক্তিই তার একমাত্র সেতু। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে সিরিয়ার 'জাহীদ আবু হাশীম' জগতের সামনে নিজেকে সবার প্রথমে 'সুফি' ও পুণ্যনামে ভূষিত করেন। তারপর অনেক সুফি এভাবে প্রেম মদিরা পান করে আত্মহারা হয়ে গেছেন। লক্ষ করার বিষয়, এখানে লেখক একটি সমন্বয়পন্থা অবলম্বন করেছেন বলে সুফিবাদকে ইসলাম ছাড়াও অন্য ধর্ম-দর্শনের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন এবং স্রষ্টা-প্রেমকে মদিরার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সুফিরা বিশ্বাস করেন ব্রহ্মের সাধনার জন্যই জীবের অস্তিত্ব। এই ভাবের সুফিসাধক এবং প্রাচীন সুফিসাধকদের মধ্যে 'ভাগ্যবতী রাবেয়ার' সাধনকাহিনি পড়লে ভক্তিহীনদের মধ্যেও ভক্তি জাগে। প্রাবন্ধিক উলেস্নখ করেছেন, সুফিদের বিশ্বাস:
১. জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক উৎসজাত এবং একদিন জীবাত্মা ও পরমাত্মা মিলিত হবেই, ২. ভগবদ্ভাবে বিশ্ব পরিপূর্ণ, ৩. একমাত্র তিনিই পূর্ণ দয়া, পূর্ণ সত্য, পূর্ণ সৌন্দর্য, ৪. প্রকৃতির সমগ্র সৌন্দর্য দর্পণে প্রতিবিম্বের ন্যায় সৃষ্টিকর্তা সর্্বদা দিব্যসুখ বিতরণ করছেন, ৫. একমাত্র ভক্তি দ্বারাই মানুষ স্রষ্টার সুখ উপভোগ করতে পারে, ৬. আত্মা ব্যতীত সবই নশ্বর।
প্রাবন্ধিক উলেস্নখ করেছেন, মৃতু্যর পূর্বে সুফিদের চারটি অবস্থা পার হতে হবে, অবস্থা চারটি ক. শরিয়ৎ খ. তরিকৎ গ. মরিফৎ ঘ. হকিকৎ। আধুনিক সুফিরা কোরআন মেনে চলেন। তাদের বহু নাম, পন্থা বা প্রস্থান আছে যেমন:
'সূফী -
আরিফ - জ্ঞাতা
সালিক - ভগবানের নিকট ভ্রমণকারী
তালিব - ভগবদন্বেষী
আশিকি সাদিক - ভগবানের একনিষ্ঠ ভক্ত
আহ্লে তস'উফ্ - সুংঃরপ
হাল - সুংঃরপ
তরীকৎ - ভগবৎপথের পথিক
মরীফৎ - দিব্যজ্ঞানী
হকীকৎ - সত্যদ্রষ্টা
অব্দ্ আবিদ্- শ্রীভগবানের দাস ইত্যাদি।'৫
প্রবন্ধে সুফিদের সমপ্রদায়গত পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, মূলে সুফিদের দুটি সমপ্রদায় ছিল, একটি 'হুলূলিয়হ', অপরটি 'ইত্তিহাদিয়হ'। প্রথম সমপ্রদায় ভগবৎ-প্রেরণায় সবকিছু মেনে চলে আর দ্বিতীয় সমপ্রদায় জিজ্ঞাসাসিক্ত, তারা বিশ্বাস করেন স্রষ্টা প্রত্যেক বিচক্ষণ ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এই দুইটি সমপ্রদায় হতে আরও পাঁচটি সমপ্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। রচনাটিতে বলা হয়েছে_
'এই দুইটি সমপ্রদায় হইতে নিম্নলিখিত পাঁচটি সমপ্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছে:- ১) ওয়াসিলিয়- বা ঈশ্বরযুক্ত, ২) অশাকীয় - বা ঈশ্বর-প্রেমিক, ৩) তল্ীনিয়- বা উপদিষ্ট, ৪) জকীয়- বা আন্তঃপ্রবিষ্ট, ৫) ওয়াহিদিয়- বা নির্জনতাপ্রিয়।'৬
এই প্রবন্ধে সাধারণ সুফিদের সুংঃরপ বলে অভিহিত করে তাদের পরিচিত তুলে ধরা হয়েছে। মহিউদ্দিন, হাফিজ, জালালউদ্দিন রুমি প্রমুখ কবির লেখায় সুফিবাদের স্পষ্ট ও সুষ্ঠু বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া গুলিসঁ্তা, বোসঁ্তা-তেও সুফিবাদের কল্যাণবাণীতে মুখরিত।
এই লেখার একটি প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়েছে পত্রিকার ১ম বর্ষ ১ম খণ্ড ৪র্থ সংখ্যায় (শ্রাবণ ১৩২৭)। শিরোনাম একই - 'ফকীরের ধমর্্ম'। রচয়িতা নিজের নাম গোপন করেছেন। শুধু লিখেছেন 'জনৈক ইস্লাম-ভক্ত'। এই লেখায় অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের লেখার কিছু বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে তার 'ইসলামসম্মত' উত্তর খোঁজা হয়েছে। যেমন, বিদ্যাভূষণ ইসলামের চার দরজার মধ্যে 'মারফৎ'কে তৃতীয় দরজা বলেছেন। ইসলাম-ভক্ত লিখেছেন, এটা চতুর্থ ও চূড়ান্ত দরজা হবে। বিদ্যাভূষণ লিখেছিলেন, আধুনাতন সুফিরা কোরআন অনুসরণ করেন। প্রশ্ন করা হয়েছে : 'তবে কি পূর্বতন সুফীরা কোর-আন্ মানিয়া চলিতেন না?'৭ বিদ্যাভূষনের লেখাটি যে খুবই মনোযোগ দিয়ে পাঠকেরা পড়েছিলেন এবং এ নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা ওই সমাজে হয়েছিল, এই প্রশ্নসমূহ থেকে সে প্রমাণ পাওয়া যায়। ধর্ম-দর্শনচিন্তায় এ ধরনের উদারতা প্রদর্শন ওই যুগে দেখা গেলেও এ যুগে আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। আর-একটি রচনা লিখে কোনো ধর্ম-দর্শন সংক্রান্ত লেখার প্রতিক্রিয়া প্রকাশের বদলে এ সমাজে রচয়িতার প্রতি বলপ্রয়োগের প্রবণতাই গেছে বেড়ে।
মোহাম্মদ বরকতুলস্ন্লাহ রচিত ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ 'ক্রুসেডের পরিণাম' প্রকাশিত হয় পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। এ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সরলভাষ্যে উলেস্ন্লখ করেছেন, জেরুজালেম বা বায়তুল মোকাদ্দাসের অধিকার নিয়ে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে দুশ বছরব্যাপী যে যুদ্ধ সংঘর্ষ চলেছিল তাই ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ। জেরুজালেমের পুণ্যভূমিতে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমান এই তিন ধর্মের সহাবস্থানের ফলে আরবি দার্শনিকগণের মনে উদিত হয় সর্বজনীন ধর্মবাদ। মূলত বিশ্বের সব ধর্মের মূল সুর সত্যের উপাসনা। ইচ্ছে করলে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানবই একই সত্যের উপাসক হতে পারে। এক সময়ে আরবের মুসলমানরা তাদের ধর্ম-মতের মাধ্যমে পৃথিবীর সব ধর্ম-মতের সামনে এক সমন্বয়ের বাণী এনেছিলেন। এই ধারণা ছিল সে সময় সত্যিই বিস্ময়কর। পৃথিবীর সব ধর্মেরই দুটো অঙ্গ আছে: সত্য ও রূপ । সত্য হচ্ছে ধর্মের প্রাণ, সত্য ছাড়া ধর্ম টিকতে পারে না। আর রূপ হল ধর্মের ভেতর থেকে ধর্মের আপনার প্রকাশ। যেমন আলস্ন্লাহয় নির্ভর ইসলাম ধর্মের সত্য আর তার রূপ হচ্ছে, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাতের মাধ্যমের খোদার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। মোহাম্মদ বরকতুলস্ন্লাহ উলেস্নখ করেছেন, সত্য সব ধর্মের এক, কেবল বিরোধ লৌকিক আচার নিয়ে। এই বিরোধের ফলে হিন্দুর মন্দির ভেঙে মুসলমান মসজিদ গড়ে, আবার মুসলমানের মসজিদ ভেঙে খ্রিষ্টান গির্জা গড়ে তোলে। আর দুর্বল ইহুদি সবার উপর ঘৃণা পোষণ করে। মূলত যারা নিজেদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে অপর ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের চেয়ে উৎকৃষ্ট মনে করে এবং ভাবে বিশ্ব নিয়ন্তার বাণী কেবল তাদের কিতাবে আছে, অন্যগুলো মানুষের তৈরি তারা নিজেদের বিচারশক্তির সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়। ধর্মের যা সত্য যা চিরন্তন সেই চিরন্তন-সত্য দেশ, কাল এবং অঞ্চল বিশেষে ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয় জাতিবিশেষের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ মানুষ তার মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ তাদের জ্ঞানের অভাবে তার বাণীকে দৈব বাণী মনে করে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ প্রাবন্ধিক বলেছেন:
'মহাত্মা যীশু যখন মর্ত্ত্যলোকে তাঁহার প্রভুর বাণী প্রচার করেন, তখন তিনি কখনই বলেন নাই যে, তিনি আলস্ন্লাহর বংশধর পুত্র; আলস্ন্লাহ্ তাঁহাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া পৃথিবীর উদ্ধারের নিমিত্ত মর্ত্ত্যধামে প্রেরণ করিয়াছেন। তিনি মানবের অবিমৃষ্যকারিতায় ব্যথিত হইয়া তাহাদের মুক্তির সন্ধান বলিতে প্রয়াস পাইয়াছেন মাত্র। কিন্তু তাঁহার ভক্তেরা তাঁহাকে নানাভাবে, নানামূর্ত্তিতে রূপান্তরিত করিয়াছে। দার্শনিকগণ (খৃষ্টান) আবার জ্ঞান ও যুক্তির দ্বারা নানা ছন্দে নানা কৌশলে তাহারই সমর্থনের চেষ্টা করিয়াছেন। সেন্ট পল, মথি, লুক ইত্যাদি ভক্তিমার্গের উপাসকগণ কতভাবেই না এই যীশুর সহিত তাঁহাদের মহাপিতার সম্বন্ধনির্ণয়ের প্রয়াস পাইয়াছেন। যাঁহারা যীশুকে স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন বা যাঁহারা যীশুর পারিবারিক ইতিহাস প্রত্যক্ষ-ভাবে জানিতে, তাঁহারা কিন্তু যীশুকে তাঁহাদের মহাপিতার আত্মজ বলিয়া স্বীকার করিতে কুণ্ঠাবোধ করিয়াছেন। পরন্তু তাঁহারা খোদার মানসপুত্ররূপে এক মহা আত্মার কল্পনা করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে যীশু এই মানসপুত্রের অবতার। এই মানসপুত্রই পরমপিতার প্রতিনিধিরূপে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করিয়াছেন, যীশুর জৈবদেহেও ইহারই আবির্ভাব হইয়াছে। এইরূপে অনেক কাল বিভিন্ন মতের বিবাদ-বৈষম্য চলিতে লাগিল। তার পর জ্ঞানমার্গের পথিক অর্থাৎ দার্শনিকগণ ইহার মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইলেন।'৮
এরপর বরকতুলস্নাহ দার্শনিক আলোচনায় ব্রতী হয়ে লিখেছেন, ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে নাইজ নামক স্থানে ঈশ্বর ও যিশুর সম্পর্ক নিয়ে এক মহতী সভার আয়োজন করা হয়। দার্শনিক এরিউস বলেন তোমরা যিশুর সাথে কিছুতেই পবিত্র পরম পিতার সাথে পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক স্থাপন করতে পার না। তাতে পিতার অসম্মান হয়। পরবতর্ী সময় যে যিশুকে দেখা যায় তা এথনিউসিউস কতর্ৃক সৃষ্ট যিশু। খ্রিষ্টীয় শাস্ত্রকারগণ যিশুকে পরমেশ্বরের স্বরূপ নির্ণয় করার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর মূলসত্য ধরে পৃথিবী, স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য এবং মৃতু্যর পর আত্মার কি গতি হয় ইত্যাদি বিষয়ে মত প্রকাশ করতে থাকে।
পরবতর্ী সময় খ্রিষ্টানরা বিজ্ঞানের সূত্রের সামঞ্জস্য রেখে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তারা প্লেটো ও পিথাগেরারাসের পাশ্চাত্যজ্ঞানের অনুরূপ করে সৌরজগৎ ও আত্মার ইতিহাস বর্ণনে প্রবৃত্ত হন। এর কয়েক শত বৎসর পর টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান নবচিন্তার উন্মেষ ঘটালে খ্রিষ্টীয় শাস্ত্রকারগণ কালবিলম্ব না করে এই অভিনব শাস্ত্রের সাথে নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রদান করে। এরপর কোপার্নিকাসের জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতও নিজস্ব করে নেয়। অথচ সূর্যকে কেন্দ করে পৃথিবী আবর্তন করে এই ব্যাখ্যা প্রদানের ফলে গ্যালিলিওকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ইউরোপের ধর্মসঙ্ঘের অত্যাচারের কাহিনির মত সহস্র নির্দোষ ব্যক্তির শোণিত ধারা অঙ্গে মেখে ইতিহাসের বুকে যে কলঙ্কের চিহ্নস্বরূপ দণ্ডায়মান রয়েছে যার অবসান ঘটে নিউটনের সৌরজগৎ সম্পর্কে সূত্র আবিষ্কারের পর। নিউটন সূত্র প্রদান করে (সূর্যকে কেন্দ করে সৌরজগতের সমস্ত কিছু আবর্তিত হয়) তখনই খ্রিষ্টানরা নীরব হয়ে যায়। কিন্তু এত কিছুর পরও যখন খ্রিষ্ট ধর্মের বহিরাবরণ দাঁড় করানো গেল না তখন জন্ম নিল 'প্রোটেস্ট্যানটিজম'। খ্রিষ্টধর্মের নানা দ্বন্দ্ব ও আবর্তনের আলোচনা করে বরকতুলস্নাহ উলেস্নখ করেছেন, এভাবে মুসলমানদের ধর্মের মধ্যেও নানা বিরোধ আছে কোরআনের মূল আয়াতের টীকা নিয়ে। অতএব সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মের বহিরাবরণের লঘুত্ব গুরুত্ব নির্ণয় হয়ে থাকে। আদি যুগে মানুষ যখন বন্য পশুর মত কেবল ইন্দি য় পরিতোষ সাধনের জন্য জীবনযাপন করত তখন মানুষের ভয় ছাড়া অভিভূত হওয়ার কারণ ছিল না। তখন থেকে কোনো বিঘ্ন ঘটলের কেবল সে যুগের মহাপুরুষের নিকট বা বিশ্বনিয়ন্ত্রার কাছে বিচার প্রার্থী হত। তখন মানুষের কাছে রুদ্ররূপের পাশাপাশি দণ্ডধারী রূপ মানুষের চোখে ধরা পরে। প্রেমগত রূপ ধরা পরে অনেক পরে; হযরত মুসার (গড়ংবং) সময় আভাস পাওয়া যায়। এরপর ইসার সময় পরিণতি। বুদ্ধ স্রষ্টার এই প্রেমময় রূপ বুঝতে না পেরে মানুষকে ভোগ হতে বিরত থাকতে বলে এবং বলে ভোগই পাপের মূল। ক্ষমার কোনো আভাস তিনি খুঁজে পান নি। হযরত মোহাম্মদ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে স্রষ্টার রুদ্র রূপের সাথে মধুরতা, ন্যায়দণ্ডের সাথে ক্ষমাশীলতা, সংহারমূর্তির সাথে নব নব সৃষ্টিলিপ্সার সংমিশ্রিত দেখিয়েছেন। আলস্ন্লাহর এমন পূর্ণ অভিব্যক্তির ধারণা এর পূর্বেকার কোনো ধর্মে দৃষ্ট হয় নি বলে বরকতুলস্নাহ মনে করেন। এটাকে তিনি বিশ্বধর্মের ক্রমবিকাশের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। আবার তিনি মনে করেন, এই সৃষ্টিকর্তাকে দণ্ডদাতা, ক্ষমাশীল ভাবাও এক ধরনের সসীমের মাপকাঠি। মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করে তাকে খুশি করতে চায়। আবার বিপদে মানত করে বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করতে চায়। এগুলোই হলো অসীমকে সসীমের মত করে দেখা, আর এটাই ধর্মের (ঐহড়স) রূপ। প্রাবন্ধিক এ-প্রসঙ্গে এবনে রোশদ-এর বক্তব্য স্মরণ করেছেন। রোশদ বলেছিলেন, আমি ধর্মকে গণ্ডির মধ্যে রাখতে চাই না। কেননা আমার আত্মার মধ্যে যার উপস্থিতি বিশ্বের অণুতে অণুতে তরঙ্গায়িত হচ্ছে তাকে গণ্ডির মধ্যে রাখার প্রয়োজন কী? তিনি ধর্মের আড়ম্বরতাকে অস্বীকার করেছেন, তাঁর ধর্ম-সম্পর্কে মত হল, মানুষের অন্তরের ভেতরে যিনি বিরাজ করছেন তাকে খুঁজতে কেন মানুষ পুরোহিত, পিরের শরণাপন্ন হবে বা মসজিদ, গির্জায় যাবে? তা হলে পরমপুরুষ বা আলস্নাহ সম্পর্কে জ্ঞানলাভের উপায় কী, এর উত্তরে রোশদ বলেছেন: দূরদর্শিতার প্রমাণ (ঢ়ৎড়ড়ভ ড়ভ ঢ়ৎড়ারফবহপব) এবং সৃষ্টির প্রমাণ (ঢ়ৎড়ড়ভ ড়ভ পৎবধঃরড়হ) উভয়যাত্রাই মানুষ ও অন্যান্য সত্তা দিয়ে শুরু হয়েছে, অখণ্ড জগৎ দিয়ে নয়।৯ ক্রুসেডে খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুসলমান এই ত্রিধারার সমন্বয়ে আরবীয় দার্শনিকগণ সেই মুক্তির সাড়া পেয়েছিলেন। এবনে রোশদ আরও বলেন_
"এই যে বিপুল ব্রহ্মাণ্ড দেখিতেছ, ইহা সেই বিশ্বস্রষ্টারই মূর্ত্ত বিকাশ। তিনি এই ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া রহিয়াছেন, তাঁহারই জীবনে জীবিত। এই যে আমাদের আত্মা ইহা তাঁহারই অংশ। অনন্ত আকাশ যেমন ক্ষুদ্র ঘটের ভিতর সসীম ঘটাকার ধারণ করে এবং ঘট ভাঙ্গিলেই যেমন ঘটাকাশও বাহিরের আকাশ সব এক হইয়া যায়, সেইরূপ মানবাত্মাও সীমানিবদ্ধ আল্লা বা আল্লার অংশ। দেহের বন্ধন কাটাইলেই বদ্ধ আত্মা ও নিত্য আত্মা সব একাকার হইয়া যায় (বেদান্ত মতও অনেকটা এইরূপ)। এই যে মিলন এই মিলনই আমাদের শেষ মিলন, মানব-জীবনের এই খানেই যবনিকা পতন। তারপর অন্য কিছু থাকিতে পারে না, পাপশূন্য ধমর্্ম অধমর্্ম সমস্তই ইহ-জীবনেই পর্য্যবসিত হয়, ইহ-জীবনই ইহার লীলাক্ষেত্র। সীমা ছাড়াইয়া যে অনন্তে মিশিয়া গেল তাহার আর সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য কি? সে ত তখন সকল ভোগ-বিচারের অতীত সেই আল্লাহরই অঙ্গীভূত_ তাঁহাতেই বিলীন।
স্বর্গের সুখ বা পার্থিব কোনও পুরস্কারের আশায় তুমি কার্য্য করিও না। যাহা কর্ত্তব্য ন্যায্য তাহা তুমি অবশ্য সম্পাদন করিবে, কেননা তাহা তোমার পক্ষে 'কর্ত্তব্য' ও 'সঙ্গত', তাহা না করাই তোমার অধমর্্ম। স্বর্গের আশায়, অনুগ্রহের আশায় যে ভজনা করে পরোপকার করে, সে কর্ত্তব্যের অসম্মান করে_ ধম্মর্ের অপব্যবহার করে; আমি বলি সে ভক্ত নয়, সে ধাম্মর্িক নয়; সে ব্যবসায়ী, ধম্মর্ের দাস।"১০
এই উদারনৈতিক ধর্ম-মতের কারণে এবনে রোশোদকে কর্ডোভার শাসনকর্তা মরক্কোতে নির্বাসিত করেন। প্রাবন্ধিক এর সমালোচনা করেন। তিনি অবশ্য এ-ও বলেন, ক্রুসেডের সময় ইউরোপ ও এশিয়ার দীর্ঘকালব্যাপী সংঘর্ষের ফাঁকে ফাঁকে মিলন ঘটে, তাকে আরবদের জ্ঞান-গবেষণা এমনকি এরিস্টটলের যাবতীয় গ্রন্থ আরবদের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে মুক্তির বিজয় আসে। তখন তরুণ সমাজ ধর্মকে ত্যাগ করতে থাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সজ্জিত হয়ে। তখন ধর্মযাজকরা এরিস্টটলের শিক্ষাকে বাইবেলের অনুরূপ বলে প্রচার করতে থাকে। ফলে এরিস্টটলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও যুক্তিমত ইউরোপে ধর্মরূপে প্রচার হয়। এই মহারত্নভাণ্ডার ইউরোপের কাছে উদঘাটিত করার জন্য তারা আরবদের কাছে ঋণী। ক্রুসেডে ইউরোপ আরবদিগের কাছ থেকে এই মহাদান পেয়েছিল। আরব ও তুর্কিবাহিনী যখন বসফয়রাসের সিংহদ্বারে আঘাত হানে তখন ইউরোপের রাজনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব হয়েছিল ঠিকই কিন্তু অন্যদিকে তারা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বারা ইউরোপের সত্যিকারের স্বাধীনতার মুখ খুলে যায়। তারা ছড়িয়ে পরে জ্ঞান-অন্বেষণে বিশ্বময়। এটাই রেনেসাঁস। এই রেনেসাঁসের ফলেই ক্রিষ্টানদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, এ থেকেই জন্ম লাভ করে প্রোটেস্ট্যান্টিজম্ । প্রাবন্ধিক এ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের পারস্পরিক ধর্মদর্শন ও ঐতিহাসিক বিশেষ সম্পর্কের পরিচয় অত্রন্ত সরল ভাষায় প্রদান করেছেন। এই জাতীয় আন্তঃধর্মীয় সমপ্রীতির দিকদর্শন মুসলিম ধর্ম-দর্শন আলোচনার প্রসঙ্গেই করেছেন মোহাম্মদ বরকতুলস্নাহ।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা বিশ্বব্যাপী সবাইকে যে আকৃষ্ট করেছিল সে-সূত্রেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে এবং এখনো অব্যাহতভাবে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে_ তার প্রমাণ মোহাম্মদ কে চাঁদ রচিত 'ইসলামী দর্শনশাস্ত্রে পরমাণুতত্ত্ব' প্রবন্ধ। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় 'মোস্লেম ভারতে'র ১ম বর্ষ ১ম খণ্ড ১ম সংখ্যায়। এখানে পরমাণুর তাত্তি্বক ধারণা যে ইসলাম দর্শনশাস্ত্রে আছে সে কথা ব্যক্ত। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, আধুনিক পাশ্চাত্যদর্শনে পরমাণুবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে লুক্রেশিয়া, ডিমোক্রিটস প্রভৃতি পণ্ডিতদের নাম পাওয়া যায়। হিন্দুদের মধ্যে বৈশেষিক দর্শন প্রণেতা কণাদ মুনির গ্রন্থে পরমাণুবাদের আলোচনা পাওয়া যায়। আধুনিক দার্শনিকদের মধ্যে লাইবনিজ ও লোটজাকেই বিখ্যাত পরমাণুতত্ত্ববিদ ঈশ্বরের কোন সম্বন্ধই রাখেন নি। তাঁরা মনে করেন এই বিশ্ব পরমাণুর সমষ্টিমাত্র। পরমাণু আপনা হতে উদ্ভূত হয়ে সমষ্টি আকারে সৌরজগৎ প্রভৃতি উৎপাদন করছে। কিন্তু মুসলমান পণ্ডিতদের পরমাণুতত্ত্বের আলোচনা মানুষের কাছে অজ্ঞাত। মুসলিম পরমাণুতত্ত্ববিদরা বিশ্বসৃষ্টির ক্ষেত্রে একক পরমাণুকেই দায়ী করেন নি, ঈশ্বরের অবদানের কথাও বলেছেন। মুসলিম পণ্ডিত ও পাশ্চাত্য পরমাণু তত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক ম্যাকডোনাল্ডের উক্তির দীর্ঘ উদ্ধৃতি আছে এই প্রবন্ধে।
প্রাবন্ধিক উলেস্নখ করেছেন, লুক্রেশিয়া পরমাণুকে বারিবিন্দুর ন্যায় শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে পতনশীল আর লাইবনিজ পরমাণুকে স্বতঃপ্রকাশমান বলেছেন। মুসলমানরা যে নবম শতাব্দীতেই পরমাণু তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন তার উলেস্ন্লখযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। মতোওয়াজ্বেলা দার্শনিক অল নজ্জাম (৮৪৫ খ্রি.) , দার্শনিক প্রবর অলকেন্দি (৮৭০ খ্রি.), আবু হাশিম (৯৩৩ খ্রি.) প্রমুখ বিভিন্নভাবে পৃথিবীর গঠন নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এতে এক অর্থে তাঁদের পরমাণু বিষয়ক চিন্তাই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদেও মতের সারাংশ হল, পরমাণু এক ধরনের 'পদার্থ'। এর মূল প্রকৃতিগত গুণ স্বরূপ স্বতঃই স্থান পূরণ করার ক্ষমতা ধারণ করে। পরমাণুগুলো ঘন আকারে বিশিষ্ট এবং যেগুলো এক রকমের। তাদের প্রভেদ হল প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট অংশ দখল করে। প্রবন্ধে মৈমোনিয়াদ (১১৩৫_১২০৪)-এর অভিমত থেকে সরল করে উলেস্নখ করা হয়েছে:
"যে জগতপ্রপঞ্চের আল্লাই একমাত্র স্বাধীন সৃষ্টিকর্ত্তা, সেই নিখিল ব্রহ্মাণ্ড অবিভাজ্য পদার্থ বা পরমাণু ও তদীয় উপলক্ষণ (আগন্তুক ধমর্্ম)-গুলির দ্বারা রচিত। এই পদার্থগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে ধরিলে সেগুলি কেবল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুমাত্র। তাহাদের আকার বিস্তৃতি বা পরিমাণ নাই বলিয়া ইন্দি য়াগোচর (বা অতীন্দি য়)। তাহাদের আপন আপন 'হায়য়জ' বা স্বাভাবিক অবস্থিতিস্থল আছে বটে, কিন্তু তাহা 'মকানে'র তুলনায় বৈসাদৃশ্য নিবন্ধন পরিমাণ বা স্থানসম্পর্কীয় (ংঢ়ধঃরধষ) আকারগত নহে। অপরিমেয়রূপে সূক্ষ্ম বা অতি ক্ষুদ্র পরমাণুগুলি একত্র সতূপীকৃত হইয়া ত্রি-মিত (ঃৎর-ফরসবহংরড়হধষ) 'মকান' অধিকার করতঃ স্থানতঃ-প্রসৃত জড়পদার্থসমূহে পরিণত হয়।"১১
বলা হয়েছে, স্রষ্টা একের পর এক যতগুলো ইচ্ছে জগৎ সৃষ্টি করেন এবং এক সময় জগৎ-সৃজন থেকে ক্ষান্ত হয়ে 'কিছু-না' (হড়ঃযরহম) সৃষ্টি করেন। এটা এক রকম পরমাণুবাদমূলক উপদেশ। তাই একে নৈমিত্তিকদের (ড়পপধংরড়হধষরংস) পূর্ব-সূচনা বলা চলে। কেননা, বলা হয়েছে, ব্যক্তির মধ্যে প্রথম লেখার ইচ্ছা, লেখাপড়ার ক্ষমতা, হাতের গতিশীলতা এবং সর্বশেষে এদের সঙ্গে সমকালীন ক্রিয়া লেখনীর গতি ইত্যাদি উৎপাদন করেন সৃষ্টিকর্তা। এক্ষেত্রে প্রত্যেক বিষয় অন্যটি হতে স্বাধীন তবে, কেবল আলস্ন্লাহর ইচ্ছাতেই ধারাবাহিক ক্রিয়ার বিভিন্ন অবস্থানগুলো উদ্ভূত হয়েছে। আমরা দৃশ্যত এমন কাজের মিলন দেখি। কেবল দৃশ্যত স্থান-কালেই একটি স্বতন্ত্র মিলনকারী ও ঐক্যভাবে কার্যকরী জগত রয়েছে। জগত ও মানব জীবনে একটি দৈববাণী সম্বন্ধ আছে আলস্ন্লাহ কোনো শক্তি দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন একে আশ্বরীয়া পরমাণু বা কালামভুক্ত পরমাণু তত্ত্ব বলে। লক্ষ করার বিষয়, এখানে মুসলিম দার্শনিকদের নামের বানান অনেক বেশি আরবি ভাষার মূলানুগ। শুধু তাই নয়, প্রায় শত বর্ষ আগেই কী অপূর্ব দক্ষতায় ও আন্তরিকতায় বাংলা ভাষায় মুসলিম দর্শনচর্চা আরম্ভ হয়, তা দর্শনচর্চার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।
পত্রিকার ১ম বর্ষ ১ম খণ্ড ৪র্থ সংখ্যায় (শ্রাবণ ১৩২৭) প্রকাশিত 'খাজা' রচিত 'ঈদুজ্জোহা' মূলত উক্ত ধর্মানুষ্ঠানের মাহাত্ম্যব্যঞ্জনামূলক প্রবন্ধ। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, মুসলমানদের জন্য বছরান্তে আসে ঈদুজ্জোহা, মহান ত্যাগ ও বিসর্জনের দৃষ্টান্ত সামনে নিয়ে। মানব ইতিহাসে সেই সুদূর অতীতে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মুসলমানদের নবি হযরত ইবরাহিম। আলস্ন্লাহতায়ালা হযরত ইবরাহিম ও বিবি হাজেরার ঘরে অনিন্দ্যসুন্দর পুত্র দিলেন হযরত ইসমাইলকে। তাঁকে কোরবানি দেওয়া নিয়ে মানব ইতিহাসে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। সেই থেকে সামর্থ্যবান মুসলমানরা মহান আলস্ন্লাহর উদ্দেশ্য পশু কোরবানি করে এবং কিছু অংশ দারিদ্র প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের মধ্যে ভাগ করে দেন। ঈদুজ্জোহার শিক্ষা হচ্ছে সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য, আলস্ন্লাহর জন্য জীবনের সমস্ত উৎসর্গ করা। ঈদের প্রকৃত আনন্দ হচ্ছে উৎসর্গ ও বিসর্জন। ঈদের নামাজে মুসলমানদের শিক্ষা ও প্রার্থনা হওয়া উচিৎ সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে দাঁড়াতে পাবার ক্ষমতা আর মহান আলস্ন্লাহতায়ালার নামে সব কিছু বিসর্জন দেওয়ার সাহস; তুচ্ছ পশু জবাই নয়। যে-সময় পশু কোরবানির চেয়ে মানুষের অন্যায়বোধ বা স্বার্থবুদ্ধি ত্যাগের বক্তব্য 'মোস্লেম ভারতে' প্রকাশিত হয়, সে-সময়ে ধর্মের রক্ষণশীল ব্যাখ্যার চেয়ে উদারপন্থী ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন অনেকে। এতে একটি সমন্বয়বাদী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রসঙ্গক্রমে কাজী নজরুল ইসলামের এ-জাতীয় একটি কবিতার উলেস্নখ করা চলে, যে কবিতায় তিনি বলেছেন, দেশের জন্য মৃত্যুও এক অর্থে কোরবানি। তিনি পশু কোরবানির চেয়ে নিজের জীবন দিয়ে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন সফল করার জন্য আহ্বান করেছেন। কোরবানি এখানে প্রতীকী অর্থে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে লেখা 'কোরবানী' কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি এ-রকম:
"ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্য-গ্রহ' শক্তির উদ্বোধন!
আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,
'আজাদী' মেলে না পস্তানো'য়
দস্তা নয় সে সস্তা নয়!
হত্যা নয় কি মৃত্যুও? তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্
কাঁদে_ শক্তি-সুস্থ শোন্_
'এয় ইব্রাহীম্ আজ কোরবানী কর শ্রেষ্ঠ পুত্র ধন!'
ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্য-গ্রহ' শক্তির উদ্বোধন!"১২
নজরুলের কবিতার মর্মার্থের সঙ্গে প্রবন্ধে উলেস্নখকৃত বক্তব্যের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ধর্মের রক্ষণশীল ব্যাখ্যা থেকে বের হয়ে আসার এরকম চেষ্টা ওই সময় অনেকের মধ্যে লক্ষ করা গেছে।
'মোস্লেম ভারতে'র ১ম বর্ষ ২য় খণ্ড ৬ষ্ঠ সংখ্যা (চৈত্র ১৩২৭) শাহাদাৎ হোসেন লেখেন 'ইসলামের বিশেষত্ব' নামের প্রবন্ধ। এটি 'ওংষধসরপ জবারব'ি (পত্রিকা) থেকে কোনো লেখার ভাবানুবাদ। মূল লেখার নাম কোথাও উলেস্নখ করা হয় নি। প্রবন্ধের নামেই এর বিষয়ের পরিচয় আছে। এখানে ইসলাম ধর্মের বিশেষত্ব ও অন্যান্য ধর্ম থেকে এর স্বাতন্ত্র্য বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের চেষ্টা নেই। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ইসলামে মূলত সেই সব বিশ্বাসকে সমর্থন করে যা মানুষের প্রকৃতির গভীরে বা অন্তঃস্থলে গোপনভাবে বিরাজমান থাকে। ইসলামে স্বীকৃত, বিশ্বজগতের যা কিছু সৃষ্টি, এমনকি প্রতিটি ধুলিকণার পেছনেও আলস্ন্লাহ তায়ালার হাত আছে। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে_ মহান সৃষ্টিকর্তা আলস্ন্লাহ তায়ালার মহিমা-গাথা সমুদ্রের সমস্ত জল কালি হিসেবে নিলেও শেষ হবে না। ইসলামে আরো বলা হয়েছে পৃথিবীর সব কিছুর পেছনে (আলস্ন্লাহর) অদৃশ্য শক্তির হাত রযেছে এবং সবকিছু তার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। শুধু ইসলামের মত সমর্থন করলেই ইসলাম মানা হয় না। বাস্তবজীবনে কাজের মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে হবে। শুধুমাত্র ইসলামে বিশ্বাস বা কর্মকাণ্ডে প্রকাশ করলে হবে না। এই দুয়ের সমন্বয়ে জীবনের পাথেয় হিসেবে নিতে হবে। তবেই প্রবেশ করা যাবে জান্নাতে। কোরআনে বলা হয়েছে, যারা বিশ্বাসী এবং সৎকর্মী তাদের কাছে ঘোষণা কর যে, তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত আর তার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মন্থর গতির নদী। ইসলাম ইহকাল ও পরকাল বিচ্ছিন্ন কোনো ধর্ম নয়। মানুষ ইহকালে ভাল কাজ করলে পরকালে ভাল ফল লাভ করবে। মূলত মানুষের স্বভাবে পাপ নেই মানুষ তার কাজের মধ্যে পাপে জড়িত হয়। কেননা প্রত্যেকটি শিশু নিষ্পাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। ইসলামে মুক্তি হচ্ছে উচ্চমার্গে আরোহণ, সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণ। ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মে পার্থক্য আছে বলে এই প্রবন্ধে একটি তুলনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে জগৎ দুঃখ, কষ্টে যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ এর থেকে মুক্তিলাভ করতে হলে বৌদ্ধ ভিক্ষুবেশে ধ্যানে মগ্ন হয়ে নিজের মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। আর খ্রিষ্টান ধর্মের উৎপত্তি পাপের কল্পনা থেকে। ঈশ্বর-প্রেমিক হবার পথ হচ্ছে বৈরাগ্য সাধন। কিন্তু ইসলাম বলছে, পৃথিবীর দুঃখ কষ্ট মানুষের সৃষ্টি আর মানুষ ইচ্ছা করলে তা দূর করতে পারবে। প্রকৃতিতে কোনো পাপ নেই আর কোনো ক্রুদ্ধ দেবতার সন্তোষ সাধন মানুষের কাজ নয়, ইসলামে বৈরাগ্যও নিষেধ। প্রবন্ধে কোরআন থেকে উদ্ধৃতি তুলে লেখা হয়েছে যে, ধর্মের নিমিত্তে তোমার মুখ খাড়া করে সোজা দিকে রাখ, স্বভাব আলস্ন্লাহর সৃষ্টি যাতে তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আলস্ন্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই, এই সত্য ধর্ম। ইসলামে কোনো ভৌগোলিক বা শ্রেণি বৈষম্য নেই বরং সব জাতি সব মানুষ প্রকৃতির সব কিছুর ধর্ম এবং মহান সৃষ্টিকর্তাই রক্ষাকর্তা। মানুষ যাতে পূর্ণ সকল্পের দ্বারা নিজেকে পরিচালিত করতে পারে মানবতার জন্য সব কিছু ব্যয় করতে পারে, ইসলাম সেই শিক্ষাই দান করে। ইসলামে বলা হয় তোমার সবপ্রিয় বস্তু ধন, সম্পদ, পরিশ্রম, সুখ, শান্তি সবকিছু সৃষ্টিকর্তা ও মানবতার জন্য উৎসর্গ কর। এটাই ইসলামের বাণী, শিক্ষা ও ইসলামের বিশেষত্ব। উলেস্নখ করা হয়েছে:
"মানব বিশ্ব-জগতের পুণ্যকল্পনার উৎপাদক (ভধপঃড়ৎ) স্বরূপ। তাহার মধ্যে একটা স্বর্গীয় (ফরারহব) কিছু আছেই আছে।তাহাকে এই পরিপুষ্টি ও সমৃদ্ধিও কার্য্যে ইসলাম বিশেষভাবে সাহায্য করিয়া থাকে! মানুষ যাহাতে পুণ্যসংকল্পের দ্বারা নিজেকে পরিচিত (রফবহঃরভু) করিতে পারে, মানবতার জন্য সর্বস্ব ব্যয় করিতে পারে, ইসলাম সেই শিক্ষাই দান করিয়া থাকে।"১৩
প্রবন্ধকার শাহাদাৎ হোসেন এভাবে কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ইসলাম ধর্মের বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র্য বর্ণনা করার প্রয়াস পেয়েছেন এবং এই পরিচয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নয়, বরং মানবতার জন্য নিজের সব কিছু উৎসর্গ করার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে।
'মোস্লেম ভারত' পত্রিকার ২য় বর্ষ ১ম খণ্ড ১ম সংখ্যায় (বৈশাখ ১৩২৮) মোহম্মদ লত্ফর রহমান রচিত 'মহানবীর উত্তারাধিকারগণ' প্রবন্ধে নবির গুণ ও চরিত্রের বৈশিষ্ট্যাবলির উত্তরাধিকার অনুসন্ধান করা হয়েছে। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, হযরত মুহাম্মদ বিশ্বজনবাসীকে নিজের উত্তরাধিকারী বলে নির্দেশ করেছেন। তিনি জ্ঞানের সেবকদের সমাজের মধ্যে উচ্চ শ্রেণির লোক বলেছেন। ইসলামে কোনো শ্রেণি নেই, সবাই সমান। রাজা, প্রজা, গরিব, ধনী, সাদা, কালো সবাই সমান। অথচ মুসলিম সমাজে কতিপয় মানুষ শুধু অর্থ-বিত্তের জোরে নিজেদের বড় বলে দাবি করে। কেউ আবার বংশ মর্যাদার ভুয়া ঝান্ডা উড়িয়ে বেড়ায়। আবার কতগুলো মানুষ পোশাকের আড়ম্বরতায় নিজেকে 'শরিফ বান্দা' বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যা নিতান্তই লজ্জাজনক। মিথ্যার সেবক নীচাশয় সাদা পোশাক পরা শরিফ ঐ চাকচিক্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে প্রবন্ধে আহ্বান জানান হয়েছে এবং এই বিদ্রোহ করার আগে মুসলিমদের অজ্ঞানতার পথ থেকে বাঁচতে হবে বলে প্রাবন্দিক মনে করেন। যে মানুষ সব সময় ধর্মের ঝান্ডা উড়িয়ে বেড়ায় অথচ তার আশে-পাশের অসহায় নিপীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না, তাকে ধার্মিক বলা যায় না। যে হূদয় পাপ ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে না, যে জীবন নিজের সুখে বিভোর থাকে, তাকে রাসুলের উত্তরাধিকার বলা যাবে না বলেও তিনি উলেস্নখ করেন। যে মানুষগুলো নারীদের সম্মান দিতে পারে না, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, সে যতই ধর্মের বহিরঙ্গগুলো পালন করুন; সে ধার্মিক নয়। তরুণরাই জগৎ জয়ের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। কারণ তারাই পারে সব অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে। যে মানুষগুলো রাজবেশে চলাফেরা করে অথচ মনের মধ্যে দাসত্বের বীজ বপন করে, তাদেও সঙ্গে সমাজ ও ধর্মের প্রকৃত অর্থে কোনো যোগ নেই। সত্যের সেবকরাই মহানবীর উত্তরাধিকার। তারাই সত্য উদ্ধারের অগ্রপথিক। লেখক মনে করেন, কোরআনের আলোক জ্বালাবার জন্য আজ তরুণ মুসলিমদের উঠে দাঁড়াতে হবে। তরুণেরা স্বাধীন, তাদের মধ্যে অনেক শক্তি নিহিত। যারা সত্যের পথে আছ মহানবির অঙুলি সংকেত তরুণদের দিকেই, তাদের ভীত হবার কোনো কারণ নেই। এই প্রবন্ধে গভীর অর্থে কোনো দর্শনচর্চা হয় নি, এমন মনে হলেও এখানে ইসলাম ধর্মের মূলকথার আলোকে ঐক্য, সংহতি ও সম্ভাবনার মত লোকচেতনার দিকটির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, রক্ষণশীলতাকে নয়।
'মৌলানা জালালউদ্দীন রুমী' প্রবন্ধে মোহম্মদ বরকতুল্লাহ্ এই বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিকের জীবন, কর্ম ও দর্শন নিয়ে কয়েক কিস্তিতে বিশদ আলোচনা করেছেন। ২য় বর্ষ ১ম খণ্ড চতুর্থ সংখ্যা (অগ্রহায়ণ ১৩২৮) থেকে এই আলোচনার আরম্ভ হয়। রুমি ১২০৭ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম, শৈশব ও বেড়ে ওঠার পরিচয় আছে এই প্রবন্ধে। তবে লেখকের দৃষ্ট রুমিকে ইসলামি কবি ও দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার দিকে নয়, রুমির মাহাত্ম্য বর্ণনার দিকে। তিনি বিস্তারিত লিখেছেন এভাবে, সাধু পুরুষেরা অন্তদর্ৃষ্টির সাহায্যে সাধারণের অগোচর অনেক সত্য জানতেন। একদিন তাব্রিজ শহরের জনৈক বণিক জালালউদ্দিনের কাছে এসে তার মনের কথা নিবেদন করলেন। জালালউদ্দিন অন্তদর্ৃষ্টির দিয়ে জানতে পারলেন যে বণিকটি ইউরোপে বহুদিন আগে এক ফিরিঙ্গিকে অপমানিত করায় তার এ অবস্থা। তিনি বণিককে সেই ফিরিঙ্গির কাছে ক্ষমা মার্জনার আদেশ দিলেন এবং ফিরিঙ্গি বর্তমানে কোথায় কোন অবস্থায় আছে তার বর্ণনা দিলেন। বণিক এই খোঁজে গিয়ে দেখিলেন জালালউদ্দিনের বর্ণনানুসারে সে জীর্ণ বস্ত্রে পা মেলে বসে আছে। সাধু তার বর্ণনা শুনে বললেন, তোমার পাপ অমার্জনীয় কিন্তু জালাল চোখের দিকে তাকিয়ে আছে তোমাকে ক্ষমা না করলে তিনি লজ্জিত হবেন। এই বলে সাধু তাকে ক্ষমা করে দিলেন। বণিক সাধুকে জালালউদ্দিন সম্পর্কে অবগত আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করলেন। সাধু উত্তরে কিছু না বলায় বণিক চক্ষুর উপর হস্ত স্থাপন করলেন। বণিক দেখলেন সাধু জ্বলন্ত পাবকের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে বসে আছেন আর ললাটের ভাস্করে চারিদিক আলোকিত এবং বারিধির গভীরতম প্রদেশে নানা রত্নে পুলকিত হচ্ছে। তা দেখে বণিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। দেশে ফিরে বণিক একদিন জালালউদ্দিনকে এ সব বিস্তারিত বললেন। উত্তরে জালালউদ্দিন জানাল খোদার রাজ্য বিশাল ও পবিত্র। এ দুনিয়ায় যেমন রক্ত-প্রবাল ও মণিমুক্তা শোভা পায় তেমনি সামান্য মৃৎখণ্ড বা নীরসও শোভা পায়, তা বিশ্বাস দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়। এই সুমধুর বচন শুনে বণিক তন্ময় হয়ে যান এবং তার মনে জালালের কথার সুর অনুরণিত হতে থাকে। তাই সবকিছু ছেড়ে বণিক ফকিরি গ্রহণ করে জালালকে স্মরণ করেন। প্রবন্ধে একেই বলা হয় তাঁর পরশ পাথরের সন্ধান লাভ। ব্যথিত, ভূষিত, পাপ, তাপদগ্ধ নানা শ্রেণি লোকই জালালের কাছে আসত বলে কুমিয়ার শাসনকর্তা পরওয়ানা একদিন জালালের শিষ্যমণ্ডলীকে কটাক্ষ করেছিলেন। উত্তরে জালাল বলেছিলেন তারা পতিত তারাই এসেছে, যারা সত্য পথে আছে তাদের তো আসার প্রয়োজন নেই। প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত লেখায় উলেস্নখ করা হয়েছে, একদিন এক পুত্রহারা ব্যক্তি এসে জালালের কাছে কান্নাকাটি করলে জালাল চিন্তা করলেন এক পুত্র হারানোর বেদনা যদি এত হয়_ তাহলে মানুষ মোহে পড়ে তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ খোদাকে হারাতে বসছে, সে কথা মানুষ বুঝলে কি প্রলয় কাণ্ড হবে। জালাল ভণ্ডামি মোটেও সহ্য করতেন না। জালাল হামজা নামের এক বংশীবাদককে খুব ভালবাসতেন। তিনি তার বাঁশির সুরে আলস্নাহর প্রেমে মগ্ন হতেন। বংশীবাদকের মৃতু্য সংবাদে তিনি এতই বিচলিত হলেন যে, তাৎক্ষণিক ছুটে গিয়ে তাকে টেনে তুলে তার বাঁশি নিলেন নিজে, উন্মাদের ন্যায় নৃত্য গীত শুরু করলেন। আলস্ন্লাহর তার এ ভক্তের কামনা পূরণ করেন। এভাবে তিনদিন তিনরাত বাঁশির সুর ও নৃত্য চলল। এদেখে বহু লোক জালালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেই আকর্ষণীয় ঘটনার উত্তেজনায় এবং মনোমুগ্ধকর ভাষায় রুমির মহত্ত্ব ও তার প্রতি মানুষের আকর্ষণের স্বরূপ এই প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে অলৌকিকত্বেও যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, রক্ষণশীলগণ এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন। কিন্তু এই বর্ণনার যে লোকদর্শনগত মূল্য আছে তার গুরুত্ব অপরিসীম।
'মোস্লেম ভারতে' পত্রিকায় প্রকাশিত ধর্মীয় কথা-কাহিনি ও তত্ত্বাবলি বিশেস্নষণ করলে দেখা যায়, সবধর্মের নয়, মূলত মুসলিম ধর্মের কথা-কাহিনি ও তত্ত্ব-দর্শনই এখানে ছাপা হয়েছে। অবশ্য পত্রিকার নামকরণেই 'মোস্লেম' শব্দ যেহেতু আছে সেহেতু এ ব্যাপারে বৈধ একটি উত্তরও মেলে। তবে প্রবন্ধগুলো ধর্মীয় হলেও এর কোনোটিতে ধর্মান্ধতা বা অতি শাস্ত্রানুগত্য প্রকাশ পায়নি। 'মোসলেম ভারতে'র সমকালে মুসলিম সম্পাদিত অনেক পত্রিকায় চরম শাস্ত্রানুগত্য ও ধর্মীয় মৌলতন্ত্র প্রকাশ হয়েছিল। এই পত্রিকা সে দিক থেকে মুক্ত। আজানের বঙ্গানুবাদও ছাপা হয়েছে 'মোস্লেম ভারতে'র পৃষ্ঠায়।১৪ এটা নবসৃষ্টির পরিচয়বহ নিশ্চয়ই। প্রকৃতপক্ষে, একটি সমন্বয়পন্থী মনোভাব নিয়ে 'মোস্লেম ভারত' প্রকাশ পেয়েছে। এই পত্রিকায় মুসলিমদের যে কথা-কাহিনি ছাপা হয়েছে বা মুসলিম-দর্শন সম্পর্কিত যে-সব রচনা মুদ্রণ করা হয়েছে তাতেও মানবতাবাদী ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। ধর্ম শুধুই বিশেষ সমপ্রদায়ের স্বার্থে চর্চিত না হয়ে সর্বমানবের কল্যাণার্থেও যে চর্চিত হতে পারে, এই বিশ্বাসকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকা।
======================
ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ  নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী  গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ  ড. সৌমিত্র শেখর


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.